উপদেষ্টা পরিষদে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৫ জন

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ৯ আগস্ট, ২০২৪ at ৫:৪৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের সন্তান নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন বৃহত্তর চট্টগ্রামের আরো ৫ জন। তারা হচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডো ফারুক ই আজম বীর প্রতীক, লেখক ও গবেষক ফরিদা আকতার, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরজাহান বেগম, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক নায়েবে আমীর আ ফ ম খালিদ হাসান এবং খাগড়াছড়ির সন্তান সাবেক রাষ্ট্রদূত সুপ্রদীপ চাকমা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক : হাটহাজারীর ফরহাদাবাদের সন্তান, ইউনূস সুহৃদএর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌ কমান্ডো ফারুক ই আজম বীর প্রতীক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। তবে দেশের বাইরে থাকায় গতরাতে তিনি শপথ নিতে পারেন নি। দেশে ফেরার পর তিনি শপথ নেবেন বলে জানা গেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র সমন্বিত যুদ্ধাভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপট’ এর অভিযানিক দলের উপঅধিনায়ক ফারুক ই আজম দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামে ব্যবসা বাণিজ্য করে আসছিলেন।

একজন প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ফারুক ই আজম প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূসের সামাজিক ব্যবসাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথেও জড়িত। ১৯৭১ সালে তিনি খুলনায় ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে বহু প্রতিকূলতা এবং ঝুঁকি মোকাবেলা করে তিনি চট্টগ্রামে পৌঁছান। মে মাসে তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের হরিণা ইয়ুথ ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। ওই সময় তিনি নৌবাহিনীর জন্য মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সিলেক্ট হন। পরবর্তীতে পলাশিতে দুই মাসের ট্রেনিং সম্পন্ন করেন। ওই সময় চট্টগ্রাম বন্দরে অভিযানের জন্য ৬০ সদস্যের একটি দল নির্বাচন করা হয়েছিল। কিন্তু এদের মধ্যে ২৩ জন চট্টগ্রামে এসে পৌঁছাতে পারেননি। বাকি দুইটি দলের ৩৭ জন সদস্য চট্টগ্রাম বন্দরে অভিযান পরিচালনা করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের গতি পরিবর্তন করে দেয়া এই অপারেশনের অধিনায়ক ছিলেন এ ডব্লিউ চৌধুরী। উপ অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সদ্য এইচএসসি পাশ করা তরুণ ফারুক ই আজম। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে জীবনবাজী নিয়ে দুঃসাহসি অভিযান পরিচালনা করে তিনি বীর প্রতীক হিসেবে পদক পান। হাটহাজারীর ফরহাদাবাদের মরহুম মনির আহমদ চৌধুরী এবং জান্নাতুল ফেরদৌসের পুত্র ফারুক ই আজম বীর প্রতীক নগরীর মেহেদিবাগ এলাকায় বসবাস করেন। তাঁর স্ত্রী শামিম আরা বেগম ‘রমনীয়া’ কর্ণধার। তাদের চার কন্যা রয়েছেন।

অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হাসান : প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে চট্টগ্রামের অপর উপদেষ্টা হচ্ছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক নায়েবে আমীর অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হাসান। আবুল ফয়েজ মুহাম্মদ (আ ফ ম) খালিদ হাসানের বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার মাদার্শায়। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং ইসলামী পন্ডিত খালিদ হাসান ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে বিএ (অনার্স) ও ১৯৮৩ সালে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ নিয়ে ‘হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর খুতবা : একটি সামাজিকসাংস্কৃতিক গবেষণা ’ বিষয়ের উপর পিএইচডি সম্পন্ন করেন।

১৯৮৭ সালে তিনি সাতকানিয়া আলিয়া মাহমুদুল উলুম ফাযিল মাদ্রাসায় আরবি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূচনা। ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম ওমরগণি এমইএস কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। ২০০৭ সাল থেকে আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ার ধর্মীয় ও সাহিত্য বিষয়ক মুখপত্র মাসিক আত তাওহীদের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে আছেন। এছাড়া তিনি হালিশহর এব্লক হজরত উসমান (রা.) জামে মসজিদের খতিব, আল জামিয়াতুল আরবিয়াতুল ইসলামিয়া জিরির মুহাদ্দিস হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আ ফ ম খালিদ হাসান একজন সুন্নী দেওবন্দি ইসলামি পন্ডিত হিসেবে বেশ সুপরিচিত। তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক নায়েবে আমীর ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শিক্ষা উপদেষ্টা। একই সঙ্গে মাসিক আত তাওহীদের সম্পাদক, বালাগুশ শরকের সহকারী সম্পাদক এবং আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের কুরআনিক সায়েন্সেস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অতিথি শিক্ষক। ১৯৫৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সাতকানিয়ার মাদার্শা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণকারী খালিদ হাসানের পিতা মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহও একজন ইসলামি পন্ডিত ছিলেন। নগরীর খুলশীস্থ নাসিরাবাদ প্রোপাটির্জে বসবাসকারী ড. খালিদ হাসাইন ব্যক্তিগত জীবনে তিন পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর দুই সন্তান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

নুরজাহান বেগম : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন হাটহাজারীর কুয়াইশ বুডিশ্চরের সন্তান, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরজাহান বেগম। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম শুরুর সূচনাকাল থেকে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে তিনি গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

১৯৭৬ সাল থেকে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম সারির সহযোগী হিসেবে থাকা নুরজাহান বেগম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। গ্রামীণ ব্যাংকের তৃণমূল গোষ্ঠীতে দরিদ্র গ্রামীণ মহিলাদের সংগঠিত ও প্রশিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ব্যাংকের শুরুর দিকে এবং সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দিনে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের প্রথম প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পৃথিবীর বহুদেশে মাইক্রোক্রেডিট প্রোগ্রামের পরামর্শদাতা, প্রশিক্ষক এবং মূল্যায়নকারী হিসেবেও কাজ করেছেন। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, সম্মেলন এবং সেমিনারে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বক্তৃতা করেছেন। তিনি গ্রামীণ ফাউন্ডেশন, ইউএসএসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার বোর্ডে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। উল্লেখ্য, তিনি প্রখ্যাত নাট্যকার সেলিম আল দ্বীন এর বোন।

ফরিদা আখতার : চন্দনাইশের হারলা গ্রামে জন্মগ্রহণকারী লেখক ও গবেষক ফরিদা আখতার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদষ্টো হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ফরিদা আখতার বহু বছর ধরে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের অবস্থা জানা এবং পরিবর্তনের জন্য নীতিনির্ধারণী গবেষণা ও লেখালেখি করে আসছেন। নারী উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্য সম্পদ, তাঁত শিল্প, গার্মেন্টস শিল্প ও শ্রমিক, জনসংখ্যা এবং উন্নয়নমূলক বিষয়ে তিনি গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে নিবিড়ভাবে কাজ করছেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নামে পরিচালিত কার্যক্রমের মারাত্মক কুফল ও নারী স্বাস্থ্যের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে লেখালেখি এবং প্রতিকার আন্দোলের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে সুপরিচিত ফরিদা আখতার। তিনি বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে নারী ও গাছ, কৈজুরী গ্রামের নারী ও গাছের কথা। চট্টগ্রামের সন্তান হলেও তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় বসবাস করেন।

চন্দনাইশ পৌরসভার মেয়র মু. মাহাবুবুল আলম খোকা জানান, ফরিদা আখতার একজন লেখক, গবেষক ও আন্দোলনকর্মী। তিনি বর্তমানে উবিনীগ (উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারনী গবেষণা) নামক একটি এনজিও সংস্থার পরিচালক। তিনি গ্রামে থাকেন না। তিনি খুবই সম্‌ভ্রান্ত পরিবারের একজন মেয়ে।

সুপ্রদীপ চাকমা : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে দুই বছরের জন্য সচিব পদমর্যাদায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে সুপ্রদীপ চাকমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যা আগামী বছর জুলাইয়ে শেষ হওয়ার কথা ছিল। সুপ্রদীপ চাকমার জন্ম ১৯৬১ সালে খাগড়াছড়ির কমলছড়িতে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তিনি সপ্তম বিসিএসে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। মেঙিকো ও ভিয়েতনামে রাষ্ট্রদূত ছিলেন সুপ্রদীপ চাকমা। এছাড়া রাবাত, ব্রাসেলস, আঙ্কারা এবং কলম্বোতে বাংলাদেশ মিশনেও তিনি বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধড. ইউনূস, দৈনিক আজাদী ও একটি শিরোনাম
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্ববরেণ্য এক ব্যক্তিত্ব