এআই-পাড়ার সাহিত্য

মাহমুদ আলম সৈকত | শুক্রবার , ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

গেলো মাসে ভারতের ওড়িশায় প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, প্রচার ও পুনরুদ্ধার কেন্দ্র ‘প্রাচীন’ আয়োজিত একটি সাহিত্য সম্মেলনের ভিডিও দেখছিলাম। এবারের সম্মেলনে ‘প্রাচীন’ ঘোষিত ‘সাহিত্য সম্মান’ পদক পেলেন খ্যাতনামা গীতিকার ও লেখক জাভেদ আখতার। পদক গ্রহণের পর, শুভেচ্ছা বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি বলছিলেন, “আগামীতে কী হতে যাচ্ছে, সেটা আমি এখনই বলতে পারছি না। তবে এই মুহূর্তে আমি নিশ্চিত যে এআই কোনোভাবেই মানুষের সৃজনশীলতাকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির নিজস্ব কোনো বিবেক নেই; এটি নির্ভর করে আপনি কীভাবে ব্যবহার করছেন তার ওপর। এআইএর ভেতরে থাকা উপাদানগুলো নিজে থেকে খারাপ নয়। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখবেন, মানুষ সব আবিষ্কারকেই প্রথমে ভয় পেতো, এমনকি বাষ্পীয় ইঞ্জিনকেও শয়তানের যান বলে অভিহিত করা হয়েছিল।” উনার এই বক্তব্য আমাকে আরেকটি ভাবনার দিকে টেনে নিয়ে যায়। এমনিতে উপরের বক্তব্যটি এআইএর সঙ্গে বা এআইকে নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাদের সবার জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু সৃজনশীল অঙ্গনে? বিশেষ করে লেখকশিল্পীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি কীরকম হতে পারে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাড়বাড়ন্ত কী মানুষের সৃজনশীলতাকে সত্যিই ছাপিয়ে যেতে পারবে না বা ছাপিয়ে গেল একদিন! প্রসঙ্গে আরেকটু জানতে অন্তর্জালে বেশ কয়েকদিন নানান রকমের আর্টিকেল পড়া শুরু করলাম। আর এই পাঠের মধ্যে কে. এম. ওয়েইল্যান্ডের একটি প্রবন্ধ পড়ে চিত্তাকর্ষক মনে হলো। সেই প্রবন্ধেরই অনুবাদকৃত নির্বাচিত অংশ রইল এই লেখার বাকিটুকুতে।

আমরা এখনো কেবল সেই সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছি, যেখানে এআই সৃজনশীল সহিত্য রচনার জগতে নতুনভাবে যুক্ত হতে পারে। ইতিমধ্যেই বহু লেখক শিখণ প্রক্রিয়ায়, গবেষণায়, কাঠামো তৈরি করতে, প্লট দাঁড় করাতে, সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজে এআইএর সহায়তা নিচ্ছেন। সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ায় এআইএর সহায়ক ভূমিকা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত। যে মাত্রায় এআই আমাদের প্রকৃত অর্থে আরও সৃজনশীল করে তোলে (অধিক উৎপাদনশীল নয়), সে অর্থে এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক ও বিস্তৃতিমুখী উপকরণ হয়ে উঠবে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি শিল্পীর উচিত সচেতনভাবে অনুধাবন করা যে, ঠিক কোথায় এসে এআই সৃষ্টির হাতিয়ার থেকে স্রষ্টায় পরিণত হয়।

যে ভবিষ্যতের দিকে আমরা এগুচ্ছি, সেখানে মানুষ ও এআই ক্রমশ আরও বেশি সহযোগী হয়ে উঠবে। এই প্রেক্ষিতে আমি সবাইকে নিজের প্রতি একটি প্রশ্ন করতে আহ্বান জানাই, আমি কি এমনভাবে এআইএর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি, যা আমাকে আরও মানবিক করে তুলছে, বা অমানবিক? শিল্পী, লেখক, সৃজনশীল মানুষদের জন্য এই প্রশ্নটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ; কারণ আমাদের সৃষ্টিশীল কর্মই আমাদের মানবিকতার ভিত রচনা করে, প্রথমে ব্যক্তি হিসেবে, পরে সামষ্টিকভাবে।

এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মূলত একটি “মানসিক’’ উপকরণ। এটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যেন সে এক চিন্তাশীল কিছু। ফলে মানসিক শ্রমের সব ধাপেই সহায়তাকারী হিসাবে এর ভূমিকা অনন্য। (হয়তো কোনো একদিন এটি স্বপ্ন দেখবে, অনুভূতিও করবে। কিন্তু তখনও প্রশ্ন থাকবে, আমরা কি চাই, সে আমাদের হয়ে স্বপ্ন দেখুক বা অনুভব করুক?)

কখনো কখনো, বিশেষ করে প্লট বা ঘটনা ভিত্তিক কিংবা বা আউটলাইনপ্রধান লেখকদের কাছে মনে হতে পারে গল্প লেখা একটি মানসিক প্রক্রিয়া। অথচ লেখালেখির মানসিক অংশটি গোটা অভিজ্ঞতার কেবল একটি ক্ষুদ্র অংশ এবং প্রায়ই এটি সবচেয়ে শেষ দিকক্র স্তর। গল্প কেবল মানসিক খেলা নয়; এটি গভীরভাবে অনুভূত এক সৃজনপ্রক্রিয়া, শরীর ও মনের অভিজ্ঞতার সম্মিলন। এই কারণেই গল্প সৃষ্টিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে আমি সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন দেখি।

আমরা যারা লেখালিখি করছি, তাদের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের লক্ষ্য আসলে কী? হয়তো এটি আপনি উপভোগ করেন। হয়তো সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রয়োজনহেতু তাকে ব্যবহার করছেন। হয়তো গল্প সৃষ্টির জটিল পথটিকে সহজ করতে এটির ব্যবহারিক সুবিধা আপনাকে চমৎকৃত করে। হয়তো আরও প্রোডাক্টিভ বা উৎপাদনশীল হতে চান। এসবই বৈধ কারণ-, যতক্ষণ না এর ফলে সৃষ্টির গভীর অভিজ্ঞতা ব্যাহত হয় বা মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে। গল্প প্রথমত আমাদের অবচেতন মনের সঙ্গে আলাপ; পরে তা বিস্তৃত সমষ্টিগত অবচেতন মন পর্যন্ত পৌঁছে যায়। গল্প আমাদের নিজস্ব অস্তিত্বকে গড়ে তোলে। এটি শুধু যোগাযোগ নয় বরং এটি এক ধরনের পবিত্র সঙ্গ বা সংঘ, নিজের সঙ্গে, অন্যের সঙ্গে এবং সেই অসীম রহস্যের সঙ্গে, যা বোধগম্যের বাইরে।

সাহিত্য সৃষ্টি অবশ্যই পবিত্র কিছু। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আমরা এআইকে সহায়ক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারব না। বরং যতক্ষণ এআই আমাদের সৃজনশীল অবচেতন মনকে বিস্তৃত করে ততক্ষণ এটি সহায়কই হবে। কিন্তু গল্পের পবিত্রতা মানে হলো, এআইয়ের সহজ ও দ্রুত উত্তরের প্রলোভনে পড়ে যেন আমরা সৃষ্টির গভীর প্রক্রিয়া এড়িয়ে না যাই। আমার জন্য, গল্প বলা সবসময়ই স্বীয় গভীর অবচেতন, আমার স্বপ্নদর্শী সত্তার সঙ্গে আলাপচারিতা। এআই কী বানিয়ে দিয়েছে, তা জানতে আমি আগ্রহী নই; আমি আগ্রহী আমি কী লিখছি, আপনি কী লিখছেন সেটা জানতে। পাশাপাশি, যদিও এআই সৃজনশীলতা, দক্ষতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে পারে, এটি আমাদের নিজস্ব ক্ষমতাকে হ্রাস করার ঝুঁকিও রাখে বৈকি। এআই কি কাউকে বই লিখতে শেখাতে পারে? গল্পের তত্ত্ব শিখাতে পারে? হ্যাঁ, পারে। কিন্তু কেবল সহায়ক হিসেবে।

কারণ গল্প কেবল একটি মানসিক ব্যায়াম নয়; এটি সম্পূর্ণ এক দেহধর্মী অভিজ্ঞতা। অনেক মহৎ লেখকই কোনো ফর্মুলা জানতেন না, গল্প তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতেও পারতেন না, তবু তাঁরা এমন সব গভীর সৃষ্টিকর্ম রচনা করেছেন, যা মানবসমাজের অবচেতনকে স্পর্শ করেছে এবং রূপান্তরিত করেছে।

মোটাদাগে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উদ্দেশ্যই হলো শর্টকাট দেওয়া। এতে ভালোমন্দ উভয় দিকই রয়েছে। যেমন অন্তর্জাল আমাদের মস্তিষ্ক তথা ভাবনার আঙ্গিককে বদলে দিয়েছে, তেমনি এআইও আমাদের চিন্তাভাবনার ধরন পাল্টে দেবে। আমরা যারা সৃষ্টিশীল, তারা সমাজের প্রাণশক্তি। লেখকেরা সমাজের কণ্ঠস্বর। আমরা কীভাবে এআইকে ব্যবহার করে বাঁচব এবং সাহিত্য সৃষ্টি করব তার প্রভাব আমাদের নিজেদের বাইরে বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছাবে। এই পরিবর্তনের সময়ে আমরা প্রত্যেকেই ইতিহাসের একটি গভীর সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো চরিত্র। আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তই তাই গুরুত্বপূর্ণ। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণ এখানে কোনো একক “সঠিক” পথ নেই। সবচেয়ে জরুরি হলো, আমরা যেন মনে রাখি: আমরা আমাদের জীবনের রচয়িতা। আমাদের সিদ্ধান্তের দায় আমাদেরই।

একবার কেউ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এই দ্রুত পরিবর্তনের যুগে লেখক হওয়ার কোনো মূল্য আছে কি? এর উত্তরে আমি বলেছিলাম, এআই নিয়ে অতিরিক্ত হতাশা (বা অতিরিক্ত আশাবাদও) আমাদের ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে। লেখকেরা সবসময়ই তাদের সাহিত্যকর্মের প্রকাশনা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন, বই প্রকাশিত হোক বা না হোক, উভয়ই ভয়ংকর। আজকের দিনে এআইকে সহজেই আমাদের ভয় ও দ্বিধার ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায়, এবং তাতে করে আমরা ভাবার ফুরসত পাই যে, “সব শেষ, এসব করে কী লাভ?” এবং আমরা যে কাজে হাত দিতে ভয় পাচ্ছি, সেটি আর করা হয়ে ওঠে না। অনেক সময় নতুন প্রযুক্তিগুলো আমাদের ব্যক্তিগত ভয়কে আড়াল করার “অপয়া ভূত” হিসাবে আবির্ভূত হয়। এখন, প্রশ্ন হচ্ছে, এআই কি গল্পকারদের বিলুপ্ত করে দেবে? কে জানে! তবে আমার ব্যক্তিগত মত, একদমই না। প্রযুক্তি গল্প বলার ধরন পাল্টাতে পারে, কিন্তু শিল্পের মূল গতিবিদ্যা পাল্টায় না। একজন মানুষ কিছু বলতে চায়, আর অন্য কোনো মানুষ তা অনুভব করতে চায় এই সারসত্য, মানবসৃষ্ট সৃষ্টিশীলতার প্রয়োজন কোনদিনই হারাবে না। ফলে সৃষ্টি অব্যাহত থাকুক। আমরা এখন এক বিশাল গল্পের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি, আর এক্ষেত্র যেমনটি হওয়া দরকারও বৈকিপথ চলায় ভয়ও আছে, উত্তেজনাও আছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমৃদ্ধ দিনের গান
পরবর্তী নিবন্ধদেশপ্রেম ও সততার সাথে যুবকদের কাজ করতে হবে