শিক্ষা চিকিৎসা যোগাযোগ নিরাপত্তা মূলত এ চারটি কারণে গ্রামের মানুষ নগরমুখী হচ্ছে বা হতে বাধ্য হচ্ছে। বৈশ্বিক পরিবর্তনের ছোঁয়ায় কৃষি নির্ভর গ্রামীণ জীবন ধারা ও অর্থনৈতিক আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। ঘটেছে বংশানুক্রমে চলে আসা পেশাগত নির্ভরশীলতায় ও আধুনিকায়ন। গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থাতে কৃষি উৎপাদন ব্যতীত অন্য কোনো কর্মসংস্থান ও সুযোগ–সুবিধা নেই। ছোট–বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান শহর কেন্দ্রিক হওয়ায় কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে গ্রাম হতে মানুষ শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগে নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে ক্রমবর্ধমান শিক্ষা ও সভ্যতার আলোকে মানুষের মন মানসিকতা ও সনাতনী ব্যবস্থার মাঝে সীমিত থাকতে ইচ্ছুক নয়। সে জন্য শহরের প্রতি সকলেই আকৃষ্ট হচ্ছে। শিক্ষা চিকিৎসা গ্রাম ও শহরের মধ্যে গুণগত মানের তারতম্য অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা জোর জুলুম চাঁদাবাজি জানমালের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব গ্রামের সচেতন মানুষকে পৈতৃক সহায় সম্পত্তি ছেড়ে নিরাপদ উদ্বেগ উৎকণ্ঠা মুক্ত আশ্রয় সন্ধানে তারা শহর কেন্দ্রিক জীবন অধিক নিরাপদ ভেবে সেখানে ছুটে আসছে। অপরাজনীতি ও রাজনীতি দুর্র্বৃত্তায়নের ফলে গ্রামীণ সমাজ কাঠামো ভেঙে পড়ায় গ্রামের সহজ সরল শান্তি পূর্ণ পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় মানুষের জীবন যাত্রায় বেড়েছে সচেতনতা আধুনিক উন্নত জীবন ব্যবস্থার পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা শিক্ষা চিকিৎসা যোগাযোগ নিরাপত্তা গ্রামের সচেতন মানুষকে পরিবার পরিজন ও সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে হতাশা ও উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ফেলেছে। যেহেতু প্রত্যেক মানুষের কাছে ভালো উন্নত মানসম্মত শিক্ষা চিকিৎসা যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা বর্তমান ভবিষ্যত জীবনের গ্যারান্টির চাহিদা রয়েছে যা গ্রামে সে প্রত্যাশা এখন ও সুদূর পরাহত। সরকার শহর ও গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থার পার্থক্য সমন্বয় সাধনে সচেষ্ট হলেও যাদের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হবে তাদের বনেদি চিন্তা চেতনার কারণে ফলপ্রসূ হচ্ছে না। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় পাড়ায় মহল্লায় সন্ত্রাসী মাস্তানি চাঁদাবাজি গ্রামের শান্তশিষ্ট স্বাধীন জীবন ব্যবস্থাকে মহল বা গোষ্ঠী কেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রিত করার ফলে একটি জটিল সমাজ ব্যবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে যা গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থাতে বিরুপ প্রভাব পড়ছে।এতে গ্রামের অধিকতর সচ্ছল মানুষ সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করে শহর মুখী হতে বাধ্য হচ্ছে। উন্নত মানসম্মত আধুনিক শিক্ষা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান শহর কেন্দ্রিক হওয়ায় এবং দেশি–বিদেশী শিল্প কারখানা বিনিয়োগ ক্ষেত্র নগরে অবস্থিত বলে কর্মসংস্থানের সন্ধানে গ্রামের মানুষ বংশানুক্রমে প্রচলিত পেশা পরিবর্তন করে নগরে ছুটছে। গ্রামীণ অর্থনীতি যেমন কৃষি তাঁতী কামার কুমোর বাঁশ বেত শিল্প দর্জি বুনন কাঠ ফার্নিচার ইত্যাদি পেশাজীবীদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নে সরকারি প্রণোদনা পৃষ্ঠপোষকতা বা কোনো পরিকল্পনা না থাকায় গ্রামের এসব পেশা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা অন্য পেশার সন্ধানে নগর মুখী হওয়ায় নাগরিক জীবনে চাপ বাড়ছে। গ্রামীণ কৃষিতে সবার কর্মসংস্থান সম্ভব নয় কৃষি শ্রমে অনিশ্চয়তা ও কম নয়। অনেকে কৃষি কাজকে সম্মানজনক ও মনে করে না। গ্রামের মানুষ এক সময় স্থবির ছিল। গ্রামের মধ্যেই তাদের যাবতীয় চাহিদার অনুসঙ্গের উপর ছিল পরিতৃপ্ত। জীবন জীবিকা শিক্ষা চিকিৎসা ভ্রমণ কোনো প্রয়োজনেই তারা গ্রামের বাইরে যেত না। গ্রামে বসেই তারা অলস অকর্মণ্য জীবন যাপন করত। কৃষি মৌসুমবিহীন সময়ে অলস বেকার বসে থাকার দরুন সঞ্চিত অর্থ ও ফসল খরচ করতে হতো যার কারণে দারিদ্রতা তাদের নিত্য সঙ্গী ছিল। তাদের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা ছিল গতিহীন ও স্থির। বর্তমানে পরিপার্শ্বিক বিভিন্ন কারণে তাদের জীবনে গতিশীলতা এসেছে। গ্রামের অনেকেই মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপ আমেরিকা প্রবাসী হওয়ার সুবাদে পেশা শিক্ষা চিকিৎসা ও ভ্রমণের জন্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশ গমন করে। সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় শহরের চেয়ে গ্রামীণ জীবন ধারা আধুনিকায়নে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে যথেষ্ট নয় বলে অতি সহজে শহর ও গ্রামের মধ্যে উন্নয়ন বৈষম্য দৃশ্যমান পরিলক্ষিত হয়। গ্রামের উন্নয়নে যুগোপযোগী বাস্তবমূখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন আর্থ–সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ও অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ পরিকল্পনা কর্মসূচি না হলে শহর ও গ্রামের পার্থক্য থেকেই যাবে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির উৎকর্ষ তায় মানুষের মনমানসিকতা ও জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন ও চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে তাই প্রত্যেকটা মানুষ আধুনিক উন্নত জীবন ব্যবস্থার সন্ধানে স্থানান্তরের সুযোগ খোঁজে। শহর কেন্দ্রিক নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে শহর এলাকায় প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় গ্রামীণ বেকার ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী নতুন কর্মসংস্হানের আশায় শহরে স্থানান্তরিত হয়। গ্রামে একেবারে উন্নয়ন যে হয়নি তা নয় অতীতের চেয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অনেকটা উন্নয়ন হয়েছে যা গ্রামীণ প্রধান সড়কগুলো অন্যতম। তবে অভ্যন্তরীণ রাস্তা ঘাট অবকাঠামোগত উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে রয়েছে বঞ্চিত। গ্রামের শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত অনুন্নত পক্ষান্তরে শহরের শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা অনেক উন্নত। আর্থ–সামাজিক পরিবর্তনে গ্রামীণ পরিবারগুলোর মধ্যে নানা কারণে ভাঙন সৃষ্টি হয় একান্নবতি পরিবারের ঐতিহ্য বর্তমানে বিলুপ্ত আত্নকেন্দ্রিক মানসিকতার ফলে বাবা, মা, ভাই, বোন, ও অন্যান্য আত্নীয়স্বজনদের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে নিজ নিজ পরিবার নিয়ে শহরমুখী হওয়ার সুযোগ খোঁজে। প্রবাসীদের অধিকাংশই গ্রামের অধিবাসী রেমিটেন্সের কল্যাণে গ্রামীণ জীবন ধারায় ব্যাপক সচ্ছলতা ও চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন ঘটেছে যার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ উন্নত আধুনিক পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা সম্বলিত বিলাসী জীবন উপভোগের উপকরণ সমৃদ্ধ শহরে জীবন ব্যবস্থার চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় শহর আর গ্রামের মধ্যে উন্নয়ন বৈষম্য দৃশ্যমান পরিলক্ষিত হয় না। সেখানে নাগরিকের সেবার মান সর্বত্র সমান ভাবে প্রযোজ্য এবং উন্নত আধুনিক শিক্ষা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দাপ্তরিক প্রতিষ্ঠান শহর থেকে দূরে স্থাপন করে যাতে ঐ এলাকা উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি লাভ করে। এভাবে অখ্যাত পল্লী প্রত্যন্ত অঞ্চল ক্রমে উপশহর বা শহরে রূপান্তরিত হয়। গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরের ফলে শহরের জনসংখ্যা কাঠামোতে পরিবর্তন দেখা দেয়। সংগত কারণে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। গ্রাম্য রাজনীতির ও প্রতি হিংসার শিকার হয়ে সচ্ছল ধনী প্রবাসীদের উপর নানা অত্যাচার উৎপীড়ন চাঁদাবাজি ও নিরাপত্তার অভাব শহরমুখী প্রবণতার আর একটি কারণ। নাগরিক সুযোগ সুবিধার কারণে যাদের কর্মস্হল গ্রামে তারা ও আবাস গেড়েছে শহরে। নারী কর্মসংস্থান গার্মেন্টস শিল্প নগর কেন্দ্রিক হওয়ায় গ্রামের মহিলা কর্মজীবীরা কর্মস্থল সংলগ্ন এলাকায় বসবাসের জন্য স্বল্প ভাড়ায় আবাসস্থলের চাহিদায় নিম্নমানের বাসস্থান তথা অসংখ্য বস্তির সৃষ্টি হচ্ছে এর সাথে রয়েছে নিম্ন আয়ের শ্রমিক রিকশা চালক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী। শহরের আধুনিক উন্নত আভিজাত্য জীবন ব্যবস্থার সাথে পাল্লা দিয়ে বস্তির সম্প্রসারণ নগরীর ধনী দারিদ্রের বৈষম্যের ব্যবধান দৃশ্যমান অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ঠেকে। নগরমুখী প্রবণতা রোধ করতে গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থার উন্নয়নের অর্থনৈতিক, বেকারত্ব, কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয়, ব্যবসা–বাণিজ্য, দারিদ্র, ভৃমিহীনতা, নদী ভাঙন, গ্রামে শিল্পাঞ্চল স্থাপন, যোগাযোগ ও যাতায়াত, শিক্ষা চিকিৎসা, সামাজিক নিরাপত্তা, উন্নত জীবন ব্যবস্থার সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক