পরিবেশ রক্ষায় গাছপালার ভূমিকা যে সর্বাধিক তা বলাই বাহুল্য। উদ্ভিদ নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে, অন্য কোনো প্রাণী নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে না। সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভিদ কার্বোহাইড্রেট বা গ্লুকোজ নামক মৌলিক খাদ্য উপাদান প্রস্তুত করে। তারপর পর্যায়ক্রমে তার রূপান্তর ঘটে এক শ্রেণি থেকে অন্য শ্রেণিতে স্থানান্তরিত হয়ে শক্তির যোগান দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রত্যেক প্রাণীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শক্তির জন্য উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল, তা সে মাংসাশী হোক বা নিরামিষাশিই হোক। তাই উদ্ভিদ হলো উৎপাদক আর বাকি সব প্রাণীই ভক্ষক। এক কথায় উদ্ভিদ ছাড়া এ পৃথিবীতে জীবন অকল্পনীয়।
অতি সম্প্রতি সিএনএনের খবরে বলা হয়, বিশ্বে উদ্ভিদের প্রায় ৪০ ভাগ প্রজাতি বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান রয়্যাল বোটানিক গার্ডেনস কিউ এক নতুন প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। ‘স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস প্ল্যান্টস অ্যান্ড ফানজি ২০২০’ নামের এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘মানুষের খাবারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে গাছপালা কেটে জমি পরিষ্কার করার ফলে বনভূমি উজাড়ের হার বেড়েছে, বিশ্বে কার্বন ডাই অঙাইডের নিঃসরণ জলবায়ু ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, নতুন রোগজীবাণু আমাদের খাদ্যশস্য ও স্বাস্থ্যকে হুমকিতে ফেলেছে, অবৈধ বাণিজ্য বৃক্ষরাজিকে বিনাশ করছে।’
গবেষকেরা বলছেন, যেসব প্রজাতির উদ্ভিদ বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে তার অনেকগুলোই ঔষধি বৃক্ষ। গবেষণায় ৫ হাজার ৪১১টি ঔষধি বৃক্ষের ওপর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এগুলোর মধ্যে ৭২৩টিই রয়েছে বিলুপ্তির হুমকিতে। গবেষকেরা বলছেন, আমরা এরই মধ্যে এসব জেনেছি। কিন্তু বৃক্ষ সম্পর্কে আমাদের জানাশোনায় বড় ফাঁক রয়েছে। উদ্ভিদের প্রজাতিগুলো রক্ষায় আমাদের আরও কাজ করা প্রয়োজন। আরবিজি কিউয়ের পরিচালক (বিজ্ঞান) আলেকজান্ডার অ্যান্টোনেলি বলেন, ‘আমরা এত দ্রুত বিভিন্ন উদ্ভিদ প্রজাতি হারাচ্ছি যে, আমরা এগুলোর নাম বলে সারতে পারছি না। এ যেন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ে চলা।’
এ পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে মাতৃবৃক্ষ সংরক্ষণ এবং বিপন্ন, বিপন্নপ্রায় এবং বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়ার সংবাদ আমাদের আশান্বিত করে। খাগড়াছড়ি-মাটিরাঙা সড়কের লাগোয়া রিছাং ঝরনা সংলগ্ন এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপন্ন প্রজাতির বৃক্ষের প্রথম জার্মপ্লাজম সেন্টারটি। এই সেন্টারের আয়তন প্রায় ৪৩ একর। গতকাল ১৯ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত ‘পাহাড়ে বিপন্ন উদ্ভিদ রক্ষায় প্রথম উদ্যোগ : খাগড়াছড়িতে জার্মপ্লাজম সেন্টার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর এটি গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। বতর্মানে জার্মপ্লাজম সেন্টারে ৩৬ প্রজাতির বিপন্ন, বিপন্নপ্রায় ও বিরল প্রজাতির ৩ হাজার ২৭৯ বৃক্ষের চারা রোপণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রহেরা, হরিতকি, মাইলা আম, বুদ্ধ নারিকেল, অরমোসিয়া, মহুয়া, বঙবাদাম, চিকারাশি, কড়ই, রেইনট্রি, সিভিট, বাটনা, বৈলা আম, পিটালি, কুসুম, রক্তচন্দন, জলপাই, উদাল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, কানাইদিঙ্গা, নাগেশ্বরচাঁপা, পাদুক, ইউভেরিয়া, কাঞ্চন, কালাহুজা, বন পিতরাজ, জিয়াপাটি, ভূঁইয়া, বাউপাতা, পিতরাজ, চুওয়াংগ্রী, ভুদম, গর্জন ও কাজল ভাদি। জার্মপ্লাজম সেন্টারে ২১টি প্লট করা হয়েছে। প্রতিটি প্লটের আকার প্রায় ২ একর। বৃক্ষের পাশাপাশি এখানে বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ ও বেতের চারা রোপণ করা হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাধারণ ধারণার চেয়ে বিশ্বে ৫০০ গুণ দ্রুতগতিতে গাছ বিলুপ্তির ঘটনা ঘটছে। কিন্তু বিষয়টি সেভাবে মনোযোগ পাচ্ছে না। একটি শতকে বিলুপ্ত হওয়া পশুপাখির সম্পর্কে হয়তো মানুষ মোটাদাগে একটি ধারণা রাখে। কিন্তু গাছের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে না। অনেকেই বলতে পারবে না, কোন গাছটি এখন আর দেখা যায় না।
গবেষকেরা বলছেন, এই বিলুপ্তির পেছনে মানুষ অনেকাংশে দায়ী। প্রাকৃতিকভাবে প্রজাতি বিলুপ্তির গতি শুধু মানুষের উপস্থিতির কারণেই বেড়ে গেছে ৫০০ গুণ। তাঁদের মতে, এমনকি বিলুপ্ত উদ্ভিদের যে সংখ্যা উঠে এসেছে, তাও বর্তমান বিলুপ্তির গতি বোঝার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ, বর্তমানে মানুষের প্রকৃতি-ধ্বংসী কাজ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়ে গেছে। উদ্ভিদ প্রজাতির বিলুপ্তি ঠেকাতে বেশ কিছু প্রস্তাব রেখেছেন গবেষকেরা। এর মধ্যে রয়েছে, পৃথিবীর সব উদ্ভিদ প্রজাতির নিবন্ধন, উদ্ভিদের নমুনা সংরক্ষণের ব্যবস্থা জোরদার, উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের সার্বিক সহযোগিতা এবং অবশ্যই স্থানীয় উদ্ভিদের সঙ্গে শিশুদের পরিচয় ঘটানোর কাজটি করা।
সে হিসেবে জার্মপ্লাজম সেন্টার গড়ে তোলা হলে আমাদের এ অঞ্চলে বিপন্ন উদ্ভিদ রক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হবে বলে আমরা আশা করি। জার্মপ্লাজম সেন্টার পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের একটি কর্মসূচি। প্রতিবেদনে জানা যায়, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে যে সমস্ত বৃক্ষ প্রজাতি ছিল, যেগুলো বিরল, বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, সেসব প্রজাতি জার্মপ্লাজম সেন্টারে রোপণ করা হবে। ইতোমধ্যে ৩৬ প্রজাতির বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে বন নিয়ে যারা গবেষণা করবেন তাদেরও সহায়ক হবে জার্মপ্লাজম সেন্টার। ভবিষ্যতে এখান থেকে বীজ ও চারা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। বিপন্ন উদ্ভিদ রক্ষায় এ উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়িত হোক, সেটাই কামনা। পাশাপাশি উদ্ভিদ প্রজাতির বিলুপ্তি ঠেকাতে মানুষের প্রকৃতি-ধ্বংসী কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।