একই সিরিয়ালে চালাতে হবে লাইটারেজ জাহাজ

কাল থেকে নৌ বাণিজ্য দপ্তরের অনুমোদন ছাড়া করা যাবে না পণ্য পরিবহন ।। কেউ অমান্য করলে মেরিটাইম আইনে ব্যবস্থা ।। ঢাকায় উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত

হাসান আকবর | বুধবার , ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৮:১৭ পূর্বাহ্ণ

আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে নৌ বাণিজ্য দপ্তরের অনুমোদন ছাড়া কোনো লাইটারেজ জাহাজই পণ্য পরিবহন করতে পারবে না। নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপ্যাল অফিসারের অনুমতিপত্র ছাড়া কোনো জাহাজই চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থানকারী কোন মাদার ভ্যাসেল থেকে কোনো পণ্য খালাস কিংবা পরিবহন করতে পারবে না। ডব্লিউটিসি কিংবা আইভোয়াকের নামে নয়, মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের প্রিন্সিপ্যাল অফিসারের (পিওএমএমডি) কার্যালয় থেকে একই সিরিয়ালে জাহাজ বুকিং দিতে হবে। বড় বড় শিল্প গ্রুপের নিজস্ব জাহাজে নিজস্ব পণ্য পরিবহনকালে এই সিরিয়ালের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে না। তবে এসব জাহাজকেও চলাচলের ক্ষেত্রে পিওএমএমডির পূর্বানুমতি নিতে হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে চলাচলকারী লাইটারেজ জাহাজ সেক্টরে শৃক্সখলা আনার পাশাপাশি বন্দরের বহির্নোঙরসহ নৌ পথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গতকাল ঢাকায় অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক থেকে উপরোক্ত নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। লাইটারেজ জাহাজ চলাচল এবং মনিটরিং এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশ এবং চট্টগ্রাম বন্দরকেও সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে বছরে অন্তত দশ কোটি টন পণ্য পরিবাহিত হয়। এই পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত রয়েছে প্রায় ১৮শ’ লাইটারেজ জাহাজ। এসব জাহাজের মালিকদের তিনটি সংগঠন যথাক্রমে বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), কোস্টাল শিপ ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) এবং ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স অব চিটাগাং (আইভোয়াক) এর সমন্বয়ে গঠিত ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) গত প্রায় ২১ বছর ধরে জাহাজ চলাচলের ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। সম্প্রতি ডব্লিউটিসি থেকে বের হয়ে আইভোয়াক আলাদা একটি সেল গঠন এবং জাহাজ বুকিং দেয়া শুরু করে। দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়া দুইটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ উত্থাপন করতে থাকে। লাইটারেজ জাহাজ সেক্টরে বিরাজমান বিশৃক্সখল পরিস্থিতিতে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বৈঠক আহ্বান করে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের উক্ত বৈঠক থেকে চট্টগ্রামের নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপ্যাল অফিসারকে প্রধান করে তিন সংগঠনের ছয়জন সদস্য নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। ওই কমিটিকে জাহাজ পরিচালনার ব্যাপারটি ঠিকঠাক করে একই সিরিয়ালে লাইটারেজ জাহাজ পরিচালনা করার নির্দেশনা দেয়া হয়।

গত ২২ জানুয়ারি থেকে ডব্লিউটিসি এবং আইভোয়াকের সদস্যদের জাহাজ একই সিরিয়ালভুক্ত হয়ে পিও এমএমডির অফিস থেকে পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উক্ত নির্দেশনা মেনে গত এক সপ্তাহেরও বেশি ডব্লিউটিসি পিওএমএমডির অফিস থেকে জাহাজ বুকিং এবং পরিচালনা করলেও গতকাল পর্যন্ত আইভোয়াক তাতে যোগ দেয়নি। আইভোয়াক নিজেদের মতো করে জাহাজ ম্যানেজ করছিল। এতে করে নৌ পরিবহন অধিদপ্তর থেকে উদ্যোগ নেয়া হলেও তা মূলতঃ অকার্যকর থেকে যায়। ইতোমধ্যে গত সোমবার আইভোয়াক নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে এক পত্র দিয়ে ডব্লিউটিসির নানা দুর্নীতির তথ্য উপস্থাপন করে আল্টিমেটাম দেয় যে, এসব দুর্নীতি উদঘাটন এবং রোধ করা না হলে তাদের পক্ষে একই সিরিয়ালভুক্ত হয়ে পিও এমএমডির অফিস থেকে জাহাজ পরিচালনা সম্ভব নয়।

এরই প্রেক্ষিতে গতকাল ঢাকায় নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলমের দপ্তরে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ডব্লিউটিসি এবং আইভোয়াক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি জাহাজ মালিকদের অনেকেই অংশ নেন। চট্টগ্রাম থেকে পিও এমএমডি ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদও যোগ দেন। বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত চলা টানা বৈঠকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এতে ডব্লিউটিসি এবং আইভোয়াকের নেতৃবৃন্দ পরস্পরের প্রতি অভিযোগ উত্থাপন করেন। বৈঠক সমাপ্ত করার আগে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম বলেন যে, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সেক্টর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। দেশের পণ্য প্রবাহ নেটওয়ার্ক এই খাতের উপর নির্ভরশীল। এই সেক্টরের উপর সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সকলের নজর রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সকলেই কমবেশি অবগত রয়েছেন। তাই যা হয়েছে আর বাড়াবাড়ি করতে দেয়া হবে না। আগামী বৃহস্পতিবার থেকে সব লাইটারেজ জাহাজই এমএমডির পূর্বানুমতি নিয়ে চলাচল করবে। এমএমডির অনুমোদন ছাড়া কোনো জাহাজকেই পণ্য পরিবহন করতে দেয়া হবে না। বিষয়টির সাথে বাংলাদেশ নৌ বাহিনী, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশ এবং চট্টগ্রাম বন্দরও সম্পৃক্ত থাকবে। ডব্লিউটিসি বা আইভোয়াক বুঝি না। সব জাহাজই পিও এমএমডির অফিস থেকে সিরিয়াল মেনে চলাচল করবে। তবে যে সব শিল্পগ্রুপ এতোদিন নিজেদের জাহাজের নিজেদের পণ্য পরিবহন করে আসছে সে সব জাহাজকে সিরিয়ালে আসতে হবে না। তবে তাদেরকেও এমএমডি থেকে পূর্বানুমতি নিয়ে সাগরে যেতে হবে। বৈঠকে স্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয় যে, এমএমডির অনুমোদন ছাড়া কোন জাহাজকেই চলাচল করতে দেয়া হবে না। বিষয়টির সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরের শৃক্সখলা এবং নিরাপত্তা জড়িত বলেও সভায় উল্লেখ করা হয়।

কাউকে কোনো ধরণের বিশৃংখলা করতে দেয়া হবে না বলেও সভায় কঠোরভাবে সতর্ক করে দেয়া হয়। এতে বলা হয় যে, অভিযোগ কিংবা পাল্টা অভিযোগের সুরাহা পরে করা হবে। হিসেব নিকেশ অবশ্যই আমরা অডিট ফার্ম দিয়ে অডিট করাবো। তবে এখন এসব নিয়ে কোনো ধরণের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না।

গতকালের বৈঠকের ব্যাপারে ডব্লিউটিসির কনভেনর মোহাম্মদ নুরুল হক বলেন, অত্যন্ত সফলভাবে একটি বৈঠক হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমরা আগেও সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসরণ করেছি, এখনো করবো। আমরা ২২ জানুয়ারি থেকে পিও এমএমডির কার্যালয় থেকে সিরিয়াল মেনে জাহাজ বরাদ্দ দিচ্ছি। আগামীতেও দেবো। আমাদের কোনো সমস্যা নেই। কয়েকজন জাহাজ মালিক এবং পণ্যের এজেন্টের কাছে আমাদের আটকে থাকা সাড়ে ৬শ’ কোটি টাকা উদ্ধারে পরবর্তীতে পদক্ষেপ নেবেন বলে আশ্বাস দেয়া হয়েছে বলেও মোহাম্মদ নুরুল হক জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, আগের বৈঠকের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা গত ২২ জানুয়ারি থেকে পিওএমএমডির অফিস থেকে সিরিয়াল দিয়ে জাহাজ চালাচ্ছি। আইভোয়াক শুরু থেকে তালবাহানা করছিল। তবে ভালো খবর হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত তাদেরকে একই সিরিয়ালে আসতে হচ্ছে।

আইভোয়াকের মুখপত্র পারভেজ আহমেদ বলেন, বৈঠকে আমরা অংশ নিয়েছিলাম। আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছি। আমাদের অভিযোগের ব্যাপারে অত্যন্ত ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আগামীতে স্বাধীন অডিট ফার্ম দিয়ে ডব্লিউটিসির হিসেবনিকেশ অডিট করা হবে। পিও এমএমডির অফিস থেকে একই সিরিয়ালে জাহাজ পরিচালনার ব্যাপারে আমরা সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো।

নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপ্যাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ গতকাল ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত থাকার কথা উল্লেখ করে বলেন, বৃহস্পতিবার থেকে একই সিরিয়ালে জাহাজ চলাচল করবে। ডব্লিউটিসি বা আইভোয়াক বুঝি না, সব জাহাজকেই এমএমডির অনুমোদন নিয়ে পণ্য পরিবহন করতে হবে। এমএমডি অফিস থেকে সিরিয়াল প্রদান চলছে, সেটা অব্যাহত থাকবে। ন্যাষ্যতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং মেরিটাইম আইনে জাহাজ পরিচালিত হবে। কাউকে আইন লক্সঘন করে নিজেদের মতো করে কিছু করার কোনো সুযোগ দেয়া হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে তো কারো মতামত দেয়া নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি সরকারি নির্দেশ। এটি অনুসরণ করতে সকলেই বাধ্য। কেউ আইন অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে মেরিটাইম আইনেই ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএ সংসদ কতটা সুচারুভাবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে
পরবর্তী নিবন্ধদুই ধাপ পেছাল বাংলাদেশ