গত ১৬ আগস্ট সন্ধ্যায় মোবাইলে যখন ডা. সন্দীপনের মৃত্যু সংবাদ শুনি তখন তার সারল্য ও হাসিমাখা মুখবয়বের সাথে তার বেহালায় সম্প্রতি তোলা এই রবীন্দ্র সংগীতের করুণ সুর কানে অনুরিত হয়। গত ৩০ জুন আমি সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাই। এই উপলক্ষে বিদায় সম্বর্ধনা আয়োজিত হয় ২৯ জুন দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এক গ্যালারিতে। হৃদরোগ বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে সন্দীপন তার বেহালায় এই গান তোলে। অবশ্য আমার অবসর গ্রহণকে উপলক্ষ করে ৪ জুন কক্সবাজারের রয়েল টিউলিপ হোটেলে অবস্থান ও এক সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল সন্দীপনের তত্ত্বাবধানে। সে তার সঙ্গীত পরিবেশক দল নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করে অনেক আগেই। দুর্ভাগ্যবশত করোনা পরিস্থিতির অবনতিতে তা শেষ মুহূর্তে স্থগিত হয়ে যায়। এই নিয়ে সন্দীপন কিছুটা মনঃক্ষুন্ন হয়। তার নিজের ও অন্যান্য সঙ্গীত শিল্পীদের দীর্ঘ প্রস্তুতি সত্ত্বেও তা বাস্তবায়িত না হওয়ায়।
সন্দীপন আমার প্রিয় ছাত্রদের অন্যতম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমডি(কার্ডিওলজি) ডিগ্রি সম্পাদন করে। এখানে আমি তাকে ছাত্র হিসাবে পাই। পরবর্তীতে সে আমার সহকর্মী। আমি চমেক হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালনকালে সন্দীপন এই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। কর্মে, চিন্তায় ও চেতনায় ডা. সন্দীপন ছিল এক আলোকিত মানুষ। তার নামের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ সেই আলোকচ্ছটা। তার প্রথম পরিচয় হৃদরোগের একজন মেধাবী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে। তবে পেশাাগত জীবনে সে শুধু তার মেধাকে ব্যবহার করেনি; সমভাবে ব্যবহার করেছে তার হৃদয়কেও। হৃদয় দিয়ে হৃদরোগের চিকিৎসা করেছে। হৃদয় আর মস্তিষ্কের যুগপৎ ব্যবহারের মাধ্যমে ডা. সন্দীপন হয়ে উঠে নিজেই এক প্রতিষ্ঠান। তাইতো ডা. সন্দীপন যথার্থই একজন মানবদরদী, পরদুঃখকাতর ও সংবেদনশীল চিকিৎসকের প্রতিমূর্তি। তবে অন্যান্যদের মতো আমি তাকে কেবল একজন মানবিক চিকিৎসক হিসেবে চিন্তিত করব না। কারণ আমি মনে করি চিকিৎসা পেশাটাই একটা মানবিক পেশা। আর তাই চিকিৎসক মানবিক না হলে তিনি এই পেশার সদস্য হিসাবে নিজকে দাবি করার যোগ্যতা রাখেন না। নিঃসন্দেহে ডা. সন্দীপন উচ্চ মানবিক মূল্যবোধের অধিকারী ছিল। একজন ভালো চিকিৎসকের যা গুনাবলী থাকা বাঞ্ছনীয় তার সবটাই ছিল প্রয়াত সন্দীপনের মধ্যে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে বৃটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত “এবিসি অফ গুড ডক্টর (ABC of good doctor)” এ প্রায় একশোর মত গুণাবলীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই ধরনের সর্বগুণে গুণান্বিত চিকিৎসক খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। তার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পেশাগত জ্ঞান, মানবিক বিভিন্ন গুণাবলীর যথাযথ প্রয়োগ, পেশার প্রতি একনিষ্ঠতা ও উচ্চ নৈতিকতাবোধ। এ সবের মাধ্যমে ও জ্ঞানের সর্বোচ্চ ব্যবহারে মানব সেবার সুযোগ রয়েছে বলেই চিকিৎসা পেশা সারা বিশ্বজুড়ে একটা সারা জাগানো পেশা হিসেবে স্বীকৃত। এই দেশের চিকিৎসা পেশা যাদের নিয়ে গর্ব করতে পারে প্রয়াত ডা. সন্দীপন তাদের মধ্যে অন্যতম। সে তার কর্মকান্ডকে কেবল চিকিৎসাদানে সীমাবদ্ধ রাখেনি। সে কেবল মানুষের শারীরিক চিকিৎসার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। স্বাস্থ্যের সংজ্ঞায় যেমন শারীরিক মানসিক ও আত্মিক সুস্থতার কথা বলা হয়ে থাকে তেমনি ডা. সন্দীপন মানসিক ও আত্মিক সুস্থতা বিধানেও নিজেকে নিয়োজিত করেছিল। শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে তা সে করেছে, জাতীয় পর্যায়ে। বেহেলা, তবলা ও অন্যান্য যন্ত্র সঙ্গীত ছাড়াও সঙ্গীত চর্চা, কবিতা আবৃতিসহ সংস্কৃতি চর্চার প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল তার অবাধ বিচরন। হৃদরোগের মত জটিল ও প্রাণঘাতি বিষয়ের চিকিৎসায় দিবারাত্রি ব্যস্ত ও মানসিক চাপে থাকা একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মধ্যে এত গুণাবলীর সমাহার সত্যিকার অর্থে বিরল। এত সব দিক সুচারুরূপে সামলে গেছে প্রয়াত ডা. সন্দীপন একান্তমনে, নিবিড় মনোযোগের সাথে। তা করতে গিয়ে হয়তোবা নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যথোপযুক্ত মনোযোগী হওয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি। তার কিডনীরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্থ্থলতা সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল। গতবছর গুরুতর কোভিড নিয়ে তার কর্মস্থল হৃদরোগ বিভাগের সিসিইউতে চিকিৎসকদের জন্য নির্ধারিত বেডে ভর্তি ছিল। চিকিৎসক ও সহকর্মীদের আন্তরিক প্রচেষ্টায়, সর্বস্তরের মানুষের শুভকামনায় সে যাত্রা সেরে উঠে। কিন্তু এবার অপ্রত্যাশিত এক রোগের (পেনক্রিয়াটাইটাস) জটিলতায় তার জীবনাবসান ঘটে। গেল বছর কোভিডের সময় আমি হৃদরোগ বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালনকালে তার চিকিৎসার কিছু তদারকির সুযোগ পেয়েছিলাম। এবার অবশ্য সেই সুযোগ হয়নি সঙ্গত কারণে। তার বর্তমান সহকর্মীদের কাছে শুনেছি জটিলতা নিয়ে ভর্তির আগে থেকে তার পেটের ব্যথা চলছে কয়েকদিন ধরে। দুর্ভাগ্যক্রমে তা গুরুতর ও জটিল হয়ে পড়ার আগে সে হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। চিকিৎসকরা নিজের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উদাসীন থাকেন। আর ডা. সন্দীপনের মতো অন্যের জন্য নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক নিজের ব্যাপারে আরো উদাসীন ছিল তা বলাই বাহুল্য। অথচ একজন ডা. সন্দীপনের জীবন রক্ষা পেলে ভবিষ্যতে অগনিত মানুষের জীবন রক্ষা পেতে পারতো। এ ধরনের নির্র্মম বাস্তবতাকে উপলব্ধি করেই চিকিৎসা পেশায় চিকিৎসকদের অঙ্গীকার নামা (যা ‘জেনেভা ঘোষণা’ নামে পরিচিত) ওয়াল্ড মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ২০১৭ সালে নতুন করে হালনাগাদ করে। এতে রোগীর স্বাস্থ্যের পাশাপাশি চিকিৎসকদের নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা সন্নিবেশিত হয়েছে। এই অঙ্গীকার নামায় আছে “রোগীদের সর্বোচ্চ সেবাদানের নিমিত্তে আমি আপনার নিজের স্বাস্থ্যের উপযুক্ত যত্ন নিশ্চিত করব।” এই সংশোধনী বর্তমান চলমান কোভিড পরিস্থিতিতে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ এখন বিশ্বব্যাপী চলছে চিকিৎসক সংকট। চিকিৎসকগণ নিজেরা সুস্থ না থাকতে পারলে এই সংকট আরো ঘনিভূত হতে বাধ্য। এ পরিস্থিতিতে বৃটেনের এনএসএইচ সহ অন্যান্য দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। ডা. সন্দীপনের অকালে চলে যাওয়া চিকিৎসকদের নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষার আরো যত্নশীল হওয়ার ব্যাপারকে সামনে নিয়ে এসেছে। রোগী অন্তপ্রাণ ডা. সন্দীপন নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথাটি ঠিকমত হয়তো বা মনে রাখতে পারেনি। কিন্তু তার সেদিনকার বেহেলার সুরের আহবান “এই কথাটি মনে রেখো” সবাই ঠিকই মনে রেখেছে। মনে রেখেছে তার রোগী, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও বিভিন্ন স্তরের সংস্কৃতিসেবী সহ আপামর জনসাধারণ। তবে এই উপস্থাপনার ঠিক দেড় মাসের মাথায় তা এইভাবে বাস্তবে ঘটে যাবে তা হয়ত কারো ভাবনায় আসেনি। ডা. সন্দীপনের বেহালা সেদিন সুর তুলে বলে গেছে ‘তোমাদের এই হাসি খেলায়/জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়…আমি যে গান গেয়েছিলেম… আমি চলেছিলেম রাতে/সন্ধ্যা প্রদীপ নিয়ে হাতে/যখন আমায় ও-পার থেকে গেল ডেকে। এই এক কাকতালীয় ব্যাপার বটে। এক অদ্ভুত যোগ সূত্র সন্দীপনের এই গান গাওয়া আর চলে যাওয়ার মধ্যে। সেদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত কেউ ঘুনাক্ষরেও তা চিন্তা করেনি। সত্যি যে বড় কঠিন ডা. সন্দীপনের চিরবিদায় তা আরেকবার মনে করিয়ে দিল।
নোবেল বিজয়ী আমেরিকান উপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘For whom the bell tolls’ এ আছে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার গীর্জার ঘন্টা মনে করিয়ে দেয় প্রতিটি মানুষ ক্রমশ মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অর্থাৎ সেই ঘন্টাধবনি যারা জীবিত তাদের জন্যই (The bell tolls for thee)। যখন কেউ মারা যায় তখন আমরা জীবিতরাও একটু একটু মরে যাই। কারণ সব মানুষ সামাজিক ও আত্মিকভাবে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। অনতিক্রম্য এই মৃত্যুর কথা চিন্তা চেতনায় সর্বদা ধারণ করে চলার কথা সকল ধর্ম বিশ্বাসে বলা হয়েছে। সন্দীপনের বেহালায় সেই অন্তিম আবেদন- ‘এই কথাটি মনে রেখো’ সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। তার অগণিত গুণমুগ্ধগণ কেবল তার বেহালার সুর, তবলার ছন্দ কিংবা তার দেওয়া চিকিৎসা মনে রাখেনি তারা মনে রেখেছে তার অকৃত্রিম ভালোবাসাও। মৃত্যু তাকে পরাজিত করেছে সত্যি কিন্তু মানুষের প্রতি তার প্রগাঢ় ভালোবাসা তাকে জয়মাল্য পরিয়েছে। তাকে অমর করেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনসায়াহ্নে রোগশয্যার অনুভূতির মতো ‘এ বিশ্বরে ভালোবাসিয়াছি, এই ভালোবাসাই সত্যি এ জন্মের দান। বিদায় নেবার কালে এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার।’
লেখক: অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।