বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক সময়ে ব্যবসায়ীদের নিয়ে জরিপ চালিয়েছিল। জরিপে বলা হয়েছে, দেশে ব্যবসা সম্প্রসারণে প্রধান তিন বাধা–দুর্নীতি, অদক্ষ প্রশাসন ও পুঁজির সীমাবদ্ধতা। এছাড়া উচ্চ আয়কর, মূল্যস্ফীতি এবং বিভিন্ন বিলের কারণে ব্যবসায় ব্যয় বাড়ছে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা নেই। বাড়ছে টাকা পাচার। এসব বিষয়ের সামগ্রিক প্রভাবে টিকে থাকতে পারছে না শিল্প–প্রতিষ্ঠান।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ২ বছরে অর্থনীতির জন্য পাঁচটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হলো–বিশ্ব অর্থনীতির চাপ, ভূরাজনৈতিক সমস্যা, পরিবেশগত, সামাজিক এবং প্রযুক্তিগত ঝুঁকি। আর ব্যবসায় খরচ কমাতে আমদানি–রপ্তানি পর্যায়ে দুর্নীতি কমাতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ১০ বছরে দেশের ব্যবসাবাণিজ্যের সবচেয়ে বড় বাজার হবে ডিজিটাল সেবা। এছাড়াও ডেটা বিজনেস এবং প্লাস্টিক রিসাইক্লিং অন্যতম। অন্যদিকে আগামী ২ বছরে বৈশ্বিক ৫টি ঝুঁকি বাংলাদেশকে প্রভাবিত করবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি। বড় দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছে বাংলাদেশের যে ঋণ রয়েছে, তা অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করবে। কিছু শিল্পে বিপর্যয় আসবে। দ্বিতীয়ত, ভূরাজনৈতিক কিছু সমস্যা সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিপর্যয়, স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী আক্রমণের আশঙ্কা। তৃতীয় সমস্যা হলো পরিবেশগত ঝুঁকি। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতা এবং মানবসৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যা। চতুর্থ সমস্যা সামাজিক। বিপুলসংখ্যক লোকের বেকার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়াও অপ্রত্যাশিত বিভিন্ন রোগ এবং নিরাপত্তা অন্যতম। তাঁদের বিবেচনায় আগামী ২ বছরে সর্বশেষ সমস্যা হবে প্রযুক্তিগত ঝুঁকি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ে ধ্বংসের মুখে দেশের অর্থনীতি। অবরোধ–হরতালের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি কার্যকারিতা হারিয়ে এখন ভীতিকর একটি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আগে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মানুষের সাড়া পাওয়া যেত। এখন রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। চলমান রাজনৈতিক কর্মসূচি শুধু বাংলাদেশের জন্যই যে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির কারণ হচ্ছে তা নয়, বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছেও নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। যানবাহনে হামলা, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া, পণ্য পরিবহনে বাধা দেওয়ার মতো ঘটনা দেশের অভ্যন্তরে স্বাভাবিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরে না। বাংলাদেশের গত কয়েক বছরের অর্জন মুছে যেতে বসেছে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে। শিল্প–কারখানার উৎপাদন কমে গেছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগ ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। বলা যায়, অর্থনীতির সংকট অনেক বেশি ঘনীভূত হয়েছে; কিন্তু তা সমাধানে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে না। এখন সংকট সমাধানে কেউ কেউ সরকারের সক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন। পিআরআই বলছে, সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গত এক বছরে যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, তা গত ৫০ বছরেও নেওয়া হয়নি। ফলে ব্যাংক খাতে এখন পর্যাপ্ত অর্থ নেই। তাতে সরকারের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমে এসেছে। তাঁরা বলেন, ‘সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক। প্রথম কাজ রাজস্ব ঘাটতি কমিয়ে আনার জন্য জোর প্রচেষ্টা নিতে হবে এবং সেজন্য সরকারের ব্যয় সংকোচন করতে হবে। ডলারের সংকট কাটাতে বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহারের সীমা তুলে দিতে হবে। সরকার রাজনীতিতে জয়ী হবে নিশ্চয়ই, তবে অর্থনীতির মুখেও চওড়া হাসি ফোটালে সেটিই হবে মানুষের জন্য বড় পাওয়া।’
এতো এতো সমস্যা বা অভিযোগ সত্ত্বেও বলা যায়, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে আমরা জানি, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত স্থিতিশীল পরিবেশ। উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে কঠোর পরিশ্রম ও সততার সঙ্গে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। বিশ্লেষকরা বলেন, দেশ আজ উন্নয়নশীল পর্যায় থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের দ্বারপ্রান্তে। দেশের এই ধারাবাহিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখা জরুরি। এজন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তা অর্জনে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থিতিশীলতা জরুরি।