উদীচীর ‘যুদ্ধ’, উদীচীর যোদ্ধা

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২১ নভেম্বর, ২০২১ at ৯:৩৫ পূর্বাহ্ণ

সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিনিয়ত গ্রাস করে চলেছে আমাদের আত্মাকে। আমাদের মনন ও চেতনার মাঝে আসন গাড়তে চাইছে। আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে করছে কলুষিত। একদিকে সংস্কৃতির সংকট, সম্প্রীতির সংকীর্ণতা এবং অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাসবাদ এসে রাষ্ট্রকে করে তুলেছে বিপন্ন। এমন সংকটকালীনে প্রয়োজন শুভ বুদ্ধির, প্রয়োজন সংস্কৃতির আলোতে অন্ধকারের বিনাশ ঘটানোর মতো এক ঝাঁক লড়াকু যোদ্ধার। উদীচী দশকের পর দশক ধরে সেই লড়াকু যোদ্ধা তৈরির কাজটাই করে চলেছে। বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বাংলাদেশ গড়তে উদীচী সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
বিপ্লবী, সাম্যবাদী রাজনীতিক ও কথাশিল্পী সত্যেন সেন বহু আগেই একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। আর বহু মানুষের সমন্বয়ে একটি সংগঠন ছাড়া এই প্রগতিশীল কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেওয়া যে সম্ভব নয় সেটাও তিনি জানতেন, এও জানতেন একমাত্র তরুণ সমাজের অংশগ্রহণেই এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান সম্ভব। ১৯৬৮ সালে স্বাধিকার, সার্বভৌম ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার দাবিতে সমগ্র পূর্ববাংলা যখন উত্তাল সেই সময়ে সত্যেন সেন সহযোদ্ধা রনেশ দাশগুপ্তকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।
১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেনের উপস্থিতিতে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সংস্কৃতিকর্মী এমদাদুল হক খানের বাসায় উদীচী, চট্টগ্রাম জেলা সংসদ গঠিত হয়। ১১ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ও ৮১ জন সদস্য নিয়ে উদীচীর যাত্রা শুরু। ১৯৭২ সালে চট্টগ্রামে শাখা গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন মৃদুল সেন, মিহির নন্দী, আবদুল আউয়াল, অমিত চন্দ, ত্রিদিব চৌধুরী, রবীন দে, তপন শীল প্রমুখ। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই উদীচী, চট্টগ্রাম বাঙালি সংস্কৃতি চর্চায় নিয়ামক ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যবসায়ী আবুল মনসুর চৌধুরীর নন্দনকাননস্থ বাসভবনে উদীচীর প্রথম মহড়া অনুষ্ঠিত হয়।
গণসঙ্গীত চর্চা ও সৃষ্টিতে উদীচী প্রধান ভূমিকা পালনের পাশাপাশি শুদ্ধ সঙ্গীতের প্রসার, নাট্যচর্চা, নৃত্য প্রভৃতিতে চট্টগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। চট্টগ্রামের বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার যৌথ উদ্যোগগুলোতেও উদীচী প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে শুরু থেকেই। সংস্কৃতি সম্মেলন, সাংস্কৃতিক উৎসব, গুণীজন সংবর্ধনা, সঙ্গীত প্রতিযোগিতা প্রভৃতির মাধ্যমে বেগবান করেছে সংস্কৃতির সংগ্রামকে।
১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম উদীচী এককভাবে পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রভাতী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সার্সন রোডস্থ ইস্পাহানী পাহাড়ের পাদদেশে। ১৯৭৪ সালে উদীচীর উদ্যোগে গঠিত সম্মিলিত সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী সংক্ষেপে ‘সসাগো’ (উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, শিল্পীনিকেতন, প্রাচ্য ছন্দ গীতিকা ও অগ্রণী সংঘ এতে অন্তর্ভুক্ত ছিলো) একই স্থানে দ্বিতীয়বারের মতো পহেলা বৈশাখের প্রভাতী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীন এতে অতিথি ছিলেন।
পরবর্তীকালে ১৯৭৯ সালে ছয়টি সংগঠনের উদ্যোগে সম্মিলিতভাবে বর্তমান ডিসি হিলে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে উদীচী অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম উদীচীর নৃত্যনাট্য কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য রচিত ‘অভিযান’ বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। ১৯৭৪ সালে সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে উদীচীর উদ্যোগে চট্টগ্রাম শহরে ব্যাপক ত্রাণকার্য পরিচালিত হয়। ‘আবহমানকালে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ শিরোনামে উদীচী চট্টগ্রাম সর্বপ্রথম সংস্কৃতি সম্মেলনের আয়োজন করে ১৯৭৪ সালে। হাছন রাজা, রমেশ শীল, যামিনী রায়, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখ সাংস্কৃতিক দিকপালের বিশালাকার প্রতিকৃতিসহ বর্ণিল সাজে মুসলিম হলের উৎসব অঙ্গনকে সজ্জিত করেন খ্যাতিমান শিল্পী চন্দ্রশেখর দে, হাসি চক্রবর্তী এবং একুশে পদকপ্রাপ্ত মনসুর উল করিম, অধ্যাপক সৌমেন দাশসহ অনেকেই। ১৯৮২ সালের ২৩ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম সঙ্গীত সম্মেলনে উদীচীর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন উপলক্ষে একুশ উদযাপন পরিষদ গঠনে উদীচী উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস যৌথভাবে পালনে এবং চট্টগ্রামে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠনে উদীচীর ভূমিকা স্মরণীয়।

চট্টগ্রামে ১৯৮৯ সালে আয়োজিত হয় দেশের সর্বপ্রথম বিজয় মেলা। এতেও নেতৃত্বভার অর্পিত হয় উদীচীর উপর। এ বিজয়মেলা ক্রমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও উদীচীর কর্মীদের সাহসী ভূমিকা প্রশংসনীয়। ১৯৯৯ সালে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ সেলিম রচিত ও নাট্যজন অসীম দাশের পরিচালনায় কোরিওগ্রাফিক গীতি-নৃত্য আলেখ্য ‘ইতিহাস কথা কও’ নিয়ে ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী উৎসব’ এ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা সফর করে উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদ। ২০০১ সালে উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদ চট্টগ্রাম বিভাগীয় নাট্য উৎসবের আয়োজন করে। স্বাধীনতার ২৫তম বার্ষিকীতে চট্টগ্রামের পাঁচ সংগঠন (উদীচী, প্রতিনিধি নাট্য সম্প্রদায়, চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র, বোধন আবৃত্তি পরিষদ ও প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট) ২০০০ সালে চট্টগ্রামজুড়ে যৌথভাবে ২৫টি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
এ দীর্ঘ সময়ে দেশের কীর্তিমান সংস্কৃতিসেবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজসেবী, সাংবাদিক, ক্রীড়াবিদদের সংবর্ধনা দিয়েছে উদীচী। তাদের মধ্যে রয়েছেন মলয় ঘোষ দস্তিদার, রুনু বিশ্বাস, নির্মল মিত্র, সুচরিত চৌধুরী, নাসির উদ্দিন, কবিয়াল ফণী বড়ুয়া, কবিয়াল রাই গোপাল দাশ, মাহবুবুল আলম, কথাশিল্পী অধ্যাপক আবুল ফজল, ড. এনামুল হক, বেগম উমরতুল ফজল, বেগম মুশতারি শফি, কবি আইনুন নাহার, কালু সিংহ, কাজী হাসান ইমাম, কালী রঞ্জন ভট্টাচার্য, ডা. কামাল এ খান, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, বিনয় বাঁশী জলদাস, ওস্তাদ জগনানন্দ বড়ুয়া, প্রিয় গোপাল গুপ্ত (অধর বাবু), এম আবু তাহের পুতু, মো. সাদেক আলী (মরণোত্তর), মো. শরীফ রাজা (মরণোত্তর), প্রফেসর ড. অনুপম সেন, মনি ইমাম, ডা. নুরুল আজিম (মরণোত্তর), হরিপ্রসন্ন পাল, মো. সুলতান, শেফালী ঘোষ, বিজয় কৃষ্ণ বড়ুয়া, মাহবুব হাসান, শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব, অজিত চক্রবর্তী, সুলতান মাহমুদ, ডা. অরবিন্দ বড়ুয়া, কাজী জাফরুল ইসলাম, মো. ইদ্রিস, সুনীল দে, সিদ্দিক আহমেদ, কমরেড আহসান উল্লাহ চৌধুরী, প্রতিভা মুৎসুদ্দী, পণ্ডিত বিজন কুমার চৌধুরী, আবুল মোমেন, হাসি চক্রবর্তী, ড. শামসুল হোসাইন, মৃদুল সেন ও রবীন দে। বাংলাদেশে গণসংস্কৃতি চর্চায় ‘উদীচী’ এক অনন্য সৃষ্টি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচবি ২১তম ব্যাচের বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন
পরবর্তী নিবন্ধযারা ধর্মের দোহাই দিয়ে অপকর্মে লিপ্ত তারা দেশ ও জাতির শত্রু