উদ্যোক্তা সৃষ্টির দিকে মনোযোগ দিতে হবে

| রবিবার , ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ

রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত ‘গ্রামীণ জীবিকা পরিবর্তন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সহনশীলতা উদ্যোগ’ শীর্ষক কর্মশালায় বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে ২০০০ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এক দশক পর ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২২ সাল পর্যন্ত দারিদ্র্যের হার ১২ দশমিক ৮ শতাংশ কমে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। তবে দুর্বল শ্রম আয়, চাকরি হারানো এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দারিদ্র্য আরো বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

সামাজিক উন্নয়ন ফাউন্ডেশন (এসডিএফ) এবং বিশ্বব্যাংক যৌথভাবে এ কর্মশালার আয়োজন করে। কর্মশালায় বক্তারা বলেন, ‘২০২২২৫ সাল অর্থাৎ তিন বছরে দেশে দারিদ্র্য ২ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে ২১ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে। এরই মধ্যে গত তিন বছরে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কাছাকাছি চলে এসেছে। দারিদ্র্যের সংখ্যা বাড়ার এ প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে বলেও আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এসডিএফের সভাপতি ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘গত তিন বছরে মানুষের জীবনযাত্রার মানসিকতা এবং আয়ের পরিবর্তন বিবেচনা করলে দেখা যায়, প্রায় ৯০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কাছাকাছি চলে এসেছে। সুতরাং এটি একটি সংকেত। দারিদ্র্য দূর করার জন্য বর্তমানে বাংলাদেশে যে মডেল বা কৌশলগুলো আছে, সেগুলো কি সঠিকভাবে কাজ করছে?’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকারের সামাজিক সুরক্ষা নীতিতে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মা ও শিশু সুবিধা এবং স্কুলের শিশুদের জন্য নেয়া কর্মসূচিসহ প্রায় ৯৫টি পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু পরিসংখ্যান ব্যুরোর২০২২ সালের তথ্য বিশ্লেষণ বলছে, দারিদ্র্যসীমার আয় নিচের দিকে, যা উদ্বেগজনক।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা দরিদ্র মানুষ প্রত্যাশিত হারে এ ভাতা পাচ্ছে না। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে মাত্র ৩৭ শতাংশ লোক সরকারি অনুদান পাচ্ছে।’

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ দারিদ্র্য নিরসনে বেশ সাফল্য দেখিয়েছে। এ সফলতা ২০১০ সাল থেকে শুরু হয়ে ক্রমাগত অব্যাহত ছিল। কিন্তু ২০২২ সাল থেকে এটি কিছুটা বিপরীত প্রবণতা দেখাচ্ছে। দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি, যা দারিদ্র্য নিরসন কাজকে আরো চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে।’ সারা জীবন শুধু ঋণ বা ধার না নিয়ে বরং উদ্যোক্তা সৃষ্টির দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত বলে মনে করেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি নিজে থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে, তবে তা অনেক বেশি কার্যকর। একজন উদ্যোক্তা হওয়ার সুবিধা হলো তিনি নিজে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অন্যকেও কাজ দিতে পারেন। ফলে মজুরিভিত্তিক কাজ বাড়ে। একটি উদ্যোগ বা প্রতিষ্ঠান সফল করতে হলে দক্ষতার উন্নতি বা কৌশল বিকাশ প্রয়োজন, যা সামগ্রিকভাবে সমাজে ভালো প্রভাব ফেলে।’

বিশ্লেষকরা বলেন, দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশ সাফল্য দেখালেও হঠাৎ ছন্দপতন ঘটেছে। কোভিডের পর পর আবার দারিদ্র্য বাড়তে শুরু করেছে। তিন বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। তাতে বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। আবার কয়েক বছর ধরে দেশিবিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি থমকে আছে। ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে। ফলে কাজ প্রত্যাশীরা বিপাকে পড়েছেন। এটিও দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।

সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) ‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউসহোল্ড লেবেল ইন মিড ২০২৫’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮ শতাংশ মানুষ যেকোনো সময় গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মানে হলো, গত তিন বছরের মধ্যে দরিদ্র লোকের সংখ্যা বেড়েছে প্রতি ১০০ জনে ১০ জন। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রতি ৪ জনে ১ জন দরিদ্র মানুষ। অথচ ২০১৬ সালের বিবিএসের হিসাবে, দেশে দারিদ্র্য হার ছিল ২৪ শতাংশের মতো। পিপিআরসির মতো সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, ২০২৩২৪ অর্থবছরে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে ২০ শতাংশ। ২০২৪২৫ অর্থবছরে এসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২১ দশমিক ২ শতাংশে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ দারিদ্র বিমোচনে ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছে। দারিদ্র সীমার নিচের অনেক জনগোষ্ঠীই সামাজিক সুরক্ষা খাতের সেবা পাচ্ছেন না। এ খাতের পরিকল্পনাগত দুর্বলতা ও লক্ষ্য মাফিক কাজের ঘাটতির কারণে দরিদ্র মানুষেরা সেবাবঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন। দারিদ্র্য নির্মূলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত, উন্নয়ন সংস্থা ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। দারিদ্র্য দূরীকরণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মানসম্মত শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির ওপর জোর দেয়া জরুরি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে