স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হওয়ার পূর্বে নগরী তিনবার রাজধানী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। প্রথমত মোঘল আমলে, দ্বিতীয়ত ব্রিটিশ আমলে এবং তৃতীয়ত পাকিস্তান আমলে। অবশ্য এ তিনবারই ঢাকা হয়েছিল প্রাদেশিক রাজধানী। দীর্ঘদিন রাজধানী থাকার ফলে সঙ্গত কারণেই ঢাকা নগরী রাজনৈতিকভাবে যেমন গুরুত্ব অর্জন করে, ঠিক তেমনি অর্থনীতিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও ঘটে উন্নয়ন। শিক্ষাও এই উন্নয়নের ক্ষেত্র থেকে আলাদা ছিল না। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের শিক্ষা ব্যবস্থার মত ঢাকা নগরীর শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। এর ফলে বাংলা সমাজ বিবর্তনের ধারায় ঢাকার শিক্ষা ব্যবস্থা দীর্ঘ সময়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে।
আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতি
উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ঢাকা শহরে কতিপয় কলেজ ও ইংরেজি বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। এ সময়ে ঢাকার শিক্ষার হার বৃদ্ধির পাশাপাশি একটি আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ঢাকায় কখন একটি আধুনিক মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভব ঘটে, যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আধুনিক জনমতের সৃষ্টি হয়? বলা যায় যে, ঢাকার মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভব ঘটতে থাকে উনিশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে। এর পূর্বে (১৭৬৫-১৮৩৯ পর্যন্ত) দীর্ঘ ৭৬ বছর কোম্পানি সরকার ঢাকা শহর উন্নতিকল্পে কোনো নীতি বা পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি।
উনিশ শতকে ভৌগোলিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে সরকার আঞ্চলিক প্রশাসন ও বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে নজরে দেয়। এ সময়কাল থেকে ঢাকাকে বস্তুত সরকারি নথিপত্রে পূর্ববাংলার রাজধানী রূপে গণ্য করা হয়। বর্তমনে যে শিক্ষা ব্যবস্থা ঢাকা তথা বাংলাদেশে চালু আছে তার গোড়াপত্তন হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হওয়ার পর। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসা, কারিগরি-প্রকৌশল প্রভৃতি শিক্ষার যে ধারা এখন বিকশিত তার উৎসকাল ব্রিটিনের ঔপনিবেশিক শাসনের সময়েই। এক্ষেত্রে ঢাকায় যে সকল আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকাশ লাভ করে তা পূর্ব বাংলার জনজীবনে বিশেষ অবদান রাখে। ১৮২৩ সালে গঠিত হয় Committee for Public Instruction. এই সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে একটি বির্তক দেখা দিয়েছিল ভারতবর্ষে কোন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা থাকবে; পাশ্চাত্য না প্রাচ্য? শেষ পর্যন্ত প্রাশ্চাত্য শিক্ষাকে উৎসাহ দানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১৮৩৫ সালে ঢাকা শহরের আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে সরকার লোকাল এজুকেইশন কমিটি গঠন করা হয়। ১৮৪০ সালে কোম্পানি সরকার ঢাকার গুরুত্ব অনুধাবন করে পৌর কমিটি গঠন করে। ১৮৫৮ সালের ১৮ অক্টোবরে কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে টেলিগ্রাফের সংযোগ স্থাপন করা হয়। এ সময় ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-নারায়নগঞ্জ রেললাইন চালু করা হয়, যা ঢাকার জন-জীবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। ফলে ব্যবসায়ী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষিত মানুষের সমাগম ঘটে ঢাকা শহরে। উনিশ শতকের আশি দশকে ঢাকা কলকাতার পরেই বাংলা প্রদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। প্রশাসনিক উন্নতির সঙ্গে শিক্ষার কেন্দ্র প্রসারের একটি সম্পর্ক রয়েছে। প্রশাসনের বিভিন্ন দফতর স্থাপনের পর আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়। এই আধুনিক শিক্ষা প্রসারের ফলে ঢাকায় একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয় এবং তাদের মধ্য থেকেই আধুনিক সংবাদপত্র ও সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার উদ্ভব ঘটে।
উনিশ শতকের চল্লিশ দশকের দিকে ঢাকায় যে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ঘটতে শুরু করে, সে আধুনিক শিক্ষার সুযোগ হিন্দু-মুসলিম সমপ্রদায়গত জনগণ সমভাবে তা গ্রহণ করতে পারেনি। আধুনিক শিক্ষা অধিক গ্রহণ করেছিল হিন্দু সমপ্রদায়। যদিও পূর্ব বাংলা ও ঢাকা ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। আর তা ঘটেছিল ঐতিহাসিক কারণেই। ঢাকার সন্নিকটে প্রাচীন বাংলার রাজধানী বিক্রমপুর পূর্ব থেকেই উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ইংরেজ শাসনের শুরুতে এসে তা অব্যাহত থাকে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৮৫৪ সালেই বিক্রমপুরে একটি ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বলা বাহুল্য, ঢাকায় আধুনিক জনমতের উদ্ভবের ক্ষেত্রে এদের ব্যাপক অংশীদারিত্ব ছিল। ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুল নামে ঢাকার প্রথম ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘ঢাকা ঃ ইতিহাস ও নগর জীবন’ এর লেখক শরীফ উদ্দীন আহমেদ লিখেন, “ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী সময়ে এর অভাবনীয় শ্রী বৃদ্ধি যে ঢাকা শহরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনই ঘটায়, তাই নয়, এর পশ্চাৎ ভূমিতেও এক নবযুগের সূচনা করে।”
১৮৪১ সালে ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষানীতির পরিবর্তনের ঢেউ ঢাকার জীবনেও প্রভাবিত হয়। এই নীতির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুলের সঙ্গে একটি কলেজ শাখা চালু করা হয়। এর নাম দেওয়া হয় ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ। এটি ঢাকার প্রথম উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজই পরবর্তীকালে ঢাকা কলেজ নামকরণ করা হয়। ১৮৪১ সালে যদিও ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুলকে কেন্দ্রীয় কলেজে (ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল) রূপান্তরিত করা হয়। ঢাকা কলেজ ইতিহাস ও ঐতিহ্য ১৮৪১-১৯২১ এর লেখক শরীফ উদ্দিন আহমেদ লিখেন, ১৮৪১ সালের ৭ জুলাই এবং ১১ আগস্ট মাসের মধ্যবর্তী কোনো এক শুভদিনে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
ঢাকায় শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রথম প্রতিষ্ঠা করা হয় ব্রিটিশ আমলে। ১৮৫৭ সালে প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৮৭৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে ঢাকা শহরে ্একটি মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়। ঢাকায় মেডিকেল শিক্ষা প্রথম চালু হয় ১৮৮৯ সালে। এর ফলশ্রুতিতে মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় এবং স্কুলের সংলগ্ন একটি হাসপাতালও গড়ে ওঠে। বলা বাহুল্য, কালের বিবর্তনের পর ১৯০৯ সালে মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য কলেজও প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৯২১ সালের ১ জুলাই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা কলেজকে ছোট লাটের বাস ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলকে কলেজের হোস্টেল হিসেবে রূপান্তরিত করা হয়। আর ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলটি সেক্রেটারিয়েট ভবনে স্থানান্তর করা হয়। কলেজটি লক্ষ্মীবাজারে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজটি (বর্তমান কবি নজরুল ইসলাম কলেজ) সিদ্দিক বাজারে অবস্থিত খান বাহাদুর আব্দুল হাইয়ের একটি ব্যক্তিগত ভবনে পুনঃস্থাপিত করা হয়। কালপর্বে ঢাকায় ১৯৬৩ সালে মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে রুপান্তরিত করা হয়। আর ১৯৪৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হয় এবং মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থা আরো উন্নত করার জন্য বর্তমান সরকার মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে ডেন্টাল কলেজ ও নার্সিং কলেজ স্থাপন করা হয়েছে। পাক-ভারত উপমহাদেশ তথা ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতা মাদ্রাসার আরবি বিভাগ ঢাকায় স্থানান্তরিত করা হয়।
১৯৬০ এর দশক থেকে ঢাকা শহরে সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোর পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেন নামক স্কুল গড়ে ওঠতে শুরু করে। পাশ্চাত্য ধারার উচ্চ বেতনের এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণত প্রাইমারি বিদ্যালয়ের চেয়ে ভিন্নতর ও উন্নতর পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা হয়। এছাড়াও ইংরেজি শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় অধিকতর মাত্রায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ঘোষণার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা হিসেবে মর্যাদা পায়। ১৯৭৬ সাল থেকে এ পদ্ধতির শিক্ষাদান ব্যাপকতা লাভ করে।
কালক্রমে জনগণের চাহিদার নিরিখে ঢাকায় শরীর চর্চা শিক্ষা বিষয়ক কলেজ এবং চারু ও চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীকালে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইনষ্টিটিউট এ পরিণত হয়। স্বাধীনতা উত্তরকালে ঢাকায় টেক্্রটাইল টেকনোলজি কলেজ ও লেদার টেকনোলজি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিশ্বের সাথে সংগতি রেখে সরকার বাংলাদেশ টেক্্রটাইল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। আর কৃষি শিক্ষার ব্যাপকতার কথা চিন্তা করে সরকার কৃষি কলেজ থেকে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রুপান্তর করেন। ঢাকায় বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ তথা ঢাকায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠেছে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
লেখক : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম