লোহাগাড়ায় মুজিব শতবর্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের উপহার দেওয়া বেশিরভাগ ঘরেই ঝুলছে তালা। বরাদ্দ পেয়ে অনেকেই থাকছেন না ঘরগুলোতে। তাদের অন্যত্র ঘর থাকায় এগুলোতে ঝুলছে তালা।
অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক বিবেচনায় ঘরগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যার ফলে বেশির ভাগ সুবিধাভোগী বরাদ্দ পাওয়ার পরও সেখানে থাকছেন না। তাদের কেউ কেউ ঘর বিক্রি করে দিয়েছেন, কেউবা ভাড়া দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনেকে ঘরে লাকড়ি ও খড়কুটোর গাদা করে রেখেছেন। সন্ধ্যার পর ফাঁকা ঘরগুলো অপরাধীদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে লোহাগাড়া উপজেলায় ৩ দফায় ৯ স্থানে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে ৩৮৪টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে পদুয়া ধলিবিলা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ১১৮টি, চরম্বা মাইজবিলা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২৭টি, পুটিবিলা জি এম সিকদার পাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৩৪টি, পুটিবিলা পহরচাঁন্দা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২৫টি, চুনতি চাঁন্দা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৮৭টি, চুনতি সুফিনগর আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৬টি, আধুনগর কুলপাগলী আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২৯টি, আধুনগর রশিদারঘোনা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২৮টি ও বড়হাতিয়া চাকফিরানী আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৩০টি।
প্রতিটি ঘরের জন্য গড় বরাদ্দ ছিল ২ লাখ টাকা করে। দুই শতাংশ খাস জমিতে দুই কক্ষের আধা পাকা একক গৃহনির্মাণ প্রকল্পের আওতায় এই ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে।
সরেজমিনে একাধিক আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের অধিকাংশ ঘরে ঝুলছে তালা। অনেক ঘরের সামনে ঝোপঝাড়ে পরিণত হয়েছে। ঘরের বারান্দায় রাখা হয়েছে খড়কুটোর গাদা। অনেক ঘরের সামনে গরু বেঁধে রাখতেও দেখা গেছে। ব্যবহার না হওয়ায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ঘর তৈরির মালামাল। ঘর বরাদ্দ পাওয়ার পর একদিনের জন্য দেখতে আসেননি এমন উপকারভোগীও আছেন। অনেকে ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন, তবে থাকেন অন্যজন। উপজেলার বাইরের লোককেও আশ্রয়ণ প্রকল্পে অন্যের বরাদ্দ পাওয়া ঘরে বসবাস করতে দেখা গেছে। অনেক উপকারভোগী মাঝে মধ্যে এসে ঘরে কিছুক্ষণ অবস্থান করে পুণরায় চলে যান এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপকাভোগীর নাম গোপন রাখতে বরাদ্দ পাওয়া অনেক ঘরের নামফলকও তুলে ফেলা হয়েছে। বিল পরিশোধ না করায় তালাবদ্ধ ঘরগুলোর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে।
আধুনগর কুলপাগলি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা ইয়াছমিন আক্তার জানান, ওই স্থানে মোট ১৩টি ঘর রয়েছে। এরমধ্যে ৬টি ঘর তালাবদ্ধ থাকে। তাদের ভিটাবাড়ি আছে, তাই আশ্রয়ণ প্রকল্পে বরাদ্দ পাওয়া ঘরে থাকেন না। কয়েকজন মাঝে মধ্যে এসে পরিস্কার করে চলে যান। মানুষ না থাকায় তালাবদ্ধ ঘরগুলো অযত্ন অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
একই আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা মো. আরফাত জানান, ওই স্থানে ১৬টি ঘরের মধ্যে ৯টি তালাবদ্ধ থাকে। প্রায় ৪ মাস আগে তিনি আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরে স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করছেন। তালাবদ্ধ থাকা ঘরের উপকারভোগীদের কখনো দেখেননি তিনি।
একই এলাকায় গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা শাহিন আক্তার ও মমতাজ বেগম জানান, প্রায় ২৫ বছর আগে সরকার ৬০টি টিনের ঘর করে দিয়েছিলেন। তাদের প্রতিটি ঘরেই মানুষ থাকে। বর্তমানে ওইসব ঘর জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলেই নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। তাদের পাশেই প্রধানমন্ত্রীর উপহারের পাকা ঘর রয়েছে। অথচ অনেকে বরাদ্দ পাওয়া ঘরে থাকছেন না। সবময় তালাবদ্ধ থাকে। আর যারা বসবাস করেন সিংহভাগই অন্যের বরাদ্দ পাওয়া ঘরে থাকেন। অনেকে উপহারের ঘর বিক্রি করে দিয়েছেন। আবার অনেকে ভাড়া দিয়েছেন। যেসব উপহারের ঘর তালাবদ্ধ থাকে, সেগুলো যেন গুচ্ছগ্রামে জরাজীর্ণ ঘরে থাকা বাসিন্দাদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয় তার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা।
স্থানীয় রিয়াদ হোসেন শাকিল জানান, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের সিংহভাগ ঘরে বরাদ্দ পাওয়া উপকারভোগীরা থাকেন না। যাদের ঘরের প্রয়োজন নেই তারাই এসব ঘর বরাদ্দ নিয়েছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাদের কাছের লোকদের এসব ঘর দিয়েছেন। তাই সিংহভাগ ঘর তালাবদ্ধ থাকছে বলে অভিযোগ তার। প্রশাসনের কাউকে কোনোদিন আশ্রয়ণ প্রকল্পে এসব ঘর তদারকি করতেও দেখেননি। বরাদ্দ পাওয়া যেসব ঘরে প্রকৃত মালিকরা থাকেন না, সেগুলো ফেরত নিয়ে প্রকৃত ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে বণ্টন করার দাবি জানান।
পুটিবিলা পহরচান্দা আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা সামশুল ইসলাম জানান, ওই স্থানে ২৫টি ঘরের মধ্যে ২৪টি তালাবদ্ধ। তিনি প্রায় ৩ বছর যাবত এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরে থাকছেন। তবে ওই ঘরটি তার নামে বরাদ্দ নয়। তালাবদ্ধ ঘরগুলোতে একদিনের জন্যও বরাদ্দ পাওয়া কোনো উপকারভোগী আসেননি বলে জানান তিনি। আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকা রাতে ভুঁতুড়ে পরিবেশে পরিণত হয়। মাদকসেবনকারীদের আনাগোনা দেখা যায়। আশ্রয়ণ প্রকল্পে পরিবার নিয়ে একা বসবাস করায় সব সময় আতংকের মধ্যে থাকতে হয়।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. মাহবুব আলম শাওন জানান, বরাদ্দ দেয়া ঘরের উপকারভোগীদের তালিকা তদারকি করে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা দিয়েছেন। তাদের দেয়া তালিকার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরগুলো বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ ইনামুল হাছান জানান, ইতোমধ্যে উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর বরাদ্দ পাওয়ার পরও যারা থাকছেন তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে পুণরায় তালিকা তৈরি করে রেজুলেশন সহকারে জেলা টাস্কফোর্স কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে। কমিটি যেভাবে সিদ্ধান্ত দেয়, সেভাবে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যে উপকারভোগীদের বরাদ্দ পাওয়া ঘরের জায়গার খতিয়ানসহ দলিল করে দেয়া হয়েছে। এসব বাতিল করা একটু সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলোতে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হবে। জেলা প্রশাসক মহোদয় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। আমরাও চেষ্টা করছি আশ্রয়ণ প্রকল্প যাতে প্রাণবন্ত হয়।