ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বৃষ্টির পর থেকেই মূলত শেষ হয়ে গেছে লবণ মৌসুম। চলতি জুন মাস থেকে কক্সবাজারের মহেশখালী উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৩০ হাজার একর জমিতে পুরোদমে শুরু হচ্ছে চিংড়ি চাষ। ইতোমধ্যে ৩০ ভাগ প্রজেক্টে চাষ শুরু হয়েছে। লবণ চাষ বন্ধের পর থেকেই শুরু হয়েছে ঘের সংস্কার ও পোনা মজুদের কাজ। বর্তমান বিশ্ববাজারে চিংড়ির চাহিদা ক্রমে বাড়লেও চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে চিংড়ি রপ্তানি কমেছে। ২০২২–২৩ অর্থবছরে চিংড়ি খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ কম। এমন তথ্য জানিয়েছে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট। রপ্তানি বাড়াতে চিংড়ি উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কক্সবাজার জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় অন্তত ৬৫ হাজার একর জমিতে বাগদা চিংড়ি চাষ হবে চলতি মৌসুমে। ইতিমধ্যেই চিংড়ি চাষীদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
মহেশখালীর চিংড়ি পোনা সরবরাহকারী হোয়ানক ইউনিয়নের হরিয়ার ছড়া গ্রামের মোহাম্মদ আলম বলেন, চলতি মৌসুমে স্থানীয় পোনার চাইতে হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার চাহিদা বেশি। ইতোমধ্যে ৪/৫টি প্রজক্টে প্রায় ৭০ লাখ চিংড়ি পোনা সরবরাহ করা হয়েছে। চাষ পুরোদমে শুরু হলে চাহিদা আরো বাড়বে। গত মৌসুমে চিংড়ি চাষীরা লাভবান হওয়ায় এ বছর তাদের মাঝে আগ্রহ বেড়েছে।
মহেশখালীর চিংড়ি চাষী হোয়ানক ইউপি মেম্বার সেলিম সিকদার জানিয়েছেন, বর্তমানে বাগদা চিংড়ির মূল্য বেশি থাকায় সবাই প্রজেক্টের দিকে নজর দিয়েছেন। তাই দ্রুত গতিতে চলছে প্রজেক্টের কাজ। অনেকেই আরো দুই মাস আগে নার্সারি করে পোনা মজুদ করেছেন। তবে মহেশখালীর ধলঘাটা, মাতারবাড়ী ও হোয়ানকের হেতালিয়া মৌজা এলাকায় বেশ কিছু জমি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণে চলে যাওয়ায় আগের চেয়ে মহেশখালীতে চিংড়ি চাষ অনেকটা কমে গেছে। কক্সবাজার জেলার দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, উখিয়া, টেকনাফ ও সদর উপজেলার বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় শুরু হবে চাষ।
এদিকে চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই চিংড়ি রপ্তানি কমেছে। ২০২২–২৩ অর্থবছরে চিংড়ি খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ কম। এমন তথ্য জানিয়েছে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট। রপ্তানি বাড়াতে চিংড়ি উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া কৃষির মতো এই খাতেও ভর্তুকি দেয়ার দাবি জানাচ্ছেন তারা। রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট বলছে, বিশ্ববাজারে ক্রমেই চিংড়ির চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে চিংড়ির বৈশ্বিক বাজার ৩২ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় অর্ধেক চিংড়ির বাজার ইকুয়েডর ও ভারতের দখলে। দেশ দুটি যথাক্রমে বৈশ্বিক চাহিদার ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ ও ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ বাজার দখল করে আছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের দখল কমে ১ দশমিক ৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য চিংড়ি রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে– ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনা, থাইল্যান্ড ও চীন।
এদিকে প্রধান চিংড়ি উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের গড় ফলন সবচেয়ে কম। ২০১২ সালে দেশে চিংড়ি চাষের আওতাধীন জমির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭৯ হাজার হেক্টর, যা ২০২২ সালে কমে ২ লাখ ৫০ হাজার হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। গত ১০ বছরে উৎপাদন কমেছে ৩৫ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৩–১৪ অর্থবছরে মৎস্য খাত থেকে রপ্তানি আয় হয় ৬০২ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু কাঁচামালের ঘাটতি এবং অন্যান্য কারণে ২০২২–২৩ অর্থবছরে আয় কমেছে ৩৮২ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১০ বছরে এই খাতে রপ্তানি নেমেছে প্রায় অর্ধেকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি আয় কমেছে যথাক্রমে ৪২ এবং ২৯ শতাংশ।
হ্যাচারি মালিকদের সংগঠন শ্রিম্প হ্যাচারি এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (সেব) সভাপতি ও মহেশখালী– কুতুবদিয়া আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, চিংড়ি খাতের উন্নয়নে বর্তমান সরকার মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মহেশখালীর কিছু জমি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ হলেও ভরাট খালগুলো খনন করে পানির প্রবাহ সচল রাখলে চিংড়ি চাষ আগের মতই অব্যাহত থাকবে। মহেশখালীর পশ্চিমাংশে জেগে ওঠা চরগুলো চিংড়ি চাষের আওতায় নিয়ে আসার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, দেশের অন্যতম রপ্তানি পণ্য চিংড়ি। কিন্তু এই খাতে সংশ্লিষ্টরা কৃষির মতো সুযোগ–সুবিধা পাচ্ছে না। চিংড়ি খাতেও কৃষির মতো ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে।
ফ্রোজেন ফিস ট্রেডার্স এন্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ও নবনির্বাচিত মহেশখালী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন বলেন, চিংড়ি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী বাংলাদেশের একটি প্রধান অর্থকরী ফসল। মহেশখালী উপকূল চিংড়ি চাষের একটি উল্লেখযোগ্য জোন। মহেশখালীতে উৎপাদিত চিংড়ি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তাই চিংড়ি চাষে আধুনিকায়ন ও যুগ উপযোগী প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান–পূর্বক উৎপাদন বাড়াতে হবে।