সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি আবিষ্কার হচ্ছে। ফলে মানুষের জীবন যাত্রাও পরিবর্তন হচ্ছে। মানব জাতি অভ্যস্ত হয়ে উঠছে অন্যভাবে। এই সেদিনের কথা। ১৯৭১ সালের পরবর্তী সময়ে স্কুলে বা কলেজে বা কোন অফিসে ক্যালকুলেটরের ব্যবহার ছিল না। ক্যালকুলেটর কি জিনিস তা আমরা জানতাম না। তাই বলে পাটীগণিত ও বীজগণিতের অংকগুলো না করে পরীক্ষায় পাস করতে পারিনি। পাটীগণিতে বড় বড় যোগ, বিয়োগ, ভাগ, ভগ্নাংশ ও অনুপাতের অংকগুলো নির্বিঘ্নে করার জন্য কোন ক্যালকুলেটরের প্রয়োজন হয়নি। অনেক বড় বড় অংকগুলো মুখে মুখে করে তার ফলাফল পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে মুখস্ত বলে দিতে পারতাম। বীজগণিতের বর্গমূল কিভাবে ভাঙতে হয় স্যারেরা তা শিখিয়ে দিতেন। অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে বর্গমূল এর অংক সমাধান করে ফেলতে পারতাম। এমন কি ১৯৭৮ সালে অর্থনীতি বিষয়ের অনার্স পরীক্ষা দেয়ার সময়ও গাণিতিক অর্থনীতি নামক ১০০ নম্বরের একটি বিষয় ছিল। সেই অংকগুলোও করার সময় কখনো ক্যালকুলেটর ব্যবহার করার কোন সুযোগ ছিল না। কারণ সবেমাত্র বাংলাদেশে ক্যালকুলেটর বের হয়েছে। অধিক দামী বলে তা ক্রয় করা আমার মত একজন দরিদ্র ছাত্রের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। তাই বলে পরীক্ষায় অংক না করে এসেছি? না তা নয়। বরং নিজ মেধা গুণে চার ঘন্টা সময়ের মধ্যে গাণিতিক অর্থনীতির সকল অংক নির্ভুলভাবে সমাধান করে দিয়ে এসেছি। তার ফলও পেয়েছি। সেই গাণিতিক অর্থনীতি বিষয়ে সত্তর শতাংশ নম্বর পেয়ে অনার্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছি। উল্লেখ্য যে, সেই বৎসর অর্থনীতি অনার্সে কোন ছাত্র প্রথম শ্রেণি পায়নি। কিন্তু ক্যালকুলেটর তো ব্যবহার করেনি। পরীক্ষার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বর্গমূল ভেঙ্গে অংকের প্রকৃত সমাধান করে পর্যাপ্ত নম্বর তুলতে সক্ষম হয়েছি। অধ্যাপনায় এসে গাণিতিক অর্থনীতি নামক একটি বই রচনা করেছি যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এখনো পাঠ্য।
কিন্তু আজ! অংকের সমাধান দেয়ার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট ক্যালকুলেটরের প্রয়োজন হয়। ক্যালকুলেটর ছাড়া তারা বর্গমূল (জড়ড়ঃ) ভাংতে পারে না। সেই পদ্ধতিও তাদের জানা নেই। এটা তাদের অপরাধ নয়। কারণ বিজ্ঞান তাদেরকে সহজ করে দিয়েছে। তাই তারা অংক সমাধানের পদ্ধতিগুলো ভুলে গেছে। অর্থাৎ সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ব্যক্তির জীবন ব্যবস্থায় যেমন পরিবর্তন এসেছে তেমনি উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের সংজ্ঞার পরিবর্তন এসেছে।
অর্থনীতিতে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোকে আলাদা শ্রেণিভুক্ত করার জন্য ১৯৭১ সালের ১৮ নভেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ২৬তম সাধারণ অধিবেশনে এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, এসব দেশসমূহ সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য কোন কোন দেশকে কিভাবে সহায়তা করা যায়। সেদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি [খবধংঃ উবাবষড়ঢ়বফ ঈড়ঁহঃৎু] নামে ২৪টি দেশকে তালিকাভুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ তখনো স্বাধীন হয়নি। স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত এ বাংলাদেশ এলডিসিভুক্ত হয় ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে। সেই বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ পেল ২০২১ সালে। ২০২৬ সালের পর বলা যাবে বাংলাদেশ আর স্বল্পোন্নত দেশ নয়। অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছর পর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মুক্তি পাবে।
বাংলাদেশ ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রস্তুতকৃত স্বল্প আয়ের দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হয়। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়েছিল ১৯৭২ সালের ১৭ আগষ্ট। বিশ্বব্যাংকের সদস্য হওয়ার নিয়ম হচ্ছে প্রথমে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সদস্য হতে হবে। তবেই বিশ্বব্যাংক সদস্য হওয়ার আবেদন বিবেচনা করে। সেই নিয়ম মেনে বিশ্বব্যাংকের সদস্য হওয়ার পর এক ধাপ উত্তরণের জন্য ৪৩ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সমগ্র বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বের দেশ বলে একটি কথা চালু আছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় যারা পুঁজিবাদের মার্কিন বলয় বা সমাজতন্ত্রের সোভিয়েত বলয়ের মধ্যে ছিল না। সেই সব দেশকে বলা হতো তৃতীয় বিশ্ব।
উন্নয়নশীল দেশের সংজ্ঞায় বলা হয় যে, যাদের শিল্পখাতের ভিত্তি কম উন্নত এবং মানবসম্পদ উন্নয়নেও পিছিয়ে আছে সেসব দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশ। আবার উন্নয়নশীল দেশের মধ্যেও কয়েকটি উপবিভাগ আছে। যেমন স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি), স্থল বেষ্টিত উন্নয়নশীল দেশ (এলএলডিসি) বা ল্যান্ডকড ডেভেলপিং কান্ট্রিজ, ছোট দ্বীপরাষ্ট্র (এসআইডিএস) বা স্মল আইল্যান্ড ডেভেলপিং স্টেটস। আর এর বিপরীতে আছে উন্নত দেশ (ডিসি)।
আবার জাতিসংঘ প্রতি বছর ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক সিচুয়েশন অ্যান্ড প্রসপেক্টাস’- নামের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। উক্ত রিপোর্টে বিশ্বের দেশগুলোকে ভাগ করা হয় এভাবে- উন্নত অর্থনীতি, রূপান্তরিত অর্থনীতি, উন্নয়নশীল অর্থনীতি, জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশ, স্বল্পোন্নত দেশ, ঋণভাবে জর্জরিত দরিদ্র দেশ, ক্ষুদ্র দ্বীপভিত্তিক উন্নয়নশীল দেশ এবং স্থলবেষ্টিত উন্নয়নশীল দেশ। অথচ অধিকাংশ সময় মানুষ মনে করে দেশগুলো বিভাজন হলো উন্নত দেশ, উন্নয়নশীল দেশ ও অনুন্নত দেশ। এ ধারণার যে পরিবর্তন হয়েছে তা অনেক লোকই জানে না। তবে বিশ্বব্যাংকের পদ্ধতি একটু ভিন্ন। বিশ্বব্যাংক অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ঋণ দিয়ে থাকে। ঋণ প্রদানের সুবিধার্থে বিশ্বব্যাংক সদস্য দেশগুলোকে চারভাগে ভাগ করে। যেমন নিম্ন আয়ের দেশ, নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ, উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ এবং উচ্চ আয়ের দেশ। বিশ্বব্যাংক এরূপ বিভক্তির ওপর নির্ভর করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে ঋণ দিয়ে থাকে। আবার মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক দেশগুলো বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছে। যে সব দেশের অ্যাটলাস পদ্ধতিতে (তিন বছরের মাথাপিছু আয়ের গড়) মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৩৫ ডলার বা এর চেয়ে কম সেইসব দেশ হয় নিম্ন আয়ের দেশ। আর যে সব দেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৩৬ ডলার থেকে ৪ হাজার ৪৫ ডলার সেই সব দেশ হয় নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। আবার যে সব দেশের মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ৪৬ ডলার থেকে ১২ হাজার ৫৩৫ ডলার সেই সব দেশ হয় উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ। আর এর চেয়ে বেশি মাথাপিছু আয় হলেই সেই সব দেশ হয় উচ্চ আয়ের দেশ।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসোক) উন্নয়ন নীতিমালা বিষয়ক কমিটি (কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি- সিডিপি) তিন বছর পর পর এলডিসি-র তালিকা তৈরি করে। এই তালিকা করা হয় তিনটি সূচকের ভিত্তিতে। প্রথমতঃ তিন বছরের গড় মাথাপিছু জাতীয় আয় (জিএনআই), দ্বিতীয়তঃ পুষ্টি, স্বাস্থ্য, স্কুলে ভর্তি ও শিক্ষার হারের সমন্বয়ে তৈরি মানবসম্পদ সূচক, তৃতীয়তঃ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক আঘাত, জনসংখ্যার পরিমাণ এবং বিশ্ববাজার থেকে একটি দেশের দূরত্বের ওপর ভিত্তি করে তৈরি অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের জন্য এই তিন সূচকের যে কোনো দু’টি সূচক অর্জন করতে হয়। অথবা শুধু আয়ের ভিত্তিতে এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করতে হয়। বাংলাদেশ ২০১৮ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করে। তবে ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ এলডিসি-ই থেকে যাচ্ছে।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ