গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে গেল দেশের অন্যতম বৃহৎ সার কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল)। সরকারের জ্বালানি সাশ্রয়ের আওতায় গ্যাস রেশনিং এর কারণে সিইউএফএল-এর উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়। কবে নাগাদ এই কারখানা চালু করা হবে তা অনিশ্চিত বলে কারখানার দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে।
পেট্রোবাংলা এবং বিসিআইসির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গ্যাসের ভয়াবহ সংকট শুরু হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সেক্টরে মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকটের কারণে বিশ্বব্যাপী তেল ও গ্যাসের দাম হু হু করে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে রাশিয়া এবং ইরানের গ্যাস বিশ্বের সরবরাহ নেটওয়ার্কে স্বাভাবিকভাবে না আসায় পরিস্থিতি ক্রমে জটিল হয়ে উঠছে। এতে করে পেট্রোবাংলা এলএনজি আমদানি কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। স্পট মার্কেটে ১০ ডলারের ১ মিলিয়ন বিটিইউ (ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) এলএনজির দাম বর্তমানে ৫৬/৫৭ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। এত চড়া দামে এলএনজি কেনা সম্ভব না হওয়ায় সরকার স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। এই অবস্থায় দেশের সার্বিক গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে।
পেট্রোবাংলা সারাদেশের গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোকে রেশনিং করে পরিস্থিতি সামাল দিতে নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি সার কারখানা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বরাদ্দকৃত গ্যাসের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সার কারখানার জন্য সরকার ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বরাদ্দ করে দিয়েছে। এর মধ্যে কাফকো এবং শাহজালাল সার কারখানা উৎপাদন অব্যাহত রাখবে। এই দুইটি কারখানার মধ্যে কাফকো ৪৩ মিলিয়ন ঘনফুট এবং শাহজালাল ৪৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করছে। বাকি ৪৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করে সিইউএফএল অথবা আশুগঞ্জ সার কারখানার যে কোন একটিকে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে বলা হয়। শেষতক আশুগঞ্জ সার কারখানা চালু রেখে সিইউএফএল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গতকাল থেকে কারখানাটির সার উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এই কারখানা চালু রাখতে দৈনিক কমপক্ষে ৪১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন ছিল। এতো গ্যাস দেয়ার মতো অবস্থা বর্তমানে পেট্রোবাংলার নেই।
কবে নাগাদ পেট্রোবাংলার গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হবে তাও অনিশ্চিত বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার আগে সিইউএফএল চালু হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ বর্তমানে যে ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বরাদ্দ রাখা হয়েছে সেগুলো দিয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো কারখানাগুলোতে উৎপাদন চালানো হবে। যাতে ব্যবহৃত গ্যাস থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদন পাওয়া যায়। কাফকো, শাহজালাল এবং আশুগঞ্জ সার কারখানার অবস্থা সিইউএফএল থেকে ভালো। এতে করে ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করে উক্ত তিনটি কারখানায় সার উৎপাদন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বিসিআইসির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, সার কারখানায় গ্যাস কোন জ্বালানি নয়, কাঁচামাল। এই গ্যাস ব্যবহার করেই ইউরিয়া সার উৎপাদন করা হয়। এতে করে সার কারখানায় গ্যাসের কোন বিকল্প নেই এবং গ্যাস সরবরাহ একটি নির্দিষ্ট পরিমানের চেয়ে কমে গেলে সার উৎপাদন মুখ থুবড়ে পড়ে। বর্তমানে চট্টগ্রামে যে পরিমান গ্যাসের সরবরাহ রয়েছে তাতে সিইউএফএলকে গ্যাস দেয়ার অবস্থা কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির নেই বলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম এবং সন্নিহিত অঞ্চলে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত এলএনজি থাকায় কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি গত বেশ কিছুদিন ধরে ৩১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেতো। স্পট এলএনজি কেনা বন্ধ করে দেয়ায় কর্ণফুলীর গ্যাস প্রাপ্তি ২৭০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে আসে। ফলে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে গ্যাস সরবরাহ দিয়ে আসছে। এতে করে সিইউএফএল এর গ্যাস বন্ধ করে আবাসিক, সিএনজি রি-ফুয়েলিং স্টেশন কিংবা শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ দেয়া হচ্ছে।
আনোয়ারার কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত দেশের অন্যতম বৃহৎ সার কারখানা সিইউএফএল কারখানা পুরোদমে চালাতে ৪৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস লাগে। কারখানাটি দৈনিক ২৪ হাজার বস্তা ইউরিয়া সার এবং এক হাজার টন এ্যামোনিয়া উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশন) ইঞ্জিনিয়ার সারওয়ার হোসেন বিস্তারিত কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে সিইউএফএল-এ গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছে। কারখানাটি ৪১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ নিচ্ছিল বলেও তিনি উল্লেখ করেন।