শহীদ বুদ্ধিজীবীরা বারবার ফিরে ফিরে আসেন বাঙালির মানসপটে। প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে প্রতিভাত হয় কবির সেই অমিয়বাণী :
‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী
ভয় নাই ওরে ভয় নাই
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
শোককে শক্তিতে পরিণত করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করে সমগ্র জাতি। আজ সেই ১৪ই ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক বেদনাঘন দিন। জাতির একটি অত্যন্ত শোকাবহ দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে হানাদার পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল পরাক্রমের সামনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতেছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বাহ্নেই শোষক পাকিস্তানী প্রশাসন বুঝতে পেরেছিল এদেশের সহজ-সরল মানুষগুলোকে আর শাসন-শোষণ করা যাবে না। বাঙালি জেগে উঠেছে। এদেশে পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের পতন অনিবার্য। এটা কেবল কিছু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এই পরাজয়কে সহজে মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। তারা চেয়েছিল বাঙালিকে মেধা-মননশূন্য করতে। এ জন্য তারা বেছে বেছে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দার্শনিক ও সংস্কৃতিক্ষেত্রের অগ্রগণ্য মানুষদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকিস্তানি ঘাতকদের এ বর্বর হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছিল রাজাকার-আলবদর বাহিনী।
বুদ্ধিজীবীরা হলেন জাতির বিবেক। তাঁরা অন্ধকারে আলো জ্বালান। একটি জাতিকে মেধাগত দিক থেকে এগিয়ে নেন। পাকিস্তানিরা এবং তাদের বশংবদরা এটিকে অপরাধ বলে ভেবেছিল। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন তাদের প্রতিহিংসার শিকার। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে যখন পাকিস্তানিদের পরাজয় অনিবার্য হয়ে উঠেছে তখনো নির্মমভাবে চলেছে বুদ্ধিজীবী হত্যা। এমনকি পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের দু’দিন আগেও বেশ ক’জন বুদ্ধিজীবীকে চোখ বেঁধে তাদের বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে যায় আল-বদর সদস্যরা। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাদের চোখ ও হাত বাঁধা ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। বুদ্ধিজীবী হত্যায় কারা জড়িত ছিল তা একটি ওপেন সিক্রেট।
কারণ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বজনরা জানেন কারা তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল, কী ছিল তাদের পরিচয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় স্বাধীনতার পর প্রায় চার দশক কেটে গেছে বুদ্ধিজীবী হত্যার অপনায়কদের বিচার শুরু করতে। একাত্তরের ডিসেম্বরে হত্যাযজ্ঞের শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা এখনও নিরূপণ করা হয়নি। প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাপিডিয়ায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যে সংখ্যা দেয়া হয়েছে সে অনুযায়ী একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ শিক্ষাবিদ, ১৩ সাংবাদিক, ৪৯ চিকিৎসক, ৪২ আইনজীবী এবং ১৬ শিল্পী, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী।
তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ড. জি সি দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজউদ্দীন হোসেন, নিজামুদ্দিন আহমেদ লাডু ভাই, খন্দকার আবু তালেব, আনম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, নাজমুল হক, আলতাফ মাহমুদ, নূতন চন্দ্র সিংহ, আরপি সাহা, আবুল খায়ের, রশীদুল হাসান, সিরাজুল হক খান, আবুল বাশার, ড. মুক্তাদির, ফজলুল মাহি, ড. সাদেক, ড. আমিনুদ্দিন, হাবিবুর রহমান, মেহেরুন্নেসা, সেলিনা পারভীন, সায়ীদুল হাসান প্রমুখ।
বুদ্ধিজীবীরা দেশ ও জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির রূপকার এবং সর্বকালে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের এই আত্মত্যাগ জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রেখে যাওয়া আদর্শ ও পথকে অনুসরণ করে অসামপ্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সমাজ গড়তে পারলেই তাঁদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। দল-মত-নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিককে একাত্তরের ঘাতক, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী চক্রের সকল ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
জাতিকে মেধাশূন্য করার যে প্রক্রিয়া একাত্তরের ঘাতকচক্র শুরু করেছিল তাদের উত্তরসূরিরাও একই উদ্দেশ্যে এই দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে নানা ভুল তথ্য, ভুল ইতিহাস পরিবেশন করে যাচ্ছে যাতে করে এদেশের মানুষ একটা বিভ্রান্ত জাতিতে পরিণত হয়। এই ঘাতকদালালদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা না হলে জাতির সামনে আরো ভয়াবহ সময় আসবে এতে কোনো ভুল নেই। পরিশেষে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ।