উন্মুক্ত হচ্ছে জাতিসংঘ পার্ক

এক যুগ পরিত্যক্ত থাকার পর কাল উদ্বোধন। কাজ শেষ হলেও পার্কটি চসিককে বুঝিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়নি গণপূর্ত অধিদপ্তর, পরিচালনায় জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু

মোরশেদ তালুকদার | বৃহস্পতিবার , ২ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার তিন মাস পর সবার জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে নগরের পাঁচলাইশ জাতিসংঘ পার্ক। আগামীকাল শুক্রবার এটি উদ্বোধন হওয়ার কথা রয়েছে। এর ফলে দীর্ঘ এক যুগ পরিত্যক্ত থাকা পার্কটি আবারও নগরবাসীর পদচারণায় মুখরিত হবে। তবে জনবল সংকট থাকায় পার্কটি শুরুতে ‘সীমিত’ সময়ের জন্য খোলা রাখা হতে পারে।

জানা গেছে, জাতিসংঘ পার্কটি দুই দশমিক ২৭ একর জায়গার উপর অবস্থিত। ১৯৫৪ সালে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকাটি বরাদ্দ দেয় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ঐ সময়ে লেআউটে পার্কটি ছিল। ১৯৮৮ সালে গণপূর্ত বিভাগ এ পার্ক সংস্কার ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে (চসিক) দেয়। তখন এটি ‘পাঁচলাইশ পার্ক’ নামে পরিচিত ছিল। ২০০২ সালে চসিক নাম পরিবর্তন করে রাখে জাতিসংঘ পার্ক। সর্বশেষ গণপূর্ত অধিদপ্তর ১২ কোটি ৬৫ লাখ টাকায় ‘পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন জাতিসংঘ সবুজ উদ্যান উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে পার্কটি নতুন করে নির্মাণ করে। যার কাজ শেষ হয়েছে ৩ মাস আগে। তবে কাজ শেষ হলেও পার্কটি চসিককে বুঝিয়ে দেয়ার কোনো উদ্যোগ নেয়নি গণপূর্ত অধিদপ্তর। বরং নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পার্কটি পরিচালনায় জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করে। ইতোমধ্যে গণপূর্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রাম সার্কেল১ থেকে পার্ক পরিচালনায় ২১ সদস্যের জনবল কাঠামোর প্রস্তাব করা হয় মন্ত্রণালয়ে। তবে ওই জনবল কাঠামোর অনুমোদন পাওয়া যায় নি। তাই উদ্বোধন হলেও পার্কটি দিনভর খোলা রাখা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

জানা গেছে, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সর্ম্পকিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তৎকালীন সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ২০১৭ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকল্পের মাধ্যমে পার্কটি সংস্কারের উদ্যোগ নেন। কিন্তু এতে আপত্তি জানায় মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ও ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন পারষ্পরিক আলাপে একমত হন, গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চসিকে হস্তান্তর করবে। পরের বছর প্রশাসকের দায়িত্ব পালনকালে খোরশেদ আলম সুজন গণপূর্ত অধিদপ্তরকে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনাপত্তি পত্র দেয়। তবে পার্কের কাজ শেষ হলে চসিকও পার্কটি বুঝে নিতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা আজাদীকে জানিয়েছেন, জনবল না থাকায় পুরোদিন পার্কটি খোলা রাখা সম্ভব হবে না। তাই কেবল সকালে প্রাতঃভ্রমণের জন্য পার্ক খোলা রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। এদিকে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, চসিকে পর্যাপ্ত জনবল আছে। পার্কটি তারা বুঝে নিলে নতুন করে জনবল নিয়োগও দিতে হবে না। সংস্থার বিদ্যমান জনবল দিয়ে এটি পরিচালনা করা যাবে। তখন পুরোদিন খোলা রাখতেও সমস্যা হবে না। এ বিষয়ে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, পার্কটি বুঝে নিতে উদ্যোগ নেব। প্রয়োজনে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে লিখব। উপদেষ্টা মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলব।

গণপূর্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের (সার্কেল) নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল হাসান খান গতকাল আজাদীকে বলেন, পার্কের কাজ আগে শেষ হয়েছে। খুব নান্দনিক একটা পার্ক হয়েছে। প্রচুর মানুষ হাঁটতে পারবে এখানে। ৩ জানুয়ারি উপদেষ্টা মহোদয় এটি উদ্বোধন করবেন। পার্ক কতক্ষণ খোলা রাখা হবে জানতে চাইলে বলেন, পার্ক খোলা রাখার সময় সেদিন ফাইনাল হবে।

এর আগে গত ২৮ ডিসেম্বর আজাদীকে তিনি বলেন, ২১ সদস্যের জনবলের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছি। কর্পোরেশন পার্কটি বুঝে নেয়ার বিষয়ে আমাদের কোনো প্রস্তাব দেয়নি। তারা চাইলে প্রস্তাব দিতে পারে বা মন্ত্রণালয়ে লিখতে পারে। তবে এমন না যে পার্কটি আমরা পরিচালনা করতে পারব না। আগ্রাবাদ এবং বায়েজিদে কিন্তু দুটো পার্ক আমাদের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে।

এদিকে নতুন করে নির্মিত জাতিসংঘ পার্কটি সবুজ প্রাধান্য পেয়েছে। এখানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন সীমানা প্রাচীর ও প্রবেশপথ। হাঁটার জন্য ওয়াকওয়ে’সহ অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়। নতুন করে নির্মিত পাকে রয়েছেবসার সিট, শিশুদের জন্য খেলাধুলার সরাঞ্জাম এবং শরীর চর্চার জন্য হরিজন্টাল বার ও মেটাল পারগোলা। আছে টয়লেট ব্লক, ড্রেন, ডাস্টবিন, কম্পউন্ড লাইট, স্ট্রিট লাইট, পাম্প মোটর, বজ্র নিরোধক। পার্কে লাঘানো হয় গাছ ও ঘাস।

জানা গেছে, শিশু কিশোরসহ বিনোদন প্রেমী মানুষেদের কাছে এ পার্কটি এক সময় দর্শনীয় স্থান হিসাবে মন জয় করে নেয়। কিন্তু দিনে দিনে পার্কটির প্রতি অবহেলা আর অযত্নের চাপ পড়তে থাকে। এতে পার্কটি জৌলুস হারায়। প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পৌঁছে যায়। ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে পার্কে থাকা একটি পুকুরও। এরপর ২০১২ সালের ৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘ পার্কের একটি অংশে সুইমিং পুল নির্মাণের ভিত্তির প্রস্থর করেন তৎকালীন মেয়র এম মনজুর আলম। ২০১৫ সালের জুনে তিন কোটি ৯৪ লাখ দুইটি সুইমিং পুল ও জিমনেশিয়াম নির্মাণ কাজ শেষ হয়। যা নতুন করে পার্কটি সাজানোর জন্য ভেঙে ফেলা হয়। এর আগে সুইমিং পুল নির্মাণের সময় চসিকের পক্ষে বলা হয়েছিল, পার্কটির উন্মুক্ত অংশটিও সাজানো হবে। গড়ে তোলা হবে নান্দনিক বিনোদন পার্ক। কিন্তু তা করা হয় নিয়। ফলে ২০১২ চসিকের সুইমিং পুল নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ থেকেই কার্যত পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল পার্কটি। এখন নতুন করে নির্মিত হওয়ায় দীর্ঘ একযুগ পর প্রাণ ফিরে পাবে পার্কটি।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ পার্ককে ঘিরে বাণিজ্যিকীকরণের উদ্যোগ নেয় চসিক। যার অংশ হিসেবে ওই সময় পার্কটির একটি অংশে ‘কমিউনিটি সেন্টার ও গেস্ট হাউস’ নির্মাণে একটি ঠিকদারি প্রতিষ্ঠানকে ২৫ বছরের জন্য ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করে। এ বিষয়ে ২০১৬ সালের ১৬ মে দৈনিক আজাদীতে ‘জাতিসংঘ পার্কে কমিউনিটি সেন্টার, গেস্ট হাউস’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর নড়েচড়ে বসে সবাই। শুরু হয় আন্দোলন। পার্কটির মালিকানা দাবি করে গণপূর্ত অধিদপ্তর কাজ বন্ধে নোটিশ দেয় চসিককে। উচ্চ আদালতে রীট করে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতি। এতে আটকে চসিকের উদ্যোগ।

পরবর্তীতে পার্কটির উন্নয়নে ২০১৭ সালে প্রকল্প নেয় গণপূর্ত অধিদপ্তর। ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভায় গণপূর্তের প্রকল্পটি নিয়ে একাধিক পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়। এরপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটি সংশোধন করে ২০২২ সালের ১৮ মে পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। পরবর্তীতে একই বছরের সালের ৪ জুলাই পরিকল্পনা কমিশন চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। তখন প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১১ কোটি ৭০ লাখ ১২ হাজার টাকা। পরবর্তীতে তা বেড়ে ১২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধউদ্যোক্তা তৈরিতে জেলা ও উপজেলায় বাণিজ্য মেলার আয়োজন করতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধফিরিয়ে আনা হচ্ছে মোজাম্বিকে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের