সাংগঠনিক কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে নতুন সমীকরণ চলছে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপিতে। এর মধ্যে দীর্ঘদিনের বিভক্তি ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পড়েছে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও যুগ্ম-মহাসচিব কারাবন্দি লায়ন আসলাম চৌধুরী। গত এক সপ্তাহ ধরে এই দুই নেতার অনুসারীরা দফায়-দফায় একসঙ্গে বৈঠক করেছে। চলতি সপ্তাহে তাদের দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাথে দেখা করার কথা রয়েছে। এর ফলে দূরত্ব বাড়ছে গোলাম আকবর খোন্দকার ও আসলাম চৌধুরীর মধ্যে। অথচ সাংগঠনিক ক্ষেত্রে গিয়াস কাদেরের বিরুদ্ধে এ দুই নেতার ঐক্যবদ্ধ অবস্থান ছিল প্রকাশ্যে। অতীতে আসলাম চৌধুরী ও গিয়াস কাদেরের অনুসারীরা একসঙ্গে এবং গিয়াস কাদেরের অনুসারীরা আলাদাভাবে পালন করতো দলীয় কর্মসূচি।
বিএনপির ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, গোলাম আকবর খোন্দকারকে আহ্বায়ক করে ৫১ সদস্যের উত্তর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক কমিটি গঠনের তৎপরতা শুরু করে কেন্দ্র। কমিটি গঠনের সাথে জড়িত এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কমিটি প্রায় চূড়ান্ত করা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সম্মতি পেলেই যে কোনো মুহূর্তে ঘোষণার অপেক্ষায় ছিল। ওই কমিটিতে কাউকে সদস্য সচিব রাখা হয়নি। শেষ মুহূর্তে রাখা হলেও তাকে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করার ক্ষমতা দেয়া হতো না।
এদিকে কমিটি গঠনের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর তা মেনে নিতে পারেনি খোদ আসলাম চৌধুরীর অনুসারীরা। কারণ, আসলাম চৌধুরীর কয়েকজন অনুসারী দীর্ঘদিন ধরে আহ্বায়ক হওয়ার জন্য তদবির করে আসছিল। আবার দীর্ঘদিনের বিরোধের কারণে গিয়াস কাদেরের অনুসারীরাও চায় না গোলাম আকবর খোন্দকার আহ্বায়ক হোক। ফলে সমীকরণ মিলে যাওয়ায় উত্তর জেলার রাজনীতিতে গোলাম আকবর খোন্দকারকে ঠেকাতে গিয়াস কাদের ও আসলাম চৌধুরীর অনুসারীরা এক হয়ে যায়।
সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, গত ৩ ডিসেম্বর নাসিমন ভবনের দলীয় কার্যালয়ে রুদ্ধদার বৈঠকে বসে গিয়াস কাদের ও আসলাম চৌধুরীর অনুসারীরা। পরদিন তারা নগরের একটি রেস্টুরেন্টে আবারো বৈঠক করে। সর্বশেষ গতকাল শনিবার আসলাম চৌধুরীর অনুসারী ও উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি মো. নজিম উদ্দীনের বাসায় বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বৈঠক চলে। বৈঠকগুলোতে উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত হোসেনের নেতৃত্বে গিয়াস কাদেরের অনুসারী নেতাকর্মীরা অংশ নেয়। এর আগে ২৮ নভেম্বরও দুইপক্ষের মধ্যে বৈঠক হয়।
বৈঠকে উপস্থিত নেতাকর্মীরা দৈনিক আজাদীকে জানিয়েছেন, কিছু বিষয়ে সবাই একমত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-সাংগঠনিক কমিটিতে একজন আহ্বায়ক, উত্তর জেলার আওতাধীন সাতটি উপজেলা থেকে সাতজন যুগ্ম আহ্বায়ক এবং কমপক্ষে ৭১ জন সদস্য করা। এছাড়া শুধুমাত্র গোলাম আকবর খোন্দকারকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন প্রক্রিয়ারও বিরোধিতা করা হয় বৈঠক থেকে।
বৈঠক থেকে জোরালো দাবি ওঠে, আসলাম চৌধুরী মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত যেন কমিটি গঠন করা না হয়। সিদ্ধান্তগুলো তারা মুঠোফোনে বৈঠক থেকেই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীমকে জানিয়ে দেয়। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সৃষ্ট উদ্ভূত পরিস্থিতি সমাধানে তাদের ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান। এর প্রেক্ষিতে চলতি সপ্তাহে তাদের ঢাকায় যাওয়ার কথা রয়েছে।
এ বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, গিয়াস কাদের ও আসলাম চৌধুরীর অনুসারীরা ঐক্যবদ্ধ। আসলাম চৌধুরী যে কোনো মুহূর্তে বেরিয়ে আসবেন। তিনি মুক্ত হওয়ার পর সবার সঙ্গে আলোচনা করে কমিটি গঠনের পক্ষে সবাই। যেহেতু উত্তর জেলার অধীনে সাতটি সংসদীয় আসন রয়েছে, তাই প্রতিটি উপজেলা থেকে একজনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মহাসচিব ঘোষণা দিয়েছেন সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য ও এক কাতারে আসার জন্য। এ ঘোষণায় আমরা সাড়া দিয়েছি। আমাদের মধ্যে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকবে কিন্তু বিরোধ থাকবে না।
উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি মো. নজিম উদ্দীন দৈনিক আজাদীকে বলেন, কেউ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে ভুল তথ্য দিয়ে যদি কমিটি করার চেষ্টা করে, তা তৃণমূল মেনে নিবে না। আসলাম চৌধুরী দলের রাজনীতি করতে গিয়েই কারাগারে গেছেন। তাই তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সবাই একমত হয়েছেন তিনি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কমিটি হবে না। তার মুক্তির পর যে কোনো সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিব। এ বিষয়ে গত ২৮ নভেম্বর থেকে গিয়াস কাদের, আসলাম চৌধুরী ও হুম্মাম কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা প্রতিদিন বৈঠক করছেন বলেও জানান তিনি। ‘গোলাম আকবর খোন্দকারকে ঠেকাতেই বৈঠক কী না’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঠেকানোর বিষয় না। বাংলাদেশে একক ক্ষমতা দিয়ে কি কিছু অর্জিত হয়েছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম দৈনিক আজাদীকে বলেন, কমিটি গঠন প্রক্রিয়া চলমান আছে। তবে আসলাম চৌধুরী মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কমিটি গঠনে বিরত থাকার বিষয়ে উত্তর জেলা বিএনপি নেতৃবৃন্দের আহ্বান নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নেতা জানিয়েছেন, আসলাম চৌধুরী ও গোলাম আকবর খোন্দকার রাজনীতির মাঠে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ট। গোলাম আকবর খোন্দকার উত্তর জেলার আহ্বায়ক হলে আসলাম চৌধুরীর অনুসারীরা রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। হয়তো গুটিকয়েকজন যারা আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব হতে চাচ্ছেন, তারা বঞ্চিত হবেন। তাই কৌশলে অংশটি প্রচার করছে আসলাম চৌধুরীকে উত্তর জেলা রাজনীতি থেকে সরিয়ে গোলাম আকবর খোন্দকার নিজের আসন পাকাপোক্ত করতে চাচ্ছেন। বিষয়টি আসলাম চৌধুরীর প্রতি আনুগত্য থেকে তার অনুসারীরা সহজভাবে মেনে নিতে পারছে না। অথচ এই দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়লে গিয়াস কাদেরের অনুসারীরা সাংগঠনিকভাবে লাভবান হবে।
উত্তর জেলা বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৬ এপ্রিল আসলাম চৌধুরীকে আহ্বায়ক এবং গিয়াস কাদেরের অনুসারী কাজী আবদুল্লাহ আল হাসানকে সদস্য সচিব করে গঠন করা হয় উত্তর জেলা বিএনপির ৯৩ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি। ওই সময় পরবর্তী ৪৫ দিনের মধ্যে উত্তর জেলার প্রতিটি থানা কমিটি গঠনের পাশাপাশি ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, এবং উত্তর জেলা বিএনপির কাউন্সিল করার নির্দেশ দেন দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে কাউন্সিল করা যায়নি।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৫ মে আটক হন উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আসলাম চৌধুরী। ২০১৭ সালের ১৭ মে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল কাজী হাসানকে। ১০ মাস পর ১৮ নভেম্বর সে অব্যাহতিপত্র প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত দেন বেগম জিয়া। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি তিনি মারা যান। ফলে নেতৃত্বের সংকট তৈরি হয় উত্তর জেলায়।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল উত্তরের ৭ উপজেলা ও ৬ পৌরসভার কমিটি যৌথভাবে ভেঙে দেন আসলাম চৌধুরী ও কাজী হাসান। কিন্তু পরবর্তীতে পুনরায় উপজেলা ও পৌরসভা কমিটি গঠন নিয়ে নিজেরা বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং পাল্টাপাল্টি কমিটি ঘোষণা করে তারা। এর জের ধরে ২০১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর নাসিমন ভবনের দলীয় কার্যালয়ে রাউজান বিএনপির সভায় মারামারি হয়েছিল।
এছাড়া দ্বন্দ্বের কারণে ২০১৬ সালে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে উত্তর জেলা বিএনপির ইফতার মাহফিলও বাতিল হয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২ মে উভয় গ্রুপে সংঘর্ষ হয় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত কর্মী সমাবেশে। কোন্দলের কারণে ২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি কাজী হাসানের সাংগঠনিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে আহ্বায়ক আসলাম চৌধুরীকে জেলার সাংগঠনিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার একক ক্ষমতা দেয়া হয়। পরবর্তীতে আসলাম চৌধুরী আটক ও কাজী হাসানের মৃত্যুতে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড গতি হারায়।