উদারপ্রাণ অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান

কাজী সাইফুল হক | সোমবার , ১৪ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:৫৮ পূর্বাহ্ণ

পাঠদান কিংবা বক্তৃতাদান প্রাচীন, উন্নততর ও কার্যকর পন্থা। এ দুইটা তখন থেকে এখন পর্যন্ত সর্বাধিক ব্যবহৃত শিক্ষাদান পদ্ধতি। পাঠদান তথাপি বক্তৃতাদান কোনোটাই কেনা যায় না, বিক্রিও করা যায় না। দান করতে হয়। এসবটা অমূল্য। দান মহৎ কাজ। মানুষের কল্যাণে নিজের জ্ঞান-সম্পদ-অর্থ প্রদানই দান। তবে সব থেকে মূল্যবান দান-ই জ্ঞানদান। বাংলা একাডেমি আধুনিক অভিধানে ‘দান’ শব্দটির জন্য ‘স্বত্ব ত্যাগ করে কাউকে অর্পণ বা বিতরণ’, ‘প্রদত্ত-বস্তু’, ‘পালা’, ‘শত্রুকে বশ করার উপায়বিশেষ’, ‘খেয়া পারাপারের শুল্ক’ প্রভৃতি অর্থ উল্লেখ রয়েছে। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মৌল কারণ হচ্ছে জ্ঞান। পৃথিবীর সব প্রাণিমাত্রই জীবনের অধিকারী; কিন্তু জ্ঞান-অধিকারী নয়। মানুষই জ্ঞান, মেধা, বোধ ও মননশীলতায় সম্মানিত সমাসীন। বিবেক, বুদ্ধি ও কথা বলার অধিকারে সমস্ত সৃষ্টিজীবের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটধারী শুধু মানুষই। আবার এসব শ্রেষ্ঠত্বমাঝে কিছু ব্যক্তিত্বকে শুধুই শ্রেষ্ঠত্বের ফ্রেমে আটকে রাখা যায় না। স্যার অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান সেই শ্রেষ্ঠত্ব-ডিঙানো এমনই একজন। তিনি জীবনভর জ্ঞানের ভরভরন্ত গোলা নিয়ে ছুটেছেন এ-ধারে ও-ধারে। তিনি দান-ই করেছেন পুরোটা জীবন। পাঠদান আর বক্তৃতাদান তাঁর জীবনের প্রধানতম বিশিষ্টতা। তিনি হাত খুলে প্রবন্ধ যেমন লিখেছেন তেমন সারগর্ভ বক্তৃতাও করেছেন। অনেক বিশিষ্টজনের বক্তব্যও তিনি লিখে দিয়েছেন ব্যাপক। দানে দানে তাঁর অবদান আমাদের সমাজব্যবস্থার অনতিক্রম্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। তাঁর পাঠদান, বক্তৃতাদান তথা জ্ঞানদান এ সমাজকে বহুকাল আলোর পথে চালিত করবে নিঃশঙ্কে বলা চলে।
তিয়াত্তরে বছর বয়সেও অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান নিয়ম করে নিয়মিত লিখতেন-পড়তেন যা অবাক করা বিস্ময়। তাঁর চিত্তের ঔদার্য ও সৌকর্য আমাদের নিয়তই ভাবায়-ভাসায়। তিনি বিত্তবান ছিলেন না। তবে সেই হেতুতে বিত্তবান; জ্ঞানে-মননে-চিন্তায়। তাঁর বেশির ভাগ লেখা জুড়ে ছিলো সাম্প্রতিক এবং অসাম্প্রদায়িক বিষয় আশয়। তাঁর মতো অশেষ সাবজেক্টিভ লেখাজোকা এ অঞ্চলের আর কারো আছে কিনা সন্দেহ থেকেই যায়। এতো এতো বিষয়ভিত্তিক লেখা আছে যে তাঁর! তিনি নিরলসভাবে চিন্তাশীল প্রবন্ধ রচনা করে গেছেন। বিশেষ উপলক্ষে পত্র-পত্রিকায় লেখা তাঁর কলামগুলো লক্ষণীয় এবং বিশিষ্টতা-অন্বিত। সত্যিই অবিশ্বাস্য তাঁর কর্মক্ষমতা ও দক্ষতা। তাঁর প্রত্যেকটি রচনা অনবদ্য আর উপভোগ্য। অনন্যসাধারণ পাণ্ডিত্য ও মেধা এবং রম্যসাহিত্যের নয়া-রূপক খান স্যার তাঁর বহুমাত্রিক লেখাজোকায় সেই ছাপ রেখে গেছেন। তিনি তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এবং রাজনীতির অন্দরে ও রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা বিবমিষা, কদর্যতা, বৈরিতা, সংকট-সংশয়-উত্তেজনাকে ব্যাপকহারে উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন। বিশেষ করে এদেশের রাজনীতি নামের স্বার্থনীতির বিরুদ্ধে তাঁর গাদা গাদা তীর্যক মন্তব্য অন্তঃপ্রাণ হয়ে থাকবে আরো বহুকাল। আশার কথা, যদি এখান থেকে রাজনীতিকরা পাঠ নিতে পারেন তবে বাংলাদেশের জরা-রাজনীতিতে স্বস্তি ফিরতে পারে-দৃঢ়তায় এমতই উচ্চারণ।
১৪ নভেম্বর তাঁর মৃত্যুদিন। আজ কেবলই তাঁকে স্মরণ করার দিন। অদ্যদিন নীরবতার দিন। যদিও মৃত্যুর নয় বছরেও তাঁর উল্লেখযোগ্য স্মরণ আমাদের পক্ষে অসম্ভব ঠেকেছে! একথা মনে করতেই মনে হয় প্রকৃতই নীরব-ই থেকেছি আমরা। এটা আমাদের মানসিক দৈন্যতা। কত নির্গুণরে নিয়ে এ-সমাজ গুণেপনা-জ্ঞানে সরব থাকে! অথচ তাঁর মতো গুণ-লক্ষণে তুলনারহিত ব্যক্তিত্বের অন্তর্ধানে আমরা নিজেরাই যেন পাড়ি জমিয়েছি পরলোকে! এর থেকে উত্তরণের সমূহ-সম্ভাবনা আছে কিনা উচ্চারণ করা মুশকিল। তবে উত্তরণ জরুরি। নইলে তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের আদর্শ, স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষার বিলয় ঘটবে। এমন সমাজচিন্তক এবং দেশ-কারিগরদের অমলিন স্মৃতির প্রতি আমাদের প্রণতি আরো আন্তরিক-আলিশান হওয়া দরকার।
কথা থেকে যায়। কথারা থেমে যায়। এলোমেলো জলবৎতলরঙ হয়ে উঠে সতত উচ্চারণগুলি। এই যে, মৃত্যু একটে আকস্মিক আবশ্যিকতার নাম। মৃত্যু আসবে এবং হঠাৎ-ই। এক্ষেত্রে স্যারের মৃত্যুর সৌকর্যিক দিকটে আমাদের কাছে নন্দনের। বোধহয় সারাজীবনের সুকৃতির ফলেই তিনি এমন মৃত্যু অর্জন করেছেন। কারণ তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন আকস্মিকভাবে। বিছানায় পড়ে থেকে কিংবা রোগে-শোকে জীর্ণশীর্ণ দেহে ক্লান্তির ছাপ নিয়ে তাঁকে পরপারে যেতে হয়নি। কী অসাধারণ ভঙ্গি তাঁর চলে যাওয়ার! সাধারণের বেলায় মৃত্যুটে ঘটে। কিন্তু খান স্যারের বেলায় ‘তাঁর মৃত্যু ঘটেনি’। তিনি মৃত্যুকে অর্জন করেছেন। বড্ড নীরবে এবং অকস্মাৎ মৃত্যুর সাথে মোসাফাহা করেছেন তিনি। স্যার অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান নেই একথা ভাবতে-লিখতে কষ্ট হয়। বেদনারা মর্মে মর্মে রোদন করে ওঠে। জানি, এসব অর্থহীন বেদনা। অর্থহীন বেদনার অর্থ হয় না। তবুও অর্থহীন বেদনারা কেন জানি মর্মমূলে নড়েচড়ে। এরপরও কেন? কারণ ‘কাঙালের বাসি কথা’ কিংবা ‘বিরস রচনা’র রচকের আরো অশেষ অশেষ সরস কথা পাঠ বা শুনবার-কাঙালদের তিয়াশ মেটানোর জন্য তাঁর আরো কিছুকাল বেঁচে থাকা দরকার ছিলো বৈকি!
লোকেরা বলে সবার ওপরেই বয়স তার চিহ্ন এঁকে যায়। কিন্তু খান স্যারের সত্তুরোর্ধ্ব বয়সেও বয়স তাঁর সাথে অবিচার কিবা শাসন করতে পারেনি। স্যারকে বছর দশেক আগেও যেমনটে দেখেছি মৃত্যুকালেও সেই চেহারায় খানিকটেও ঢেউ পড়েনি; পড়েনি অতিরিক্ত ভাঁজ-রেখা। যদিও বলা হয়, তিনি তাঁর সাহিত্য-সুকৃতির প্রতি যতটে-না যত্নবান ছিলেন, নিজের বেলায় ছিলেন ততটা উদাসীন। এমতই উদাসীনতার দৃষ্টান্ত রাষ্ট্রের কাছে দেখে আঁতকে উঠি। রাষ্ট্রের উদাসীনতার দৃষ্টান্ত খারাপ। ব্যক্তি-উদাসীনতার চেয়ে রাষ্ট্রিক উদাসীনতা ভীতিজনক। তিনি নিজের প্রতি অযত্নে থেকে যত্নবান হয়েছিলেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় কিংবা মেরামতে। তিনি একজন ভাষাসৈনিক, অধ্যাপক, কলেজ-প্রতিষ্ঠাতা, কলামলেখক, সুকথক, চিত্রশিল্পী। এত্তো এত্তো কাজের প্রতিদানে তিনি উল্লেখযোগ্য পুরস্কার-স্বীকৃতি পাননি রাষ্ট্রকর্তৃক। মানুষের ভালোবাসা-ই কেবল তাঁর স্বীকৃতি-পুরস্কার; যে ভালোবাসায় মৃত্যুতে আজও তিনি মহীয়ান। দানে-অবদানে উদারপ্রাণ স্যার অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খানের প্রতি প্রণতি ছাড়া আর কিইবা জানাতে পারি আমরা। স্যার আপনার স্মৃতির প্রতি অতল শ্রদ্ধা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও প্রকাশক, গলুই প্রকাশন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রসঙ্গ : বিশ্বপ্রেক্ষাপটে খাদ্য নিরাপত্তা কতটা জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধপ্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও তাদের সাফল্য