ভাদ্রের প্রথম সপ্তাহ। ১৪২৮ বংগাব্দ। আমাদের আজকের আলোচনা হচ্ছে উপজেলা হাসপাতালসমূহে চিকিৎসা সরঞ্জাম সংকটের বিপর্যস্ত চিত্র নিয়ে। সম্মানিত পাঠকবৃন্দকে প্রথমে বিনীত অনুরোধ করবো নিম্নের সংবাদচিত্র দুটিতে দৃষ্টিপাত করার জন্য। সংবাদচিত্র (ক)ঃ ‘পটিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬ বছর পর ডিজিটাল এক্সরে মেশিন পাওয়া গেলেও ৩ বছর ধরে অকেজো পড়ে আছে ডেন্টাল মেশিন। শয্যা সংকটের কারণে রোগীদের ফ্লোরে রেখেই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। সীতাকুণ্ড স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দীর্ঘদিন ধরে অকেজো পড়ে রয়েছে জেনারেটরটি। নেই উপযুক্ত অপারেশন থিয়েটার। সন্দ্বীপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি সেবা দেয়ার জন্য দুটি সি-এমবুলেন্স থাকলেও চালক ও জ্বালানীর ব্যবস্থা না থাকায় তা রোগীদের কোন উপকারেই আসছে না। রাংগুনিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে বারান্দায় ১৪ বছর ধরে বাঙবন্দি হয়ে পড়ে আছে জীবানুমুক্তকরণ যন্ত্র। স্বাধীনতার পূর্বে ফটিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নির্মিত ভবনটি এখন পুরোপুরিই ঝুঁকিপূর্ণ। বোয়ালখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রয়েছে ওষুধের স্বল্পতা যে জন্য বহিঃবিভাগের সেবা কিছুই নেই বলা চলে। আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স জনবল ও বিশুদ্ধ পানিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। চন্দনাইশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও ৩১ শয্যার জনবল ও সরঞ্জাম দিয়ে কোন রকমে চলছে সেবা কার্যক্রম। কর্ণফুলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভবনই নেই ( দৈনিক পূর্বকোণ,১৩-০২-২০)”।
সংবাদচিত্র ঃ ‘অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্সরে যন্ত্র সচল থাকে না। এ ছাড়াও আলট্রাসনোগ্রাম, এক্সরে ফিল্ম ও ইসিজি যন্ত্রের অভাব রয়েছে (লাইভ টিভি, ১৮-১০-১৬)’।
উল্লিখিত সংবাদচিত্র দুটির পর্যালোচনাঃ দেখা যাচ্ছে একদিকে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও জরুরি চিকিৎসায় ব্যবহ্রত যন্ত্রপাতির সংকটের কারণে সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে, আবার অন্যদিকে কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি জনবলের অভাবে অব্যবহৃত থাকার কারণে অকেজো হয়ে পড়ছে। চট্টগ্রাম জেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেঙগুলোর মতো বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোও কমবেশী সংকটে ভুগছে এটা ধরে নেওয়া যায়। এবারে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়া যাক।
১. উপজেলা হাসপাতালসমূহে শয্যা সংখ্যা অপ্রতুলঃ উপজেলায় জনসংখ্যা গড়ে সাড়ে তিন লাখ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি ১০০০ মানুষের জন্য হাসপাতালের সাধারণ বেডের প্রয়োজন ৩ দশমিক ৫ টি। এ হিসাবে সাড়ে তিন লাখ মানুষের জন্য সাধারণ বেডের প্রয়োজন ১২২৫টি। উপজেলা হাসপাতালসমূহে বর্তমানে সাধারণ বেডের সংখ্যা গড়ে ৫০টি। সুতরাং উপজেলা হাসপাতালসমূহে সাধারণ বেড রয়েছে প্রয়োজনের মাত্র ৪ শতাংশ।
২. অক্সিজেন ফ্লমিটার-এর অভাবে অঙিজেন সিলিন্ডার অব্যবহ্রত থাকছেঃ‘শরীয়তপুর জেলার ডামুড্য়া উপজেলা স্বাস্থ্য্ কমপ্লেক্সে অক্সিজেনের ১২ টি সিলিন্ডার আছে। কিন্তু ফ্লমিটার আছে মাত্র ২টি (প্রথম আলো, ১০-০৫-২০)। ‘এখানে দেখা যাচ্ছে ফ্লমিটার মাত্র দুইটি থাকায় একসংগে দু’জনের বেশী রোগীকে অক্সিজেন দেয়া যাচ্ছে না। সিলিন্ডার থেকে কতটা মাত্রায় অক্সিজেন রোগীর শরীরে যাবে তা ফ্লমিটারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
৩. হৃদরোগ বা পেটের পীড়া নির্ণয় করার ব্যবস্থা নেইঃ ‘শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে এঙরে আল্টাসনোগ্রটাম ও ইসিজি মেশিন চালু নেই (প্রথম আলো,১০-০৫-২০)’।
উল্লিখিত তিনটি মেশিন না থাকলে রোগীর হৃদরোগ হয়েছে নাকি পেটের পীড় হয়েছে নাকি দুটোই হয়েছে নির্ণয় করা যাবে না।
৪. শ্বাসকষ্টের রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা নেইঃ ‘শরীয়তপুর জেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে নেবুলাইজার মেশিন সংকট রয়েছে (প্রথম আলো, ১০-০৫-২০)। ‘নেবুলাইজার যন্ত্রটির সাহায্যে শ্বাস কষ্টের রোগী তাৎক্ষণিক নিরাময় দেয়া যায়। এরকম একটি মেশিন যদি উপজেলা হাসপাতালে না থাকে তাহলে সেখানে কিভাবে শ্বাস কষ্টের রোগীর চিকিৎসা দেয়া যাবে? ৫. উপজেলা পর্যায়ে আইসিইউ সুবিধা নেইঃ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে উপজেলা হাসপাতাল ৩১ বেডের হলে আইসিইউ বেড থাকতে হবে কমপক্ষে ৩ টি, আর ৫১ বেডের হলে আইসিইউ বেড থাকতে হবে কমপক্ষে ৫ টি। বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে আইসিইউ সুবিধা রাখা হয়নি। ৬. প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর স্বল্পতাঃ ‘রোগীদের পরিচর্যায় নেই প্রশিক্ষিত চিকিৎসক বা নার্স (আলোকিত বার্তা, ২৮-০৬-২১)। ‘করোনা সংক্রমনের প্রথম পর্যায়ে ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে রোগীকে অক্সিজেন ঠেসে দিতে হয় আর কার্বনডার্ইক্সাইড টেনে বের করতে হয়। প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে ভেন্টিলেটরগুলো ব্যবহ্রত না হয়ে অকেজো হয়ে পড়ে আছে ।
৭. উপজেলায় রক্ত দেয়া বা নেয়া কোনটারই ব্যবস্থা থাকে নাঃ এখানে ব্লাড ব্্যাংক থাকে না। ব্লাড কালচার বা ইলেকট্রোলাইট পরীক্ষার ল্যাব সুবিধা থাকে না। কারো শরীরে রক্ত দিতে হলে এর জন্য যে স্ক্রিনিং এবং ক্রস ম্যাচিং প্রয়োজন তা হয় না । ৮.উপজেলায় এক্সরে রিপোর্ট হয় নাঃ যেহেতু রেডিওলজিস্ট এর পদ থাকে না বা পদায়ন হয় না। শহর থেকে ফিল্ম পাঠিয়ে রিপোর্ট করিয়ে আনতে এক-দুই দিন দেরী হয়। যার ফলে এটা জরুরি রোগীর কোন কাজে আসে না। ৯. উপজেলা হাসপাতালে আলট্রাসনোগ্রাম হয় নাঃ সনোলজিস্ট এর পদ নেই বা থাকলেও পদায়ন হয় না। ব্যবহৃত না হবার ফলে সরকারি আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন নষ্ট হয়ে পড়ে।
১০. উপজেলা হাসপাতালে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেইঃ বর্র্জ্য ব্যবস্থপনা একটি বিজ্ঞানভিত্তিক সারা দেশব্যাপী জরুরি ব্যবস্থাপনা। এটির অনুপস্থিতিতে হাসপাতাল ও তদসংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশ বিপন্ন হয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়য় । ১১. শয্যাসংকটের কারণে রোগীদের হাসপাতালের ওয়ারডের মেঝে ফ্লোরে, বারান্দায় কিংবা করিডোরে শুয়ে চিকিৎসা নিতে হয়ঃ রোগীদের শয্যায় বেডশীট, বালিশ কভার থাকে না। ছোটখাটো অপারেশন করা হলেও রোগীদের গজ বেন্ডিজসহ সব ধরনের ওষুধ বাহির থেকে কিনতে হয়। উপজেলা হাসপাতালসমূহে নিজস্ব জেনারেটর না থাকায় লোডশেডিং হলে হারিকেন জ্বালানে হয়। পর্যাপ্ত আলোর অভাবে রোগ নির্ণয় যথার্থ হয় না। এ্য়াম্বুলেন্স একবার বিকল হলে জরুরি ফান্ড না থাকায় জরুরি মেরামতের সুযোগ না থাকায় দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থেকে নষ্ট হয়ে যায়।
উপসংহার : উপজেলা হাসপাতালসমূহে হৃদরোগী, পেটের পীড়ায় আক্রান্ত রোগী, শ্বাস কষ্টের রোগী প্রাথমিক চিকিৎসা না পেয়ে শহরের জেলা হাসপাতালসমূহে বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসমূহে যেতে যেতে পথেই চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। সামপ্রতিক করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে উপজেলায় গ্রামাঞ্চলের রোগীরা চিকিৎসা না পেয়ে শহরমুখী হতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু শহরের হাসপাতালে পৌঁছার আগেই সময়মতো অক্সিজেন না পাওয়ার কারণে তারা রাস্তায় মারা যাচ্ছে। এটাই এখন সারা বাংলাদেশে ঘটছে। অতএব উপজেলা হাসপাতালসমূহে জনবল ও চিকিৎসা সরঞ্জামাদির সংকটের সুরাহা করা অতীব জরুরি।
লেখক : ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক