উপযুক্ত পরিবেশ পেলে আমাদের মেধাবী তরুণরা বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ২৫ মার্চ, ২০২৫ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

মাঝে মধ্যে কিছু খবর দেখলে গর্বে বুকটা ভরে উঠে। তেমনই একটি খবর হলো ওয়াল্ডওয়াইড ফেরি সেফটি এসোসিয়েশনের প্রতিযোগিতায় বুয়েটের চ্যাম্পিয়ন হওয়া। প্রতিযোগিতায় ২০২১ সাল থেকে নিয়মিত অংশ নিলেও এবারই প্রথম চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীদের একটি দল। ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফেরি সেফটি অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিওএফএসএ) একটি মার্কিন সংস্থা। প্রতিবছর তারা একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, যেখানে শিক্ষার্থীদের একটি নির্দিষ্ট পথে (রুট) চলাচল উপযোগী ফেরির মৌলিক নকশা করতে হয়, সঙ্গে থাকে কিছু শর্ত। যেমন একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক যাত্রী সাথে বাসট্রাক বা অন্য কোনো পণ্য পরিবহন করার সক্ষমতা। ফেরিটি সম্পূর্ণ বিদ্যুৎচালিত হতে হবে। দলের সদস্যরা হলেন নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের মো. সাফায়েত হোসেন, মো. আবদুল কাদের, আবু রাসেল, মাহমুদুল হাসান, আফিফ বিন হাবিব, মো. আতিকুর রহমান ও মো. কাউসার মাহমুদ। তত্ত্বাবধানে ছিলেন বিভাগের অধ্যাপক জোবায়ের ইবনে আওয়াল।

ডব্লিওএফএসএ ডিজাইন প্রতিযোগিতাটি অনলাইননির্ভর। ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে প্রতিযোগিতার ১২তম আসর অনুষ্ঠিত হয়। এশিয়া, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নেন। যাবতীয় হিসাবনিকাশ, আঁকিবুঁকি ও ত্রিমাত্রিক নকশা মিলিয়ে ১৮ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে হয় প্রতিযোগীদের। ৭ ফেব্রুয়ারি২৫ আসে এর ফলাফল চ্যাম্পিয়ন বুয়েটের শিক্ষার্থীদের ‘টিম ব্ল্যাক পার্ল’। পুরস্কার হিসেবে তাঁরা জিতেছে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার (প্রায় ছয় লাখ টাকা)

দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর এমন সাফল্য এলো বলেই হয়তো একটু বেশি খুশি। তারা বলেন,‘বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশ ও বুয়েটের জন্য গৌরবের। তারা আরো বলেন, ‘গত তিন আসরে আমাদের দল দ্বিতীয় হয়েছে, তৃতীয় হয়েছে, অনারেবল মেনশনও পেয়েছে। আমরা আসলে একটু একটু করে এগিয়েছি। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে গত আসরের অভিজ্ঞতাগুলোই কাজে লেগেছে।

এদিকে ৪৬ ফেব্রুয়ারি ২৫ গ্লোবাল স্টুডেন্ট রিসার্চ কনফারেন্স নামে একটি বৈশ্বিক সম্মেলনের আসর বসেছিল সৌদি আরবের কিং ফাহাদ ইউনিভার্সিটি অব পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মিনারেলসে। প্রথমবারের মতো আয়োজিত এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে অংশ নেয় চারজন শিক্ষার্থী। এতে নটরডেম কলেজ থেকে দুইজন, সেন্ট জোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে একজন এবং একাডেমিয়া ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের একজন। সবাই একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাদের গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন।

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, গণিত এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবন ও পারস্পরিক সহযোগিতার মানসিকতাকে উদ্বুদ্ধ করাই এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য। ২৫টি দেশের প্রায় দেড় হাজার গবেষণা থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে নির্বাচিত হয় ৩০০টি গবেষণা। সেখান থেকে ৬টি বিভাগে দেওয়া হয় ৬টি পুরস্কার। এর মধ্যে স্মার্ট সিস্টেমস, রোবোটিকস, অটোমেশন ও এআই খাতে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয় এই তরুণ দলটির গবেষণা। গত বছর এই দলটি অংশ নিয়েছিলো সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অলিম্পিয়াডে। তখন তারা বাংলাদেশের জন্য এনেছিলো দুটি রৌপ্য ও দুটি ব্রোঞ্জপদক। সেবারই তারা উপলব্ধি করে, বাংলা ভাষায় এআই ও ডেটা সায়েন্স শেখার যথাযথ সম্বল তাদের হাতে নেই। তাই এই বিষয়ক ধারণাগুলো সহজ করে তুলে ধরতে পারবে, এমন একটি প্ল্যাটফর্মের চাহিদার কথা তারা টের পাচ্ছিলো। সেই ভাবনা থেকেই জন্ম হয় তাদের এই উদ্যোগ ইনসিগনিয়ার (ইনসিগনিয়া স্কুল)। এআই ও ডেটা সায়েন্সের কাঠখোট্টা গাণিতিক হিসাবগুলোকে সহজ সরল ভাষায়, গল্পে গল্পে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরাই তাদের লক্ষ্য।

পুরস্কার হিসেবে দলটি পেয়েছে ৬ হাজার সৌদি রিয়াল (প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা)। ৯ মাস ধরে তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে মত বিনিময়ের পর শেষ হয় প্রাথমিক গবেষণাপত্র লেখার কাজ। কিন্তু গবেষণা উপস্থাপনের জন্য উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের জন্য কোনো সম্মেলনের খোঁজ পাচ্ছিলো না। তাই তারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সম্মেলনে আবেদন করে ও বিভিন্ন আয়োজকের ইমেইলে যোগাযোগ করে। শেষ পর্যন্ত সাড়া আসে গ্লোবাল স্টুডেন্ট রিসার্চ কনফারেন্স থেকে।

আসলে এই পুরস্কার প্রাপ্তি প্রমাণ করে, কোনো কাজের প্রতি আগ্রহ থাকলে এবং সে অনুযায়ী পরিশ্রম করলে স্বীকৃতি মিলবেই। তাদের তত্ত্বাবধায়ক বলেন, দলটি বিভিন্ন সময় আমার কাছে এসে অনুরোধ করত কাজ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতে। সেটি ঢাকার হাসপাতাল হোক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি। একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী হিসেবে তারা কতটুকু অগ্রসর হতে পারবে, তা নিয়ে আমারও সন্দেহ ছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট বিরতিতে ওরা যখন কাজের অগ্রগতি দেখাত, তখন বুঝতে বাকি থাকত না, উপযুক্ত নির্দেশনা পেলে তারা অনেক দূর যাবে। সম্মেলনে ওদের উপস্থাপনা শেষে আয়োজক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী ডিন অবাক হয়ে বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ যে এসব ক্ষেত্রে এত দূর এগিয়ে গেছে, এটা আমাদের কল্পনায়ও ছিল না। এ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা কীভাবে এত দারুণ কাজ করে!’ মজার ব্যাপার হলো, আমাদের কাজ দেখে আয়োজকেরা এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে ‘হাইস্কুল’ পর্যায়ের একমাত্র দল হিসেবে আমাদের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করেন তাঁরা। জানতাম, আমরাই এ আয়োজনের ‘সবচেয়ে ছোটদের দল’, তাই কোনো ধরনের স্বীকৃতির প্রত্যাশা করিনি। শুধু নিজেদের সেরাটা দিতে চেষ্টা করেছি। আমরা এমন একটি প্রণিধানযোগ্য ক্যাপ তৈরির সমাধান দিয়েছি, যা মৃগী রোগীদের খিঁচুনি শুরু হওয়ার আগেই পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হবে। আমাদের ব্যবহৃত পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ মৌলিক, যা সামান্য পরিবর্তনও ধরতে সক্ষম। আমাদের বিশ্বাস, এই উদ্ভাবন মস্তিষ্কের সংকেত প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।

সম্ভবত এর গুরুত্ব অনুধাবন করেই স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন, কাইস্টের শিক্ষার্থীগবেষকদের ছাড়িয়ে আমাদের গবেষণাপত্রটি একটি বিভাগে ‘সেরা গবেষণা পত্রের’ স্বীকৃতি জিতে নেয়।

আমরা প্রায় হতাশা ব্যক্ত করি, আমাদের সন্তানেরা ঠিকমত লেখাপড়া করে না। সারাদিন কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আসলে আমরা তাদেরকে বুঝার চেষ্টা করি না। আমরা চাই আমাদের মত করে তারা চলুক ও এগিয়ে যাক। কিন্তু তারা বর্তমান তথ্য প্রযুক্তি যুগের সন্তান। তারা চায় তাদের মত চলতে ও এগিয়ে যেতে। তারা যেটার পিছনে লাগে সর্বশক্তি দিয়ে তা করে ছাড়ে। তাদের আছে কাজের প্রতি একগুঁয়েমি, দৃঢ কমিটমেন্ট ও জেদ। আর এটিই তাদেরকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। তারা পারে জীবন বাজি রেখে সমাজ পরিবর্তন করতে। আর এর প্রমাণ তারা রেখেছে ৫ই অগাস্ট সরকারের পতনের মাধ্যমে। আসলে শিক্ষার্থীদের এই গবেষণাগুলো প্রমাণ করে, সঠিক পরিবেশ পেলে আমাদের মেধাবী তরুণরা বাস্তব সমস্যা সমাধানে বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের শিক্ষার্থীরা যে তাদের শিক্ষাজীবনের শুরুতেই এমন চমকপ্রদ উদ্ভাবনের সাক্ষর রাখলো এটি সত্যিই দেশ জাতি ও আমাদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক ও গর্বের।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহালদার তীর থেকে রাজশাহীর মোহনপুর
পরবর্তী নিবন্ধবেকার সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা