উৎসব নেই, আছে উচ্ছ্বাস

৫ম-৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নিল নতুন বই এক ক্লাসে ৩ দিন করে ১২ দিনে দেয়া হবে মাধ্যমিকের বই

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ

নতুন বছর মানেই নতুন ক্লাস আর নতুন বইয়ের উৎসব। নতুন বইয়ের ঘ্রাণে শিক্ষার্থীদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। উৎসব আমেজে নতুন বই হাতে পাওয়ার লোভে বছরের প্রথম দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকে সারাদেশের কয়েক কোটি শিক্ষার্থী। তবে গত বছর থেকে সব কিছুই যেন ব্যতিক্রম। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস এলোমেলো করে দিয়েছে সব। নতুন বইয়ের অপেক্ষা থাকলেও উৎসবের আমেজ ছিল না এবারও। কারণ, বই উৎসব না করে বিকল্প উপায়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা আগেই জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রতি ক্লাসের বই ৩ দিন করে ১২ দিনে বিতরণের নির্দেশনা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একইভাবে প্রাথমিক পর্যায়ের বইও কয়েক দিনে বিতরণে নির্দেশনা জারি করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
নির্দেশনা অনুযায়ী, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোনো ধরনের জমায়েত না করে শিক্ষার্থী বা অভিভাবকের হাতে বই তুলে দিয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। যদিও নির্দেশনার কারণেই গতকাল একই দিনে সব শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানরা। তারা জানিয়েছেন- নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে বই বিতরণের লক্ষ্যে আগে থেকেই ক্লাস ভিত্তিক সিডিউল তৈরি করা হয়। ওই সিডিউলের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট সময়ে সংশ্লিষ্ট ক্লাসের শিক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকরা এসে বই নিয়ে গেছেন। নগরীর নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে কেবল ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণির ১২০ জন করে শিক্ষার্থীর হাতে বই বিতরণ করা হয়েছে প্রথম দিন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক জিয়াউল হায়দার হেনরী আজাদীকে বলেন, এক ক্লাসের বই ৩ দিনে এবং সব মিলিয়ে ১২ দিনে মাধ্যমিকের বই বিতরণে মন্ত্রণালয় ও মাউশির নির্দেশনা রয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী প্রথম দিন আমরা কেবল ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণির দুটি করে সেকশানের শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দিয়েছি। বইগুলো আমরা আগে থেকেই বান্ডেল করে রেখেছি। শিক্ষার্থীরা আসলে তাদের শ্রেণি কক্ষে বসিয়ে একটি একটি করে নতুন বইয়ের বান্ডেল তুলে দেয়া হয়েছে।
১২ দিন পর্যন্ত নতুন বই বিতরণ করা হবে জানিয়ে চট্টগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাসমত জাহান বলেন, প্রথম দিন আমরা ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণির দুটি করে সেকশানের ছাত্রীদের বই বিতরণ করেছি। এভাবে সিডিউল অনুযায়ী ১২ দিন পর্যন্ত বই বিতরণ চলবে। যাতে স্বাস্থ্য বিধি লঙ্ঘিত না হয়।
প্রথম দিন কেবল ৫ম শ্রেণির ছাত্রদের বই বিতরণ করা হয়েছে বলে জানান কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম। রোববার (আজ) ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বই দেয়া হবে বলেও জানান তিনি। কোনো ধরনের জমায়েত না করে এবং সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের হাতে বই বিতরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা তাহমিনা শারমিন। এবার একই দিনে সব শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেয়া হয়নি জানিয়ে এই প্রধান শিক্ষিকা বলেন, নির্দেশনা অনুযায়ী একদিনের পরিবর্তে কয়েকদিনে বই বিতরণ করা হচ্ছে। বই নিতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবককে অবশ্যই মাস্ক পরে আসতে বলা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বই বিতরণে নির্দেশনার বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, বই উৎসবের পরিবর্তে এবারও শুধু বই বিতরণ করা হচ্ছে। শিক্ষার্থী বা অভিভাবক এসে স্কুল থেকে বইগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে। কোনো ধরনের জমায়েত করা যাবে না। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল থেকে বই নিতে হবে। একেক দিন একেক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে প্যাকেটজাত বই তুলে দেয়া হবে। ভিন্ন ভিন্ন দিনে ক্লাস ও রোল অনুযায়ী শিডিউল তৈরি করবে স্কুলগুলো। নির্ধারিত দিনের সুনির্দিষ্ট সময়ে শিডিউলভুক্ত ক্লাসের শিক্ষার্থীরা এসে বই সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে। কোন ভাবেই কোন ধরণের বই উৎসব বা জমায়েত করা যাবেনা।
এদিকে, উৎসব না থাকলেও বই হাতে পাওয়া শিক্ষার্থীদের মাঝে উচ্ছ্বাস ছিল আগের মতোই। নতুন বই পেয়ে আনন্দ ভর করতে দেখা যায় তাদের চোখে-মুখে। নতুন বইয়ের ঘ্রান নিতেও দেখা যায় অনেক শিক্ষার্থীকে।
অন্যদিকে, বছরের প্রথম দিন বই বিতরণ শুরু হলও এখনো পর্যন্ত মাধ্যমিকের চাহিদার অর্ধেক বই পৌঁছেনি চট্টগ্রামে। আর প্রাথমিকের ৯০ শতাংশের বেশি পাওয়া গেলেও জেলার ১৯টি থানা-উপজেলায় প্রাক-প্রাথমিকের একটি বইও আসেনি। মাধ্যমিকের নবম শ্রেণির বই কম পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠান প্রধানরা। প্রধান শিক্ষকরা বলছেন- ক্লাস নাইনের কয়েকটি বিষয়ের বই পাওয়া গেছে। বাকি বিষয়গুলোর বই এখনো পাওয়া যায়নি।
প্রাক-প্রাথমিকের একটি বইও আসেনি ১৯ থানায় : জেলার প্রাথমিকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এরই মধ্যে চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ বই পৌঁছে গেছে বলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় জানিয়েছে। তবে মহানগরসহ জেলার ১৯ থানা-উপজেলায় প্রাক-প্রাথমিকের একটি বইও আসেনি। জেলার ২১ থানা-উপজেলার প্রাথমিকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থী সংখ্যা ১ লাখ ৬৩ হাজার ১৯ জন। ‘আমার বই’ নামে একটি বই পেয়ে থাকে প্রাক-প্রাথমিকের এই খুদে শিক্ষার্থীরা। যার একটিও ৩০ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত পৌঁছেনি। যদিও শুক্রবার (৩১ ডিসেম্বর) সকালে দুটি থানায় (বন্দর ও ডবলমুরিং) প্রাক-প্রাথমিকের বই পৌঁছেছে বলে দাবি করেছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম। অবশ্য, বই পাওয়া না গেলেও প্রাক-প্রাথমিকের একটি করে অনুশীলন খাতার শতভাগ পৌঁছে গেছে জানিয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, অন্যান্য শ্রেণির প্রায় সব (৯০ শতাংশের বেশি) বই পাওয়া গেছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, মহানগরীর ৬টি থানা ও ১৫টি উপজেলাসহ চট্টগ্রাম জেলায় প্রাথমিক পর্যায়ের মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪ হাজার ৪৪৪টি। এর মধ্যে জাতীয়করণকৃতসহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২ হাজার ২৬৯টি, বেসরকারি কিন্ডার গার্টেন (কেজি স্কুল) ১৮ শতাধিক, এনজিও স্কুল ১১৮টি, উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন ১২৭টি, রঙ (আনন্দ স্কুল) ৩০টি, আন রেজিস্ট্রার্ড স্কুল ১০টি এবং পরীক্ষণ স্কুল ২টি। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১ লাখের বেশি।
এসব শিক্ষার্থীর জন্য ২০২২ সালের সম্ভাব্য চাহিদার ভিত্তিতে বরাদ্দকৃত মোট বইয়ের সংখ্যা ৪৬ লাখ ৮ হাজার ৪৯২টি। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার (৩০ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ৩৮ লাখ ৬২ হাজার ৩২টি বই থানা-উপজেলার গোডাউন হয়ে স্কুলে-স্কুলে পৌঁছে গেছে। যা মোট চাহিদার প্রায় ৮৪ ভাগ। এর বাইরে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের ১ লাখ ৬৩ হাজার ১৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য একটি করে বইয়ের চাহিদা রয়েছে চট্টগ্রাম জেলায়। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের মনিটরিং অফিসার নূর মোহাম্মদ এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। অবশ্য শুক্রবারও (৩১ ডিসেম্বর) বই এসেছে জানিয়ে এরই মাঝে ৯০ শতাংশের বেশি বই পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম।
প্রাক-প্রাথমিকেরসহ কিছু বই না পাওয়ায় বই বিতরণে জটিলতার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, এবারও বই উৎসব হচ্ছে না। আর গতবারের মতো একটি স্কুলে অন্তত ৫ দিন করে বই বিতরণ করা হবে। এর জন্য ক্লাস ভিত্তিক সিডিউল তৈরি করা হয়েছে। সিডিউলে প্রাক-প্রাথমিকের বই বিতরণ রাখা হয়েছে শেষ দিনে। এই সময়ের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকসহ সব বই পৌঁছে যাবে বলে আমরা আশা করছি। তাই প্রাথমিকের বই বিতরণে কোনো জটিলতা হবে বলে আমরা মনে করছি না।
অর্ধেক বই পৌঁছেনি মাধ্যমিকের : বছর শেষ হলেও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় অর্ধেক বই পৌঁছেনি চট্টগ্রামে। গত বৃহস্পতিবার (৩০ ডিসেম্বর) পর্যন্ত চাহিদার ৫৩ শতাংশ বই পাওয়া গেছে। মাউশি, চট্টগ্রাম অঞ্চল ও চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। হিসেবে চাহিদার ৪৭ শতাংশ (প্রায় অর্ধেক) বই এখনো বাকি। এতে করে নতুন বছরের শুরুতে মাধ্যমিকের বই বিতরণে জটিলতা দেখা দিতে পারে চট্টগ্রামে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনেক শিক্ষার্থীর সবকয়টি বই পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। অবশ্য, ধাপে ধাপে বই বিতরণের সিদ্ধান্ত রয়েছে জানিয়ে মাউশি চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-পরিচালক দেবব্রত দাশ বলেন, মাধ্যমিকের একটি ক্লাসে তিন দিন করে বই বিতরণ করা হবে। সব মিলিয়ে ১২ দিন ধরে বই বিতরণ চলবে। তাই বছরের প্রথম দিন বিতরণ শুরু হলেও ১২ দিনের মধ্যে বাকি সব বই চলে আসবে বলে আমরা আশা করছি।
চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলার মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এবার মোট বইয়ের চাহিদা ১ কোটি ১৯ লাখ ৫২ হাজার ৯০২টি। এর মাঝে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩ লাখ ৯৯ হাজার ২৯২টি বই পাওয়া গেছে। হিসেবে চাহিদার ৫৩ শতাংশ বই পৌঁছেছে স্কুলগুলোতে। আরো প্রায় অর্ধেক (৪৭ শতাংশ) বই এখনো বাকি। এর বাইরে মাদ্রাসার ২৫ লাখ ৭৬ হাজার ৫৮১টি বইয়ের চাহিদার বিপরীতে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪ লাখ ২৮ হাজার ১২৮টি বই পাওয়া গেছে। হিসেবে চাহিদার ৫৫ শতাংশ বই পৌঁছেছে মাদ্রাসাগুলোতে। আরো ৪৫ শতাংশ বই এখনো আসেনি। বিশেষ করে মাদ্রাসার এবতেদায়ী শ্রেণির বই খুব কম এসেছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
এদিকে, সবমিলিয়ে (মাদ্রাসাসহ) মাধ্যমিক পর্যায়ে চট্টগ্রামে মোট বইয়ের চাহিদা দাঁড়ায় ১ কোটি ৪৫ লাখ ২৯ হাজার ৪৮৩টি। এর মাঝে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭৮ লাখ ২৭ হাজার ৪২০টি বই পাওয়া গেছে। হিসেবে মোট চাহিদার ৫৩ শতাংশের কিছু বেশি বই পাওয়া গেলেও ৪৭ শতাংশ (প্রায় অর্ধেক) বই এখনো বাকি। হিসেবে চাহিদার অর্ধেক বই না পেয়েই বই বিতরণ শুরু হয়েছে চট্টগ্রামে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবছরে রেকর্ড কন্টেনার ও খোলা পণ্য হ্যান্ডলিং
পরবর্তী নিবন্ধপণ্যের মান বজায় রেখে দেশের ভাবমূর্তি বাড়ান