সবার ওপরে আসন যাঁর, তাঁর রূপের ঝলকে কেটেছে আঁধার, সবকিছুই সুন্দর তাঁর ; দরুদ তাঁকে ও তাঁর পরিবারে প্রতি। মহান আল্লাহতাআলা ভালোবেসে কুল মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন। ভালোবাসায় মানবতার মুক্তি নিহিত রেখেছেন। বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক হিসেবে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। তিনি পবিত্র কোরআনে বলেছেন (হে প্রিয় হাবিব) আপনি বলুন, তোমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও তবে আমাকে অনুসরণ করো তবেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দেবেন; আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে আল্লাহতাআলা উম্মতের প্রতি মায়া–মমতা ও প্রেম দিয়ে পাঠিয়েছেন। আল্লাহতাআলা বলেন, তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে একজন রাসুল এসেছেন যিনি তোমাদের বিপন্নতায় কষ্ট পান তিনি তোমাদের কল্যাণকামী মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও পরম দয়ালু। নবী করিম (সা.)-প্রত্যহ উম্মতের গুনাহের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমাপ্রার্থনা করতেন। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-বলেছেন রাসুল (সা.)-এর অন্তর প্রসন্ন দেখলে আমি বলতাম হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমার জন্য দোয়া করুন। তিনি বলতেন হে আল্লাহ! আপনি আয়েশার আগে ও পরের গোপন ও প্রকাশ্য গোনাহসমূহ ক্ষমা করুন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দোয়া শুনে হজরত আয়েশা (রা.)-হেসে মাথা নিচু করে ফেলতেন।
হজরত আয়েশার (রা.)-হাসিমাখা মুখ দেখে রাসুল (সা.)-বলতেন, আমার দোয়াতে কি তুমি আনন্দিত হয়েছ ? হজরত আয়েশা (রা.)-বলতেন হে আল্লাহর রাসুল! এটা কেমন কথা আপনার দোয়ায় আমি আনন্দিত হব না ? তখন রাসুল (সা.)-বলতেন আল্লাহর শপথ এভাবেই আমি প্রত্যেক নামাজের পর আমার উম্মতের জন্য দোয়া করি। সব মানুষ নবীজি (সা.)-এর উম্মত। তাই রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসাও ছিল নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য। যারা ঈমান আনতে পারেনি তাদের জন্য তিনি পেরেশান থাকতেন। আল্লাহতাআলা বলেন, ওই সব লোক ইমান আনছে না এ কারণে কি তাদের চিন্তায় ও পেরেশানিতে আপনি নিজেকে শেষ করে দেবেন? হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-গুনাহগার উম্মতের প্রতি বিশেষ স্নেহশীল ছিলেন। অনাগত উম্মতের প্রতি তাঁর তীব্র ভালোবাসা ছিল। হজরত আনাস (রা.)-থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেছেন, আমার ভাইদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ইচ্ছা করছে। সাহাবিরা বললেন, আমরা কি আপনার ভাই নই? রাসুল (সা.)-বললেন, তোমরা তো আমার সাহাবি তথা সঙ্গী। আমার ভাই হলো যারা আমার ওপর ইমান আনবে কিন্তু আমাকে দেখবে না। উম্মতের প্রতি নবীজি (সা.)-এর ভালোবাসার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত হলো উম্মতের পক্ষ থেকে তাঁর কোরবানি প্রদান। তিনি মুসলিম উম্মাহর পক্ষ থেকে নিজেই কোরবানি করতেন। হজরত আবু রাফে (রা.)-বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-কোরবানির সময় দুটি মোটাতাজা ও শিংবিশিষ্ট দুম্বা ক্রয় করতেন। উম্মতের প্রতি প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ছিল অতুলনীয় ভালোবাসা। উম্মতের প্রতি মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসার কথা বর্ণনা করে মহান আল্লাহ বলেন, তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে একজন রাসুল এসেছেন যিনি তোমাদের বিপন্নে কষ্ট পান তিনি তোমাদের কল্যাণকামী মুমিনদের প্রতি দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু। (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১২৮)। আল্লাহর পরে মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন প্রিয় নবীজি (সা.)-এবং আল্লাহর পরে মানুষের প্রতি সবচেয়ে বেশি দয়া করুণা ও অনুগ্রহ প্রিয় নবীজি (সা.)-এর। ভালোবাসার প্রতিদান ভালোবাসা অনুগ্রহের প্রতিদান অনুগ্রহ।
হাশরের ময়দানে যখন গোনাহগার উম্মত আশ্রয়হীন হয়ে আশ্রয় খুঁজতে থাকবে তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হবেন গোনাহগার উম্মতের শেষ আশ্রয়স্থল। গোনাহগার উম্মতদের উদ্ধারে সেদিন নবীজি এগিয়ে আসবেন। হজরত আনাস (রা.)-বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কেয়ামতের দিন আমার জন্য সুপারিশের আবেদন জানালাম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন হ্যাঁ আমি তোমার জন্য সুপারিশ করব। আমি বললাম হে আল্লাহর রাসুল! আমি সেদিন আপনাকে কোথায় খুঁজব। নবীজি বললেন প্রথমে পুলসিরাতের কাছে খুঁজবে। আমি বললাম সেখানে যদি আপনাকে না পাই তাহলে কোথায় খুঁজব? নবীজি বললেন, তাহলে আমাকে মিজানের কাছে খুঁজবে। আমি বললাম সেখানেও যদি আপনাকে না পাই ? নবীজি বললেন, তাহলে হাউজে কাউসারের কাছে খুঁজবে। কারণ আমি সেদিন এই তিন স্থানের কোনো না কোনো স্থানে থাকবই। সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ও হুকুম–আহকাম বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়া। কোরআন–সুন্নাহর উপর আমল করা। রাসুলের ভালোবাসা অর্জন করা। ভালোবাসা মানে আমি যাকে ভালোবাসি তার চিন্তা–চেতনা, ভালো–মন্দ, চাওয়া–পাওয়ার সাথে একাত্ম থাকা। আর হুজুর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর প্রতি ভালোবাসা মানে তার অনুসরণ করা। তিনি যা আদেশ দিয়েছন মেনে চলা। যে যাকে ভালোবাসে সে তার কথা বেশি চর্চা করে তাকে নিয়ে প্রশংসা করে। তেমনি দরুদ শরীফ হচ্ছে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম–এর প্রতি ভালোবাসার একটি পন্থা। যা মুমিনের অন্তরে ইশক, মহব্বতের বন্যা বাড়াতে থাকে।
নবী করিম হুজুর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন নবীগণের সর্দার। তেমনি তিনি মানবগণের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ও মহান। তিনি এমন একটি দ্বীন রেখে গেছেন যেই দ্বীন কোনও রকমের ভেদাভেদ করে না। এবং এমন সমাজ গড়ে তুলেছেন যার দ্বারা আমরা সর্বোচ্চ উঁচু স্থানে পৌঁঁছাতে পারি। কারণ তিনি সমাজ নির্মাণ করেছেন আল্লাহর তরফ থেকে পাওয়া ওহী দ্বারা। কিন্তু এই সমাজে তারাই উপকৃত হয়, যারা ঈমান এনে থাকে। কারণ নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দুনিয়াতে এসেছেন রহমত হয়ে। যেমন কোরআন পাকে ইরশাদ আছে : অর্থাৎ : হে নবী! আমি তোমাকে বিশ্ব জগতের জন্য কেবল রহমত করেই পাঠিয়েছি।
বিশ্বপ্রভু মহান আল্লাহতাআলা বিশ্বশান্তির জন্য মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে পৃথিবীতে পাঠালেন। বিশ্বজাহান আনন্দে গেয়ে উঠল ‘বালাগাল উলা বি কামা–লি হি, কাশাফাদ দুজা বি জামা–লি হি ; হাছুনাত জামিউ খিছ–লি হি, ছল্লু আলাইহি ওয়া আ–লি হি। সবার ওপরে আসন যাঁর, তাঁর রূপের ঝলকে কেটেছে আঁধার, সবকিছুই সুন্দর তাঁর ; দরুদ তাঁকে ও তাঁর পরিবার। নবী করিম (সা.)-এর জীবনের মূল শিক্ষা হলো কালিমা তাইয়েবা–লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহ ভিন্ন উপাস্য নেই মুহাম্মদ (সা.)-তাঁর প্রেরিত রাসুল। এ কালিমার গূঢ় অর্থ হাজারো প্রকারে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এর মধ্যে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ অথচ অতি সংক্ষিপ্ত ও অতি নিখুঁত বিশ্লেষণ হলো ঈমানে মুজমাল–বিশ্বপ্রভু আল্লাহর প্রতি আমি ঈমান আনলাম তাঁর সব আদেশাবলি মেনে নিলাম।
প্রিয় নবী (সা.)-সর্বদা চেষ্টা করতেন শরিয়তের বিধি–বিধানের কারণে যেন উম্মতের কোনো ধরনের দুঃখ–কষ্ট না হয়। এ জন্য তিনি অনেক কিছু উম্মতের জন্য সহজ করেছেন। মিরাজের রাতে ৫০ ওয়াক্ত সালাতকে মাত্র পাঁচ ওয়াক্ত করা হয়েছে। মিসওয়াকের অনেক মর্যাদা থাকলেও উম্মতের কষ্টের কথা বিবেচনা করে তা ফরজ করা হয়নি। সর্বাধিক ফজিলত থাকার পরও অনেক সময় তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি যেন তা উম্মতের ওপর ফরজ হয়ে না যায়। আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ আমল তিনি উম্মতের ওপর ফরজ হওয়ার আশঙ্কায় ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি সব সময় উম্মতের কষ্ট লাঘবে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর মমতাবোধ ও অনুকম্পার পূর্ণতা প্রকাশিত হবে কিয়ামতের দিন উম্মতের জন্য জান্নাতের সুপারিশ করার মাধ্যমে। আল্লাহতাআলা আমাদের সবাইকে প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের তাওফিক দান করুন। আল্লাহ সবাইকে নবীজি (সা.)-এর সত্যিকার উম্মত হওয়ার তাওফিক দিন, মুসলিম উম্মাহকে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ অনুসরণ ও অনুকরণ করে সঠিক আশেকে রাসুল হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।