দেশের অর্থনীতিবিদরা বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে ধস নামার আশঙ্কা করছেন। বৈশ্বিক মন্দা এবং দেশে ডলারের তীব্র সংকটে অর্থনীতি এমনিতেই নাজুক। তার উপরে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পড়েছে দেশ। এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতির এ দুঃসময়ে রাজনৈতিক সমঝোতা যেখানে জরুরি, সেখানে অস্থিরতা বাড়লে অর্থনীতিতে শুধু ধসই নামবে না, আরও অনেক কিছু হতে পারে। এতে দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি বৈদেশিক ও সামাজিক খাতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডলার–সংকটে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হচ্ছিল আগে থেকেই। ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সমস্যাও। জুলাই অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যুক্ত হয়েছে নতুন সমস্যা–ব্যাংকঋণের সুদহার বৃদ্ধি ও শ্রমিক অসন্তোষ। সব মিলিয়ে চতুর্মুখী সংকটে পড়েছে দেশের উৎপাদন খাত। এতে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন, বাড়ছে বন্ধ কারখানার সংখ্যাও। শিল্পমালিকদের আশঙ্কা, এই সংকট দীর্ঘায়িত হলে তা রপ্তানি খাতে যেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তেমনি বাড়াবে বেকারত্বের হার।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার–উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) পত্রিকান্তরে বলেন, জ্বালানি সংকট, ব্যাংকঋণের সুদহার বৃদ্ধি, শ্রমিক অসন্তোষে কারখানা বন্ধ হওয়া এবং এনবিআর কর্তৃক এইচএস কোড জটিলতাসহ নানা কারণে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হলে তার প্রভাব অন্যান্য খাতেও পড়ে। বিশেষ করে সেবা খাত ও কৃষি খাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে। দেশের রপ্তানি আয়ের বেশির ভাগই আসে তৈরি পোশাক থেকে। সমপ্রতি শ্রমিক অসন্তোষ বেড়েছে খাতটিতে। গাজীপুর, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জসহ শিল্প–অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় কোনো না কোনো কারখানায় ঘটছে শ্রমিকদের বিক্ষোভ। শ্রমিক অসন্তোষে গত সোমবার পর্যন্ত পোশাক খাতের ৩৩–৩৫টি কারখানা বন্ধ ছিল বলে তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সূত্রে জানা যায়, চলতি মাসের শুরুতেও দেশে তৈরি পোশাক খাতে ১৬টি কারখানা বন্ধ বা ছুটি ঘোষণা করে উৎপাদন বন্ধ রেখেছিল। সর্বশেষ গত সোমবার পর্যন্ত এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩টিতে। এর মধ্যে ৩২টি কারখানাই গাজীপুর ও ময়মনসিংহ এলাকায় অবস্থিত।
পোশাক খাতে আন্দোলন চলতে থাকলে আরও অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে রপ্তানি আয়ে ধাক্কা লাগার আশঙ্কা করছেন শিল্পমালিকেরা। সর্বশেষ অক্টোবর মাসে ৪১৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যার ৮১ শতাংশ এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। মাসটিতে ৩২৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস জুলাই–অক্টোবরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান অবস্থা বিরাজ করলে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কষ্টকর হবে।
এদিকে অন্য এক খবরে বলা হয়েছে, শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা, বিদ্যুৎ–জ্বালানি সংকটসহ নানা কারণে দেশে বিনিয়োগ স্থবিরতা চলছে। এর ফলে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। আর তলানিতে এসে ঠেকেছে শিল্পোৎপাদন। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের যাত্রায় তরুণদের ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির চাহিদার মধ্যে নানামুখী সংকটে জর্জরিত উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলছেন, আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া এবং বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত না হওয়ায় নতুন বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে নীতি সুদহার বাড়ানোয় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যাংকঋণের সুদহারও। এতে নতুন বিনিয়োগ নিয়ে উদ্বেগে ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, অতিরিক্ত সুদের চাপে কমতে পারে বিনিয়োগ, কমবে কর্মসংস্থানও। চলমান অস্থিরতায় বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের বিক্রিতেও ধস নেমেছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, ভয়াবহ করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে মাজা সোজা করে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই আসে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের দামে উল্লম্ফনে উচ্চ মূল্যস্ফীতির বোঝা এখনো বয়ে চলেছে বাংলাদেশসহ অনেক দেশ। গত বছরের প্রথম দিকে যুদ্ধের প্রভাবে কাঁচামাল আমদানিতে সংকট দেখা দেয়।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, ‘কেউ বিনিয়োগ যখন করতে যায় একটি দেশে, তখন তিনি প্রথমেই নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেন। যখন কেউ নিরাপদ মনে করবেন না তখন কেন তিনি অর্থ বিনিয়োগ করবেন। অতি দ্রুত আমাদের আইন–শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত।’ মোট কথা, চতুর্মুখী সংকট থেকে দেশের উৎপাদন খাতকে রক্ষা করতে হবে।