আমাদের দেশে বর্তমানে নারী উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। ২০১৩ সালের ইকোনমিক শুমারি অনুযায়ী নারী উদ্যোগ শূন্য দশমিক ৫৬ মিলিয়ন বা মোট আট লাখ উদ্যোক্তার প্রায় ৭ দশমিক ২ শতাংশ। সন্দেহাতীতভাবে এ সংখ্যা এখন অনেক বেড়েছে। শুধু ই–কমার্সের ক্ষেত্রেই বর্তমানে ব্যাপক হারে নারী উদ্যোক্তা কাজ করছেন। যদিও স্বল্প পরিসরে, তবে সহায়তা পেলে এ খাত যথাসম্ভব উন্নতি করবে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, এক দশকের ব্যবধানে নারী উদ্যোক্তা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। হোলসেল অ্যান্ড রিটেইল ট্রেড সার্ভে–২০২০ এর জরিপে বলা হয়েছিলো যে, ২০১৯–২০ অর্থ বছরে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ছিলো দু লাখেরও বেশি যা ২০০২–০৩ অর্থ বছরে ছিলো মাত্র ২১ হাজার। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে ব্যবসা করছেন আরও কয়েক লাখ উদ্যোক্তা। যদিও একজন উদ্যোক্তা বলছেন ব্যবসা বড় হলে সংকট বাড়ে কারণ এলসি খুলতে, নগদ সুবিধা পাওয়া কিংবা জিএসপি সনদ পাওয়া ও নবায়ন করতে নারীদের অনেক বেশি অর্থ ও সময় দিতে হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রথমে মনে করা হতো, নারী শুধু হস্তশিল্প, কিছু কুটির এবং ক্ষুদ্র শিল্পের ক্ষেত্রে খুবই ছোট পরিসরে কাজ করবেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সে ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। বেশ বড় ধরনের উদোগ নিয়ে নারীরা এগিয়ে এসেছেন। নারী উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান সরকারি ক্রয়েও অংশগ্রহণ করছেন, যদিও এ সংখ্যা বেশি তবে তা বাড়ছে। এছাড়া কভিডকালে ই–কমার্সের জাগরণ সবারই জানা। এ পর্যন্ত দেখা গিয়েছে, শুধু নারী নামধারী ব্যবসাকে নারী দিয়ে পরিচালিত ব্যবসা বলে ধরে নেয়া হতো, প্রকৃতপক্ষে তা সঠিক নয়। একজন পুরুষ উদ্যোক্তা সংগত কারণে তার ব্যবসা বৃদ্ধির প্রয়োজনে তার স্ত্রী বা কন্যার নামে ব্যবসা শুরু করতে পারেন। হয়তো এ উদ্যোগ সম্পর্কে নারী সদস্য তেমন কিছু জানেন না বা তার সরাসরি অংশগ্রহণ নেই, তাকে কি নারী উদ্যোক্তা বলা যাবে। বা কোনো নারী অংশীদারত্ব রয়েছে এমন ব্যবসায়কে কি নারী পরিচালিত ব্যবসা বলা যায়। অথবা এসব ক্ষেত্রে তার অবদানকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে। জাতীয় অর্থনীতিতে আমরা এখনো জানি না জিডিপিতে প্রায় ৮০ শতাংশ বেসরকারি খাতের অবদানের মধ্যে কত ভাগ নারী উদ্যোক্তাদের, কারণ কোনো ডিজঅ্যাগ্রিগেটেড ডাটা নেই।
বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)-এর প্রধান নির্বাহী ফেরদাউস আরা বেগম তাঁর এক লেখায় বলেছেন,
বর্তমানে সরকার নারী উদ্যোগকে আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে সরকার নানা ধরনের প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন, যার সুযোগ কেবল নারী উদ্যোক্তাই গ্রহণ করতে পারেন। বেশকিছু অর্থায়ন স্কিম রয়েছে নারীদের জন্য। কিন্তু কারা এ মহিলা বা নারী উদ্যোক্তা। ব্যাংকগুলো তাদের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা পূরণ করতে পারে না। কারণ তারা নারী উদ্যোক্তা খুঁজে পায় না। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছে কিন্তু তফসিলি ব্যাংকগুলো সঠিক নারী উদ্যোক্তা চিহ্নিত করতে পারে না যে তাদের ঋণ দিয়ে সহায়তা করবে। বিশ্বের বহু দেশই নারী উদ্যোগের প্রসারে বহু রকমের নীতিমালা গ্রহণ করেছে, কিন্তু কাদের নারী উদ্যোক্তা বলা হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে এ সংজ্ঞা ব্যবহার করছে। এমনকি একই দেশে বিভিন্ন ধরনের সংজ্ঞাও ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে একজন নারী শুধু চাকরির বাজারে নয়, বরং নিজে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
অনলাইনভিত্তিক উদ্যোগে বস্ত্র, গয়না, সাংসারিক পণ্য, শিশুখাদ্য, প্রসাধনীর আধিক্য দেখা গেলেও সীমিতসংখ্যক সেবা ও প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো। এই মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের তুলনামূলক বেশি উপস্থিতি লক্ষণীয়। একটু গভীরে গেলেই বোঝা যায় যে সামাজিক, পারিবারিক দায়বদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা বিশেষ বাধা হয়ে দাঁড়ায় না বলে অনলাইন উদ্যোগে নারীদের এই স্বচ্ছন্দ পদচারণা। কোন ধরনের ব্যবসায় উদ্যোগী হবেন এই সিদ্ধান্ত নিতে যে বিষয়গুলো বিবেচ্য হওয়া উচিত তা হলো: জ্ঞান আহরণ এবং দক্ষতা, নিজস্ব আগ্রহ, অভিজ্ঞতা, পুঁজির পরিমাণ, প্রশিক্ষণ (অনলাইন, অফলাইন), বাজার চাহিদা, সামাজিক, ব্যক্তিগত, সামষ্টিক সমস্যা সমাধানে পারদর্শিতা বা উদ্ভাবনী পন্থা, ব্যক্তিগত যোগাযোগ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রধান বাধা হিসেবে যেটি বিবেচনা করা হয় তা হলো আমাদের সংস্কৃতি। যেখানে আমরা নারীকে একটি নির্দিষ্ট ভূমিকায় দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু সময় পাল্টেছে, বাস্তবতা এখন ভিন্ন। ৩০ বছর আগের বাংলাদেশের অর্থনীতি আর ২০২৩ এর অর্থনীতির হিসাব ভিন্ন। এখন পারিবারিক দায়িত্ববোধের সঙ্গে সঙ্গে একজন নারী তাঁর সত্তাকে এই সমাজে সফলভাবে পরিচিত করে তুলতে সক্ষম। নারী উদ্যোক্তা হতে হলে প্রথমেই মনে রাখা দরকার যে, প্রত্যেক উদ্যোক্তাকে নিজের ব্যবসা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা এবং এলাকাভিত্তিক চাহিদা নিরূপণ করতে হবে।