প্রচলিত শোষণ মূলক বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থাকে নৈতিক ও বৌদ্ধিক বৈধতা প্রদানের লক্ষ্যে পুঁজিবাদ নিজের প্রয়োজনে এক সময়ে সৃষ্ট egalitarian বা মুক্ত সামাজিক আবহ তথা আধুনিকতার বিপরীতে মুনাফার স্বার্থে নানা বয়ান হাজির করে সময়ে সময়ে। সামন্তবাদের অবক্ষয়ের পটভূমিতে ইউরোপীয় রেঁনেসার মানব কেন্দ্রিক মুক্ত সমাজ ভাবনা এবং ফরাসী বিপ্লবের সাম্যবাদী আবেদন হলো আধুনিকতার মর্মবস্তু। রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন পাঁজি খুলে আধুনিকতার দিন তারিখ মেলানো যায় না। বস্তুত এটি একটি বহমান ধারা। কিন্তু বিগত শতকের ’৫০ ও ’৬০ এর দশকে বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের স্থবিরতা ও পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে কেইনসীয় আর্থিক ব্যবস্থার কল্যাণে পুঁজিবাদের পূনঃ শক্তি সঞ্চয়ের প্রেক্ষিতে আধুনিকতার বিপরীতে উত্তর আধুনিকতার এক সামাজিক বয়ান হাজির করা হয়। উত্তর আধুনিকতার নামে আধুনিকতার বিজ্ঞান মনস্ক, মুক্ত ভাবনার মর্মবস্তুকে, সমাজ প্রগতির ধারনাকে, বিশ্ব ইতিহাসের ধারাকে গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ আখ্যা দিয়ে বর্জন করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল বিশেষ করে বিগত শতকের ’৬০ এর দশক থেকে। ১৯৬৮ সালের ইউরোপে বিশেষ করে ফ্রান্সের ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র নেতাদের ক্ষমতা পরিবর্তনের অর্বাচীন প্রচেষ্টায় বিষয় ও বিষয়ীগত পরিস্থিতি বিবেচনায় ফরাসী কমিউনিষ্ট পার্টির সর্বাত্মক সমর্থন না দেয়া, পরবতীতে এসব নেতাদের তাত্ত্বিক উগ্রতা থেকে বস্তুবাদী ইতিহাস চর্চাকে অগ্রাহ্য করা সহ আরো কিছু বিষয় ছিল উত্তর আধুনিক মতবাদ উদ্ভবের পটভূমি। ফুকো, দেরিদা প্রমুখ ছিলেন এই চিন্তার অগ্রণী দার্শনিক বিশেষকে নির্বিশেষের উর্ধ্বে স্থান দেয়া, ইতিহাসের পরম্পরা বিবেচনার বদলে খন্ডীকরণ, শ্রেণি সংগ্রামের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা এ মতবাদের মর্মবসু্ত। সামাগ্রিক বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীকে উত্তর আধুনিকতা স্বীকার না করে খন্ডিত বিচারের নামে বস্তুত পুঁজিবাদী শাসনের পরিবর্তনকেই অগ্রাহ্য করে। এসব ভাবনা পুঁজিবাদের সামাজিক ও বৌদ্ধিক দেউলিয়াত্বের বিপরীতে মার্কসীয় দর্শনের প্রভাবকে খর্ব করার এক বিকল্প ছদ্ম বয়ান। সম্প্রতি নবতর বিকল্প হিসাবে উত্তর সত্য বা পোস্ট ট্রুথ নামে একটি ভাবনার কথা প্রায়ই শোনা যায় মুক্ত বাজার রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রবক্তাদের মুখে। উত্তর আধুনিকতা যেমন গ্র্যান্ড ন্যারেটিভকে বর্জন করে, পোষ্ট ট্রুথ বা উত্তর সত্যও তেমনি ঐতিহাসিক সত্যকে আড়াল বা বিকৃত করে খন্ডিত সত্যকে মিথ্যা বা বিকৃত তথ্যের মিশেলে এক বিকল্প নতুন সত্য নির্মাণে সচেষ্ট থাকে পুঁজিবাদ। বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে ফেসবুক ও ওয়াটস অ্যাপ ভিত্তিক এক বিকল্প অসস্পূর্ণ, খন্ডিত ও বিকৃত ভাবনা সাম্রাজ্য একে বেগবান করেছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ভারতের উদাহরণ এ ক্ষেত্রে মনে আছে। শাসক দল বিজেপি ও এই দলের সুপ্রীমো নরেদ্র মোদি গত ১০ বছর ধরে প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসকে জনমানসে হেয় করার জন্য এবং ভারতকে “কংগ্রেস শূন্য” করার ফ্যাসিবাদী হুংকারের সপক্ষে কংগ্রেস ও নেহেরু বিরোধী প্রপাগান্ডাকে আমরা “পোস্ট ট্রুথ” বয়ান বলতে পারি। এখানে যেমন ইতিহাস বিকৃতি ও মিথ্যা তথ্য রয়েছে তেমনি জনমনে গ্রহণযোগ্য করার জন্য কিছু ঐতিহাসিক স্পর্শকাতর সত্য বয়ানের ও মিশেল আছে। কাশ্মীর সংকট ও ১৯৬২ সালে চীন ভারত যুদ্ধে ভারতের পরাজয় এর অর্ধশত ঘটনা উদাহরণ হিসাবে তারা তুলে ধরে। এই উত্তর সত্য বিনির্মাণের মাধ্যমে মোদি ও বিজেপির পূর্বসূরী সাভারকার ও হিন্দু মহাসভার স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা ও গান্ধী হত্যার প্রসঙ্গটি চাপা দেবার মোদির অসদুদ্দেশ্য এতে ক্রিয়াশীল। দীর্ঘ ১৭ বছরের দেশ শাসনের ধারায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সমূহকে শক্তিশালী করে গণতন্ত্রের মাধ্যমে নেহেরুর আধুনিক, শিল্পোন্নত, স্বনির্ভর ভারত নির্মাণের মত জটিল অথচ সফল কর্মকান্ডকে মোদি এই উত্তর সত্য বিনির্মাণের মাধ্যমে আড়াল করে। ঠিক আমাদের দেশে ’৭৫ সালের পূর্বাপর সময়ে বঙ্গঁবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আংশিক সত্য ও মিথ্যার মিশেলে এ ধরনের উত্তর সত্য বয়ানের মাধ্যমে মানুষকে যেমন বিভ্রান্ত করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা তেমনি পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেকে বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের বর্তমান নেতৃত্বও তা করে যাচ্ছে ভিন্ন আঙ্গিকে। নয় মাসের গৌরবদীপ্ত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের তথা মুজিব নগর সরকারের নেতৃত্বকে বর্তমান শাসক দলের নেতারা অন্ধ আবেগের সাথে সামান্য সত্যের মিশেলে,এক উত্তর সত্য নির্মাণ করে এঁেদর অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা ও অবমূল্যায়ন করে চলেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে তাজউদ্দিন সহ এঁেদর নাম পর্যন্ত উল্লেখ না করা এই উত্তর সত্যের উৎকট রূপ। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে, গাজায় ইসরাইলি বর্বরতা নিয়ে, মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অপতৎপরতা নিয়ে এ রকম অসংখ্য উত্তর সত্য বয়ান তৈরি করে চলেছে অবিরাম। রুশ, চীন সামরিক আধিপত্য প্রতিরোধের নামে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় জুড়ে পৃথিবীব্যাপী ৮৩টি দেশে যুক্তরাষ্টের রয়েছে ৮০০ সামরিক ঘাটি। ঠান্ডা যুদ্ধের কথা বাদ দিলেও একবিংশ শতাব্দীতে এসে লিবিয়া, সিরিয়া ইরাকসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্য যুক্তরাষ্ট্র ধ্বংস করেছে। ইরানে দীর্ঘ দিন ধরে স্যাংশন দিয়ে পাঁচ লক্ষ শিশুকে হত্য করেছে। এসব কিছু আড়াল করে ইউক্রেন নিয়ে সম্প্রতি তৈরি করেছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার সংগ্রামের এক বিকট উত্তর সত্য বয়ান।
এদেশে সাম্প্রতিক কিছু উত্তর সত্যের অভিজ্ঞান এ মুহূর্তে আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে রূপ নিয়েছে ব্যষ্টি ও সামষ্টিক ভাবনা ও প্রয়োজনের নিরিখে। প্রথমেই প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায় আমাদের দেশে গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রহীনতার দ্বৈরথ ও দ্বন্দ্বের উপাখ্যান। এ উপাখ্যান ও বয়ানের মূঢ় ক্রুরতা আমাদের নিজেদের প্রাত্যহিক জীবন ও অভিজ্ঞতায় আমরা বুঝতে পারি। দেশে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দল আছে, আন্দোলন আছে, সরকারের নির্বাচনী আয়োজন আছে, “নির্বাচিত” প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত আইনত সিদ্ধ একটি পার্লামেন্ট রয়েছে, নির্দিষ্ট সময় অন্তর পার্লামেন্ট অধিবেশন হচ্ছে, একজন সংসদ নেত্রী বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আছেন, তা হলে বাহ্যত ধরে নিতে হবে দেশে গণতন্ত্রও আছে। অপ্রিয় হলেও বলতে হয় এটা একটি উত্তর সত্য বয়ান। মিথ্যাকে, বিকৃতিকে, অসততাকে কিছু আপাত সত্যের আবরনে ঢেকে রচিত গণতন্ত্রের এ ধরনের উত্তর সত্য বয়ান এ দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে শাসক গোষ্ঠী তৈরি করে চলেছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক শাসনকে গণতন্ত্র বলে প্রচার চলেছে ’৭৫ পরবর্তী ১৫ বছর। কোন সময় শাসক দল বা শ্রেনি এ নির্বাচিত গনতন্ত্রের প্রহসনকে সংখ্যাগুরু অংশীজনদের কাছে নানা অপপ্রচারের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পেরেছে। আবার এখন গত দশ বছর ধরে নির্বাচনে মানুষের প্রয়োজনীয় অংশগ্রহণের সরকারী বয়ান অধিকাংশ নাগরিকের কাছে অগ্রহণযোগ্য হলেও শাসক গোষ্ঠীর কাছ থেকে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ও “উন্নয়নের” এক উত্তর সত্য বয়ান আমরা নিরন্তর শুনতে পাচ্ছি। বস্তুত দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় উত্তর সত্যের এই ন্যারেটিভ আরো বৈধতা পেয়েছে কেননা প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলেরই অভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি দর্শন ১৯৭৬ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় ভাবে অনুসৃত হচ্ছে যা নিয়ে এদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। যেহেতু সমাজ ও অর্থনীতি সুস্থির ও অচঞ্চল কোন বিষয় নয় কাজেই দুই বৃহৎ দলের শাসনামলে সেই আর্থিক ব্যবস্থা তথা অবাধ লুটপাট জবাবদিহিতার অভাবে বেগবান হয়ে, ব্যাপকতর হয়ে জনজীবনে তীব্র বৈষম্য ও অসহনীয় সামপ্রদায়িকতার রূপ নিয়ে জেঁকে বসেছে সমাজ জীবনের সর্বত্র।
লুট পাটের অর্থনীতির অতিকায় শক্তিশালী চক্রকে ক্ষুদ্ধ জনগনের যথার্থ প্রতিনিধি হিসাবে বাম দলগুলো নিজেদের অনৈক্য ও দূর্বলতার কারণে পরিবর্তন করতে পারেনি। ফলে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজিত লুটেরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থায় জনগণের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ প্রায় উল্টো গেছে। সমাজে– রাজনীতিতে টাকাই এখন যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা প্রধান সামাজির উপাদানে পরিণত হয়েছে বঙ্গবন্ধু যেখানে জমির মালিকানার সীমা নির্ধারন করে দিয়েছিলেন, ব্যক্তি পুঁজির একচেটিয়া শোষণ নিয়ন্ত্রণে বেসরকারী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথমে ২৫ লক্ষ পরে ৩ কোটি টাকার সর্বোচ্চ সিলিং নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন এখন সেই দলের আমলে অসংখ্যা বেনজীর বেনজির ভাবে শত শত বিঘা জমির মালিক, লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক অনেকেই সেই দলের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে রয়েছেন। অথচ প্রতি নিয়ত এই উত্তর সত্য বয়ান শাসক দলের সর্বোচ্চ নেতানেত্রীরা তারস্বরে প্রচার করে চলেছেন যে তাঁরা নাকি জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রায় গড়ে ফেলেছেন। বিদেশী ঋণে অবকাঠামোগত পরিবর্তনকে সরকার উন্নয়নের পরকাষ্ঠা হিসাবে প্রচার করে চলেছেন যেখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মত দুই গুরুত্বপূর্ণ মানব সম্পদ উন্নয়নের খাত দীর্ঘদিন ধরে সবচেয়ে অবহেলিত। অমর্ত্য সেনের মতে উন্নয়নের প্রকৃত সংজ্ঞা হল প্রত্যেক নাগরিকের সক্ষমতা ও অধিকার, তাঁর ভাষায় ক্যাপাবিলিটি ও এনটাইটেলমেন্টের নিশ্চয়তা, মাথাপিছু আয়ের গড় হিসাবের বুজরকি বা অবকাঠামোগত শ্রীবৃদ্ধি নয়। দেশ থেকে বছরের পর বছর ধরে লক্ষ কোটি টাকার পাচার, শেয়ার বাজার লুট, ব্যাংকিং খাতে অবাধ লুটপাট, মধ্য ও নিম্নবিত্তের উপর মূল্যস্ফীতির অব্যাহত চাপ তথা নয়া উদার বাদী অর্থনীতির বিষম ব্যবস্থায় উৎপীড়িত মানুষের কাছে উন্নয়নের, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার মিথ্যা ও অর্ধসত্যের মিশেলে এক উত্তর সত্য তুলে ধরা হচ্ছে বর্তমানে। ঘটমান বর্তমানের তিক্ত অভিজ্ঞতা পুঁজিবাদ সৃষ্ট বৌদ্ধিক বয়ান উত্তর আধুনিকতার দিকভ্রান্তির বর্তমান নিরালম্ব অবস্থার মত এই উত্তর সত্যের নামে মিথ্যার নবতর বয়ান ক্রমে আমাদের দেশ ও পুরো বিশ্বকে নিয়ে যাচ্ছে এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের অনির্দেশ্য গন্তব্যে যে সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে আলোর কোন চিহ্ন আপাতত দেখা যাচ্ছেনা।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট