উপেক্ষিত মানুষের জীবন ও উপেক্ষিত আইন। এ যেন উপেক্ষার এক স্বর্গ রাজ্যে বাস করেছি আমরা।মানুষের মূল্যবান জীবন থেকে শুরু করে উপেক্ষিত হয় সব কিছুই। কিন্তু উপেক্ষিত হয় না শুধু মহারাজাদের অবৈধ টাকা খাওয়ার বিষয়টা। সারি সারি গগনচুম্বী ভবন। সব গুলো যেন একেকটা টাইম বোমা। ভবন গুলোর তলায় তলায় নামিদামি রেস্তোরাঁ। আর তাদের চুলাগুলো একেকটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। রেস্তোরাঁ ভাড়ার এসব ভবন গুলোতে অগ্নিনিরাপত্তাও থাকেই না; বরং একেকটি যেন অগ্নিকুন্ড হয়ে উঠে যখন তখন। কারণ নিয়মনীতির উপেক্ষিত দেশে ভবনগুলো হলো একেকটি উপেক্ষার মিনার।এ যেন বারুদের স্তূপের ওপর বসে জীবনের উদযাপন। কবে কখন কার ভাগ্যে জুটে যায় চুলার লেলিহান শিখা। তা বলা মুশকিল। একেকটি আবাসিক ও অনাবাসিক গগনচুম্বী ভবনের প্রত্যেক মানুষ আছে মৃত্যুঝুঁকিতে। সামান্য একটি আগুনের ছটাতেই পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবন, স্বপ্ন, সংসার। আর ভবন মালিক, তদারকী সংস্থা, রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, ডিএমপি এবং রেস্তোরাঁ মালিকসহ কেউ কী এই মৃত্যুর দায় এড়াতে পারে?
সব ঘটনার মামলাতো দূরের কথা, সাধারণ ডায়েরি পর্যন্ত হয় না। এখানে উপেক্ষায় যেন আমজনতার নির্মম নিয়তি। অসংখ্য ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনায় মামলা হয়েছে সামান্য মাত্র। মামলা হলেও বিচারের রায় হয় না বললেই চলে।এসব অগ্নিকান্ডের ঘটনায় সাজা হওয়ার নজির নেই বললেই চলে। আগুনের লেলিহান শিখা যত দ্রুত মানুষকে পুড়িয়ে ছাই ভস্মকরে দেয়, এর বিপরীতে বিচারকাজ চলে অত্যন্ত ধীরগতিতে। অবশ্য বিচার বলে কিছু যদি থেকে থাকে। নির্বাসিত বিচারের দেশে; আমজনতার ভাগ্যে জুটে তদন্ত কমিটি নামক প্রহসনের নিদারুণ নাটক।এও তো ঘটে থাকে, সার্কাসের নির্মম ঘোড়ার মতো ছুটে চলা প্রতিটি ট্রেজিক মৃত্যুর প্রতিটি স্বজনের সাথে।
ব্যাথা বেদনা ও আর্তনাদের ছাই চাপা করুণ নিনাদে আকাশ–বাতাস ভারি করা আহাজারি প্রতিটি অশ্রু বিন্দুর সাথে রাজা–মহারাজাদের একি নির্মম খেলা। এ যেন মনে হয় নাটকের সং আর তার বিপরীতে বিবেকের গগন বিদারি আর্তনাদ। আহা! মানব জীবন। যার সিকি আদুলী মূল্য নেই। মানুষের জীবন এখানে উপেক্ষার নাটকে বন্দী।
একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অসংখ্য প্রাণহানি অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে বছরের পর বছর ধরে বিচার চলে। কিন্তু আসে না শেষ রজনীর রায়! এও মানুষের বিচার না পাওয়া ও উপেক্ষার করুণ উপখ্যান। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ৪৬ জনের নির্মম মৃত্যুর দায় নেওযার মত এখন আর কেউ নেই! যাদের গাফিলতির কারণে এরকম মর্মান্তিক মৃত্যু ও নির্মম হত্যাকান্ড সংঘটিত হলো, তারা আবারও ফন্দি আঁটছে কবে কোথায় কখন তাদের লোভের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারবে আরো নিরীহ জনগণকে। আমরা কেউ বলতে পারি না।আমরা এও বলতে পারি না, এই উপেক্ষার মৃত উপত্যকায়,রাষ্ট্রের কার কাছে গেলে
স্বজনহারাদের গগন বিদারি আতর্নাদের অবসান হবে! যদিও যারা গেছে তাঁদের ক্ষতি তো পূরণ হওয়ার নয়। কিন্তু বিচারহীনতার জন্মান্ধ রাষ্ট্রে এর প্রতিকারও চাইবো কার কাছে?
বিশিষ্ট লেখক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন ১৯৭৪ সালে “স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই” নামে একটি বই লিখেছিলেন। ঐ বইটিতে তিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে প্রতিটি জনগণের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চেয়েছিলেন। কিন্তু বইটি লেখার ৫০ বছর পরেও আমাদের এই স্বাধীন রাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য শোক বহন করতে হচ্ছে। প্রতিবাদ করতে হচ্ছে। যদিও প্রিয় কবি নাজিম হিকমতের লেখা কবিতা “জেল খানার চিঠি”–এর মতো বলতে হয়, বিংশ শতাব্দীতে খুবই বেশি হলে, এক বছর মানুষের শোকের আয়ু..। হ্যাঁ, বিংশ শতাব্দীতে কেন? তাঁর কাব্যে এই শোকের কথাতো একবিংশ শতাব্দীতেও নিরেট সত্য। আরেকটি নতুন ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে, তার নীচে চাপা পড়ে যাবে এই করুণ দগ্ধ হয়ে জীবন্ত লাশগুলোর মুখচ্ছবি এবং হারিয়ে যাবে তাদের স্বজনদের বিচার চাওয়ার আর্তনাদের তীব্রতা। খুঁজে দেখলে হয়তো মিলবে, স্বজন হারানোর ব্যথায় কাঁদছে কত শত নিকটজনের প্রাণ। হয়তো ওই কান্নার শব্দ এই রাষ্ট্র যন্ত্রের বিচারলয়গুলোর দেয়াল পর্যন্ত পোঁছবে না। একি নির্দয় রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার ব্যবস্থা। হয়তো তাই এই উপেক্ষা ও বিচারহীনতার করুণ দৃশ্য দেখে বহুকাল আগে কবিগুরু তাঁর ‘প্রশ্ন’কবিতায় বলে গিয়েছিলেন, “আমি যে দেখেছি, প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। আমি যে দেখিনু তরুণ বালক উম্মাদ হয়ে ছুটে। কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে..”। বেইলি রোডে আগ্নিকাণ্ডে মৃত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই একেবারেই তরুণ। এর আগে নিমতলী, হাশেম ফুড, চুডিহাট্টা ও বনানীর চিত্রও একই রকম। কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঠিক নেই। অথচ সকল সংস্থা আছে বহালতবিয়তে। জনগণের করের টাকায় বেতন ঢুকছে তাদের সেলারি একাউন্টে। আগুন ধরার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত, কিন্তু নেভানোর ব্যবস্থা বড্ড ভঙ্গুর। রেস্তোরাঁয় ঢোকার রাস্তা বড্ড আলোঝলমলে ও জাঁকজমকপূর্ণ কিন্তু বিপদ হলে বের হওয়ার রাস্তা বড্ড সংকীর্ণ। খোলা জায়গা নেই, পানির ব্যবস্থা নেই। এগুলো ছাড়াই তালি পেতে পেতে ঝকঝকে উন্নয়নের গগনচুম্বি দরদালানগুলো উঠছে তো উঠছে ঢাকার বুকে চিরে। কিন্তু উঠে না শুধু মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার সুরক্ষা দেয়ালগুলো। এসব গগনচুম্বি দালানগুলো অনুমোদনও পায় তাড়াতাড়ি, কাগজে–কলমে তদারকি, কেনা যায় সবই। একের পর এক তাই এসব জানা দুর্ঘটনায় মানুষ মরতে থাকে। আর লাশ গুনতে গুনতে আমরা শুনি সরকারের তদন্ত কমিটি ও কয়েকটা পয়সা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার খবর। মানুষের জীবন ও বাবার কাঁধে মেয়ে লাশের বা ছেলের লাশ অথবা স্বামীর কাছে তাঁর প্রিয়তমার লাশের মূল্য তখন সামান্য কটা টাকা মাত্র। অকালমৃত্যুর বা খুনের সঙ্গে সঙ্গে এসব তামাশারও কোনো বিরতি নেই।
খোদ রাজধানীর বুকে ১০/১৫ তলা ভবনে ৩০/৩৫টি অননুমোদিত রেস্টুরেন্ট গড়ে তুলে অগ্নিকাণ্ড তৈরির মস্ত শক্তির উৎস আসলে কোথায়? কারা এসব ভবনের মালিক? আইন অনুযায়ী একটি ভবনে কয়টি রেস্টুরেন্ট থাকতে পারে, এ নিয়ে সিটি কর্পোরেশন বা রাজউকের তদারকির কী অবস্থা? রাজধানী সহ দেশের সব প্রধান শহরের সারি সারি ভবনে একের পর এক খাওয়ার দোকান। রীতিমতো বাতি জ্বালিয়ে খুঁজলেও এসব সড়কের বহুতল ভবনের কোনো একটিতে বইয়ের দোকান বা গ্রন্থাগার খুঁজে পাওয়া কঠিন। সন্ধ্যায় এসব রাস্তা দেখলে মনে হয়, খাওয়া ছাড়া এই দেশের মানুষের আর কোনো বিনোদন নেই। এত ঝাঁ চকচকে উজ্জ্বল বাতির সব রেস্টুরেন্ট; সারাদেশের মুখ ঢাকা–শহর জাতির মেধা শূন্যতার প্রতিচ্ছবি।
লাগামহীন বিচারহীনতার ফিরিস্তি দিলে এই লেখা বেশ বড় হয়ে যাবে। গত ১৪ বছরে দেশে বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোর মধ্যে ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ১২৪ জন, ২০১২ সালে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনে ১১৭ জন, ২০১৬ সালে টঙ্গীতে ট্যাম্পকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায় ৩১ জন, ২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ৭১ জন, ওই বছর বনানীর এফআর টাওয়ারে ২৬ জন এবং কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় প্রাইম প্লাস্টিক কারখানায় ১৭ জন নিহত হন। ২০২১ সালে নারায়নগঞ্জের হাশেম ফুড কারখানায় ৫৪ জন, এবং একই বছর রাজধানীর মগবাজারে একটি দোকানে বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্ট আগুনে ১২ জন নিহত, ২০২২ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বি এম ডিপোর আগুনে ৫১ জন ব্যক্তি নিহত হন। গত বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ভয়াবহ চারিটি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এতেও আরো অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে। লাশ হয়ে দগ্ধ হয়েছে। পুরো বছরে ১৩ টি ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় শাস্তি হয়নি কারও। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অগ্নি–ট্র্যাজেডি হিসেবে চিহ্নিত নিমতলীর ঘটনায় কোনো মামলাই হয়নি। দুয়েকটি ঘটনায় বিচার কার্যক্রম শুরু হলেও সহসা নিষ্পত্তির কোনো লক্ষণ নেই। সাধারণ ডায়েরিতে বন্দি নমতলি ট্র্যাজেডি। ৪ বছরেও শেষ হয়নি চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের বিচারকাজ। হাশেম ফুডে অগ্নিকাণ্ডে ৫৪ জনের মৃত্যুর তদন্ত কাজই শুরু হয়নি গত প্রায় তিন বছরে (দৈনিক খবরের কাগজ,৩ মার্চ’২৪)। এই যে এত এত উপেক্ষার মহাকাব্য রচিত হচ্ছে। তাতে কি বলা যায় সুশাসন ও নিয়মনীতি বলে কিছু আছে; আমাদের এই উন্নয়নের মহা সড়কের স্মার্ট রাষ্ট্রে?
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।












