‘আপনারে বড় বলে বড় সেই হয়
লোকে যারে ছোট বলে তাও সেই বড় হয়’-
কী অবাক হলেন? ভাবছেন হরিশ্চন্দ্র মিত্রের কবিতা ‘বড় কে’?- ‘আপনারে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়’- চরণগুলো বদলে গেল কী করে?- বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজেকে বড় করে উপস্থাপন করার যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে তা বিবেচনা করলে চরণের বদলগুলো অস্বাভাবিক মনে হবে না।
সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘অর্থনীতিতে সংকট বিরাজমান, এখন বিকাশমান’। আর এর জন্য দায়ী তথ্য উপাত্তের প্রতি অবজ্ঞা এবং অনেক ক্ষেত্রে অন্ধত্ব এবং মনগড়া উন্নয়ন-উপাখ্যান। আমার মতে এই উন্নয়ন-উপাখ্যান মরীচিকা ছাড়া কিছু নয়। উন্নয়ন হচ্ছে অস্বীকার করছি না কিন্তু যতটা বাড়িয়ে বলা হচ্ছে তা বাহুল্যতা ছাড়া কিছুই নয়। রাতারাতি মিরাকেল বা চমৎকার হয়ে যাওয়ার উচ্চ বাসনা মনে ধারণ করলেই তো হবে না। তার জন্য চাই সুষ্ঠু নীতি ও পরিকল্পনা। একজন গবেষক হয়ে আমার মনে হয় দেশ এখন অস্টিওপরোসিস এ আক্রান্ত। অর্থাৎ মেরুদণ্ডের হাড় ক্ষয় হতে চলেছে যা যে কোন সময় ভেঙে পড়তে পারে। এই মুহূর্তে চিকিৎসা না হলে মেরুদণ্ড শক্ত করে আর দাঁড়ানো সম্ভবপর নয়। আর একটি জাতির মেরুদণ্ড হল শিক্ষা। দেশে সুশিক্ষিত লোকের অভাব নেই কিন্তু স্বশিক্ষিত লোকের যথাযথ অভাব রয়েছে। একটি দেশের উন্নয়নে সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং রাজনৈতিক তিনটি মানদণ্ডের সুষ্ঠু প্রয়োগ দরকার। আজকের নিবন্ধে আমি শিক্ষা খাতের ওপর আলোকপাত করতে চাইছি। আমাদের শিরদাঁড়া কতটুকু সবল তা কিছুটা খতিয়ে দেখার প্রয়াস মাত্র।
বাংলাদেশের বর্তমান সাক্ষরতার হার :
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী- দেশে ১৯৭১ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ১৯৯১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ২০০১ সালে ৪৭ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০০৮ সালে ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ২০১১ সালে ৫১ দশমিক ৭৭ শতাংশ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন জানান, ২০২১ সালে সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬০ দশমিক। ২০২০ এ হার ছিল ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। এক বছরে সাক্ষরতা বেড়েছে দশমিক ৯ শতাংশ।
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের আওতায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের মোট জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। যেখানে ৮ কোটি ১৭ লাখ পুরুষ ও ৮ কোটি ৩৩ লাখ নারী আর ১২ হাজার ৬২৯ জন তৃতীয় লিঙ্গ। প্রতিবেদনে সাক্ষরতার হারের হিসাবে বলা হয়, দেশের নারী-পুরুষ মিলে মোট সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগের ঘোষণা ছিল ২০১৪ সালের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা হবে। ২০১০ সালে সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষণা করে এবং উল্লিখিত সময়ের মধ্যে শতভাগ সাক্ষরতা নিশ্চিতের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের পর ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশে এখনও ২৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। এ হারে সাক্ষরতা বাড়তে থাকলে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন করতে আরও ২৮ বছর লাগবে।
জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ( % জিডিপি)
স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭২-৭৩ সালের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল বাজেটের ২০ দশমিক ১ শতাংশ। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাখাতে জিডিপির ৪ শতাংশ বরাদ্দ দিতে চেয়েছিলেন। তার সময়ে তৈরি কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন তাদের রিপোর্টে বলেছিল, শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের ৫-৭ শতাংশ দরকার। ১৯৭৩-৭৪ সালে ছিল ২০ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ ১৯৭৫-এর পর থেকে তা ক্রমহ্রাসমান।
একটি উন্নত রাষ্ট্রের জন্য জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো) পরামর্শ অনুসারে শিক্ষাখাতে জিডিপির ৬ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ অত্যাবশ্যক। ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ১৩ হাজার কোটি টাকা অধিক বরাদ্দের প্রস্তাব করা হলেও তা মোট বাজেটের ১২ শতাংশের বেশি নয় এবং এটি জিডিপির ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।২০২১-২০২২ অর্থবছরে শিক্ষাখাতের জন্য বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ ও জিডিপির ২ দশমিক শূন্য ৯ ভাগ। চলতি অর্থবছরের তুলনায় টাকার অঙ্কে শিক্ষাখাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়লেও জিডিপির হিসাবে তা চলতি বছরের তুলনায় শূন্য দশমিক ১ ভাগ কমতে পারে। অর্থাৎ, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ এখনও জিডিপির দুই শতাংশেরও কম। অথচ এই বরাদ্দ দিয়েই আমরা ‘শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করে আসছি। এ যেন নিজের ঢোল নিজেই পিটিয়ে যাচ্ছি।
বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স বা বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে ২০২১ সালে ১৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশন (এমবিআরএফ) যৌথ ভাবে এই সূচক প্রকাশ করে থাকে। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সূচকটি তৈরিতে শিক্ষা, প্রযুক্তি, উন্নয়ন, উদ্ভাবনসহ সাতটি বিষয় ( প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, প্রযুক্তি-বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং সাধারণ সহায়ক পরিবেশ) বিবেচনা করা হয়েছে। যা সাতটি সেক্টরের অধীনে ১৫৫টি চলকের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।
খাতভিত্তিক সূচকে এবারে বাংলাদেশ প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণে (৫১.৫),অর্থনীতি সেক্টরে (৪৬.৯), প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সেক্টরে (৪৪.৭), সাধারণ সহায়ক পরিবেশে (৪১), উচ্চশিক্ষায় (৩৬.৩)ও আইসিটি সেক্টরে (২৮.৩)। অন্যদিকে গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন খাতে (১৯.২) এই খাতে বাংলাদেশের স্কোর সর্বনিম্ন।
গবেষণা খাতে বাংলাদেশের এই নিম্ন অবস্থানের নেপথ্যে কারণ খুঁজতে গেলে প্রথমেই যেটা সামনে আসবে তা হলো: ছাত্র-শিক্ষকদের দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি। রাজনীতি শব্দের অর্থ জানতাম রাজার নীতি। কিন্তু এখন যে নীতি হীনভাবে রাজ করতে পারবে সেই রাজা আর তারই নির্দেশে চলে রাজনীতি। স্বাধীনতার আগে এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং আন্দোলন-সংগ্রাম হতো। তখন রাজনীতি থাকলেও লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি ছিল না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে বিতাড়িত করতে সবাই রুখে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আজ স্বদেশী কিছু শাসকের হাতে শোষিত সাধারণ জনতা। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় প্রশাসনের রাজনীতিকরণ। ছাত্র রাজনীতির এতটাই দাপট যুগ পেরিয়ে গেলেও অনেকের ছাত্রত্ব থেকে যায়। শুধু তাই নয়, কিছু রাজনৈতিক দীর্ঘমেয়াদী ছাত্রের শুভাগমনে নানা প্রীতি ভোজের আয়োজন করা হয় তাও আবার স্বাভাবিক ক্লাস বর্জন করে। ধন্য আমাদের রাজনীতি।
তথ্য বিন্যস্তকরণ ও নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর লক্ষ্যে উপকরণ ও উৎসগুলোর মধ্যে পদ্ধতিগত অনুসন্ধান ও অধ্যয়নই গবেষণার মূল কাজ। গবেষণার মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান সমস্যাদির প্রকৃতি ও গভীরতা সম্পর্কে অবগত হওয়া যায় এবং একই সঙ্গে সমস্যা সমাধানের সম্ভাব্য পন্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বাংলাদেশের গবেষণার অন্যতম সমস্যা হল সঠিক বণ্টন না হওয়া এবং যোগ্য ব্যক্তিকে গবেষণার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা। আর্থিক বরাদ্দের যথাযথ ব্যবহারই মূল চ্যালেঞ্জ। বরাদ্দকৃত অর্থ সত্যিকার অর্থে গবেষণা খাতে যথাযথভাবে ব্যয় হয় না; এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে অব্যয়িত থেকে যায়। তবে দেশের কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা কাজে ইতোমধ্যে শুধু জাতীয় নয় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বেশ সুনাম অর্জন করেছে। যা উচ্চশিক্ষা বিস্তারে অন্য মাত্রা যোগ করে গবেষণাকর্মকে উৎসাহিত করছে।
বিশ্বের ১২৫টির মতো দেশে গবেষণা ও উন্নয়ন নামে আলাদা একটি খাত রয়েছে, যার বরাদ্দ শিক্ষাখাতের বরাদ্দের বাইরে রাখা হয়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে যারা বেশি ব্যয় করে, তারা তত বেশি উন্নত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশের মধ্যে নেপাল আছে। কিন্তু এই তালিকায় নেই বাংলাদেশ। তাই উন্নয়নের জোয়ার যেন মরীচিকা, আলেয়ার আলো। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে হলে গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন খাতে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে হবে।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু আমাদের মেরুদণ্ডই তো নাজুক। সুশীল শিক্ষিত সমাজ যেন নীরব দর্শক। প্রাণ ভয়ে, অসম্মানের ভয়ে নিশ্চুপ। সোচ্চার হয়ে ওঠেন, কিন্তু থামিয়ে দেয়ার পূর্ণ চেষ্টা চলে। কেননা ‘চোর শোনেনা ধর্মের কাহিনি’। আর অন্যদিকে অর্ধ শিক্ষিত বা অশিক্ষিত নাগরিকের তাণ্ডব চলেছে প্রতি দিন। রাজনীতি করে দেশের উপকার, উন্নয়ন হউক না হউক রাতারাতি ধন কুবের হওয়া যায়। এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে দেশের ছাত্র সমাজ আজ কলুষিত। সামপ্রতিক দি ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম বর্তমান সরকারের কার্যকলাপ কে ওয়াক ম্যান সিনড্রোম বলে আখ্যায়িত করেছেন। নিজেদের প্রশংসা শুনতে শুনতে তারা এতটাই ব্যতিব্যস্ত, সমালোচনার ভ্রুক্ষেপ করে চলছে। কিন্তু দেশের জনগণের স্বার্থে নিজেদের দোষ ত্রুটি শুধরে নেয়া বিচক্ষণতার লক্ষণ। তাই সব কিছুর নেপথ্যে প্রকৃত শিক্ষার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সু শিক্ষার অভাব নয়, স্ব শিক্ষার অভাব।
ছোটবেলায় কাজী কাদের নেওয়াজ রচিত ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতাটি পড়েছিলাম। সেই থেকে শিক্ষাগুরুর স্থান সকলের ওপরে জেনে এসেছি। এখন দেখি সেই শিক্ষকও লাঞ্ছিত হয়ে চলেছেন ছাত্রের কাছে। শিক্ষকের এই অসম্মান মেনে নেয়া যায় না। ক্ষমতা যে দলেরই হোক না কেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসব দৃষ্টি কটু, শ্রুতি কটু রাজনীতি অবিলম্বে বন্ধ হওয়া আবশ্যক। তাছাড়া রয়েছে ছাত্রী লাঞ্ছনা যা অসভ্যতা, বর্বরতার সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। নৈতিক অবক্ষয় থেকে পরিত্রাণের একটি পথ হল ছাত্রদের শিক্ষা কেন্দ্রিক অংশগ্রহণ বিশেষ করে গবেষণা খাতে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে হবে। নিজেদের নানা উদ্ভাবনী কৌশলে ছাত্র সমাজ কে উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই সঙ্কীর্ণ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। এতে একদিকে যেমন দেশের নৈরাজ্য দূরীভূত হবে, অন্যদিকে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের মান বাড়বে। তাই কোনো মিরাকেল এ বিশ্বাসী না হয়ে আসুন আমরা সকলে মিলে সততা দিয়ে স্বপ্ন পূরণে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। এ জন্মভূমি আমাদের সকলের, সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার শপথ গ্রহণ করি। উদ্যোগ শুরু হোক আজ থেকেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, পিএইডি গবেষক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।