উম্মাহর দুর্দিনে ওলামায়ে কেরামের করণীয়

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক

| শুক্রবার , ২৮ জুন, ২০২৪ at ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর উপর চরম দুর্দিন চলছে। বিশ্বে এখন দুটি যুদ্ধ চলমান। রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধের বয়স দু’বছর অতিক্রান্ত হয়েছে এবং তা বন্ধের কোন উদ্যোগ আন্তর্জাতিক মহল গ্রহণ করছে না। আর ফিলিস্তিনি মজলুম মুসলিমদের উপর ইসরায়েলের আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে। এ’ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৩৭ হাজার ছাড়িয়েছেযারা ইসরায়েলের বিমান হামলা কিংবা গোলার আঘাত কিংবা স্থল অভিযানে নিহত হয়েছেন। তারা দেশ মাতৃকা রক্ষার কারণে আল্লাহর কাছে শাহাদাতের মর্যাদা পাবেন। ৩৭ হাজারের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ১৫ হাজারের অধিক আর ১৭ হাজার শিশু অভিভাবকহীন অর্থাৎ তাদের পিতামাতা ইসরায়েলের বোমার আঘাতে শাহাদাত বরণ করেছেন। যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে ছেলে খেলা চলছে। স্থায়ী যুদ্ধবিরতি মানছে না ইসরায়েল। এদিকে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ছাড়া হামাসও অনড়। ফলে মধ্যস্থতাকারী কাতার ও মিশর পড়েছে বেকায়দায়। আর এদিকে সুকৌশলে কলকাঠি নাড়ছে বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্র। ফলে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা যেন ক্ষীণ হয়ে আসছে। এদিকে আরেকটি যুদ্ধের দামামা চলছে লেবানন ও ইসরায়েলের মধ্যে। সর্বোপরি মুসলিম উম্মাহ এখন চরম ক্রান্তিকাল পার করছে। এই দূরাবস্থা থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করার জন্যে ওলামাদের ভূমিকা সময়ের দাবি। তাদের ঐক্য, সমপ্রীতি, সহাবস্থান এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ ওলামারা হচ্ছেন পয়গম্বরদের উত্তরসুরি। সর্বশেষ নবী ও রাসূল (সাঃ) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নবুওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা নবুওয়াতের দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন চিরতরে। অতএব নবী ও রাসূল (সাঃ), সাহাবা, তাবেঈতাবেঈনদের পরে মুসলমি উম্মাহর উপর বড় দায়িত্ব রয়েছে আলেমওলামাদের কিন্তু আজ ওলামাদের অনৈক্যের কারণে সেই সম্ভাবনা যেন সুদূর পরাহত। ওলামারগণ মহান আল্লাহর কাছে অত্যন্ত মর্যাদার আসনে আসীন রয়েছেন। হযরত আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসূল (সাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি এমন পথে গমন করে, যাতে সে জ্ঞানার্জন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। আর ফিরিশতাবর্গ তালেবে ইলমের জন্য তার কাজে প্রসন্ন হয়ে নিজেদের ডানাগুলি বিছিয়ে দেন। অবশ্যই আলেম ব্যক্তির জন্য আকাশপৃথিবীর সকল বাসিন্দা এমনকি পানির মাছ পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। আবেদের উপর আলেমের ফযীলত ঠিক তেমনি, যেমন সমস্ত নক্ষত্রপুঞ্জের উপর পূর্ণিমার চাঁদের ফযীলত। উলামা সম্প্রদায় পয়গম্বরদের উত্তরাধিকারী। আর এ কথা সুনিশ্চিত যে, পয়গম্বরগণ কোন রৌপ্য বা স্বর্ণ মুদ্রার কাউকে উত্তারাধিকারী বানিয়ে যাননি; বরং তাঁরা ইলমের উত্তরাধিকারী বানিয়ে গেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা অর্জন করল, সে পর্যাপ্ত অংশ লাভ করল’। (আবু দাঊদ ৩৬৪৩, তিরমিযী ২৬৮২)। ওলামাদের এত মর্যাদা থাকার সত্ত্বেও তারা এক হতে পারছে না শুধুমাত্র নিজেদের বিবাদের কারণে, হীনম্মন্যতার কারণে, পারিপার্শ্বিকতার কারণে। তবে হক্কানি আলেমগণ কুরআনসুন্নাহ ভিত্তিক কথা বলতে কোন দ্বিধা করেন না। হক কথা বলতে ভয় পান না। আজ মসজিদের মিম্বর থেকে খতিবগণ হক কথা বলতে ভয় পান। কোরআন দিয়ে দলিল সহকারে কথা বলতে ভয় পান শুধুমাত্র নিজেদের চাকুরী হারানোর ভয়ে, সমাজে প্রতিষ্ঠা না পাওয়ার ভয়ে কিংবা রাষ্ট্রের রোষানলে পড়ার ভয়ে। কোরআনের সত্য কথাগুলো বলতে গেলেই আসবে বিপদ, কারাবরণ, নিপীড়ন, নির্যাতন। ঐক্যের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালার স্পষ্ট ঘোষণা, ‘তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রশি (কোরআন)-কে শক্ত করে আঁকড়ে ধর এবং কখনও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’সূরা আ’লে ইমরান১০৩। অন্য একটি আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা তাদের মত হয়ো না যাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও তারা বিভিন্ন দলেউপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং (নিজেদের মধ্যে) নানা মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে’সূরা আ’লে ইমরান১০৫। আলেমেআলেমে বিবাদের কারণে সমাজে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের বিকল্প একমাত্র আলেমদের ঐক্য। ঐক্য প্রচেষ্টা অনেক খ্যাতনামা আলেমে দ্বীনগণ করেছেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। মুসলিম উম্মাহর এই দুর্যোগের দিনে যেখানে আলেমদের ভূমিকা থাকার কথা ছিল আকাশচুম্বী, সেখানে আলেমগণ নিজেরাই বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে, বিবাদে বিবাদে আক্রান্ত হয়েছে গোটা আলেম সমাজ। ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতে শেষ নবী আমাদের রাসূল (সাঃ) এর আগমনের কথা লিপিবদ্ধ ছিল কিন্তু এই অভিশপ্ত জাতি যেটা প্রকাশ করত না, সেজন্য আল্লাহতায়ালা এই আয়াতটি নাযিল করেছেন, ‘মানুষের জন্য যেসব বিধান আমার কিতাবে বর্ণনা করে দিয়েছি, তারপর যারা আমার নাযিল করা সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ ও পরিষ্কার পথনির্দেশ গোপন করে, এরাই হচ্ছে সেই সব লোক যাদের উপর আল্লাহতায়ালা অভিশম্পাত করেন, অভিশম্পাত করে অন্যান্য অভিশাপকারীরাও’সূরা বাকারা১৫৯। অন্য একটি আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিঃসন্দেহে যারা আল্লাহর নাযিল করা কিতাবের অংশবিশেষ গোপন করে রাখে এবং সামান্য মূল্যে তা বিক্রি করে দেয়, তারাই হচ্ছে সে সব লোক যারা আগুন দিয়ে নিজেদের পেট ভর্তি করে, কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা তাদের সাথে কথা বলবেন না, তিনি তাদের পবিত্রও করবেন না, এদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ আযাব’সূরা বাকারা১৭৪। মসজিদের মিম্বর থেকে খতিবগণ সত্য কথা বলবেন কুরআনের রেফারেন্সসহ, হক কথা বলবেন, ন্যায়ের পক্ষে কথা বলবেন, এতে যদি খতিবগিরিও চলে যায় তবে তার জন্যে মহাপুরুষ্কার মহাপ্রতিপালকের কাছ থেকেই পাবেন কিন্তু আফসোস! হক কথা বলার মতন ইমাম খতিবের সংখ্যা এদেশে খুবই নগণ্য আর যারাই বলেছেন তারা হয়তো কেউ চাকুরী খুইয়েছেন অথবা কারারুদ্ধ হয়েছেন। আর এরাই হচ্ছে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় বান্দা। এ পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, এ পথ কন্টকাকীর্ণ। কাঁটাযুক্ত এই গিরিপথ পার হতে হলে অনেক প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হবে। জান্নাত পাওয়া এত সহয নয়, এটি পেতে হলে আল্লাহর বিধানগুলো কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। আর সেই জান্নাত প্রাপ্তির জন্য আল্লাহতায়ালার স্পষ্ট ঘোষণা, ‘তোমরা কি মনে করে নিয়েছো যে, তোমরা (এমনি এমনি) জান্নাতে প্রবেশ করবে? (অথচ) তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের (বিপদের) মত কিছুই তোমাদের কাছে এখনো আসেনি, তাদের উপর অভাব অভিযোগ ও রোগব্যাধি এসেছে, (কঠিন নিপীড়নে) তাদেরকে প্রকম্পিত করে দেওয়া হয়েছে, এমনকি স্বয়ং (আল্লাহর) নবী ও তাঁর সঙ্গী সাথীরা এই বলে (আর্তনাদ করে) উঠেছে, আল্লাহতায়ালার সাহায্য কবে (আসবে), আল্লাহতায়ালা (শান্তনা দিয়ে বললেন), হ্যাঁ অবশ্যই আল্লাহতায়ালার সাহায্য অতি নিকটে’সূরা বাকারা২১৪। ওলামাদের অনৈক্যের কারণে মুসলিম উম্মাহর উপর চরম দুঃসহ যন্ত্রণা চলছে। আলেমদের বিবাদের কারণে মুসলিম উম্মাহও দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বাংলার এই জমিনে শির্‌ক আর বেদআতের ছড়াছড়ি। পীরপূজা, মাজারপূজারে আসক্ত হয়ে পড়েছে অশিক্ষিত মুসলিম সমাজ। পীরের কাছে সন্তান মানত করে, সাহায্য চায় অথচ এসব কিছুর দেওয়ার মালিক স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে হক কথা বলা ওলামাদের। আমরা সেই সুন্দর একটি পরিচ্ছন্ন বিভেদমুক্ত ওলামাময় বাংলাদেশ চাই।

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধআগুনের শিখা জ্ঞানকে ধ্বংস করতে পারে না
পরবর্তী নিবন্ধরাউজানে আন্তঃস্কুল জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট সম্পন্ন