উত্তরচল্লিশের আলোয়

জয়দেব কর | সোমবার , ২৪ নভেম্বর, ২০২৫ at ৭:২৪ পূর্বাহ্ণ

(প্রথম পর্ব) শরতের দিনগুলো বরাবরই আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। বিগতবর্ষা হাওর জামাইকাটায় রাখালের বাঁশির মতো যেন খুব একা হয়ে উঠি। দলেদলে বিষণ্নসুন্দরের ডালি নিয়ে হাজির হওয়া শুভ্র মেঘেদের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া শৈশব উঁকি দেয়। ধরতে গেলেই একপা একপা করে দূরে সরে যাই, আবার কাছাকাছিও আসি। আমি আজ চল্লিশ পা দূরে অথবা চল্লিশ পা সামনে। বিস্তীর্ণ স্মৃতিঅরণ্যঠাসা জোনাকের দল মূর্ত করে তোলে এই জীবনের অমৃতবৃক্ষ ও বিষবৃক্ষের সংগীত।

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরতার একটি গ্রাম শ্রীকরপুরআমার জন্মস্থান। দালিলিক সব জায়গায় আমরা এই নাম ব্যবহার করলেও ইউনিয়নের অন্য জায়গায় আমাদের পরিচয় কিন্তু আধুয়ানিবাসী! আধুয়া, পাটুমোহা ও শ্রীকরপুর মিলেই বৃহত্তর আধুয়া গ্রাম। আধুয়া আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠার বুনিয়াদের ঠিকানা।

আমাদের বাড়ি থেকে পুব দিকে বের হলেই সামনে পড়ে কৃষ্ণতলা । একানব্বইয়ের ঝড়ের পূর্বে কৃষ্ণতলায় বহু প্রাচীন বৃক্ষটি মাটিতে উপড়িয়ে পড়ে গেলে আমার পিতাসহ পশ্চিমবাড়ির রামকৃষ্ণদা ওই গাছের ডাল রোপন করেন। পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া শিশুবৃক্ষটি এখন বিশাল মহীরুহ। পৌষ সংক্রান্তিতে (তিলোসংক্রান্তি) নগরকীর্তন, কার্তিক মাসের নগরকীর্তন (ভোলার কীর্তন) এই বৃক্ষতলা থেকে শুরু হয়। বিয়ে ও শিশুজন্মতে নারীরা দলবেঁধে গান গেয়ে গেয়ে পুজো দিতে যায়। গ্রামের প্রবেশদ্বারে এর অবস্থান এক অসামপ্রদায়িক তাৎপর্যপূর্ণ সংস্কৃতি বহন করে চলছে। প্রতিদিন সকালে (বর্ষাকাল ব্যতীত) গ্রামের সকল বাড়ি হতে গরু নিয়ে আসা হয় এখানে। জমায়েত হওয়া গরুগুলোকে এখান থেকে এক বা দুইজন রাখাল নিয়ে যায় হাওরের চারণভূমিতে। রাখালদের গরু চরানোকে সিলোটি ভাষায় বলে ‘গরুবারি’। গ্রামের প্রত্যেক বাড়িকে পালাক্রমে ‘গরুবারি’ দিতে হয়।

আমাদের গ্রামের পূর্বের হাওরের নাম জামাইকাটা। এর একেকটি অংশের একেক নাম। যেমন লাঙ্গলজোড়া, বিন্দারটেক, ডুবি প্রভৃতি। বিন্দারটেক, বানাইয়া, হাপাতিতে প্রচুর ঘাস হয়। কৃষ্ণতলা থেকে গরু নিয়ে রাখাল দূর হাওরে যায় আবার গোধূলীর সময় ফিরে আসে একই জায়গায়। ‘গরুবারি’তে যাওয়া রাখালবালকদের মধ্যে আশ্চর্য কিছু গুণ থাকে। বিশেষত বাঁশি বাজানো আর গান গাওয়ার ক্ষমতা। সিলেটের প্রখ্যাত দুইজন বাউলের নাম করতে পারি যারা এরকম হাওরের বুকেই নিয়েছিলেন বাউলিয়ানার প্রাকৃতিক পাঠ। তাদের একজন শাহ আব্দুল করিম, আরেকজন ক্বারী আমীরুদ্দীন।

জামাইকাটার জল ও ধানের গা ছুঁয়ে ঝরে পড়া পূর্ণিমার আলোয়, পালতোলা নৌকার উদ্ধত বুকে, শাপলাঘেরা ডিঙি ও ভেলার ওপর ভ্রমর আর আমি খেলা করেছি যেন কত জন্মজন্মান্তর! আজ সে বিগতযৌবনাজলে ও জোছনায় নেই ভারসাম্য। নদী ও খাল হত্যা করে মানুষ তাকে করে ফেলেছে প্রায় স্থবির। কচুরিপানার হাত এড়িয়ে বেঁচে যাওয়া শাপলারা বড়োই সংখ্যালঘু! জলের জৌলুশ নিয়ে চারপাশের জনপদের জীবনযাত্রার প্রাণকেন্দ্র এই হাওরের নামকরণের উপকথাও মানুষের লোভ আর আত্মঘাতীতার মধ্যকার ঘনিষ্টতার এক জ্যান্ত উপমা। বিবাহযাত্রীবাহী কোনও এক নৌকায় ডাকাতি করতে গিয়ে ডাকাতসর্দার নিজের মেয়ের বরকে হত্যা করে ফেলে। নির্বিঘ্নে লুট ও লাঞ্ছনা করতে গিয়ে যখন সে নববধূর ঘোমটা খুলে, তখন দেখতে পায় নতুন বউটি তার নিজেরই মেয়ে। সেই থেকেই এর নাম নাকি জামাইকাটা হাওর। বহুবছর আমি হাওর ও গ্রামের থেকে দূরে।

এই ঝলমলে ভাদ্রের বিকেলে আধুয়া থেকে শত শত মাইল দূরের কর্ণফুলিপাড়ে কী ভাবছি? জলজোছনার স্মৃতিকাতরতা আর নাগরিকবাস্তবতার নাগপাশ এদুয়ের দ্বন্দ্বে কেমন আছি আমি?

শূন্যতারাশির বেলাভূমির উপর আমার জীবনসূর্যের আলো আজ পশ্চিমমুখী। উত্তরচল্লিশের আলোয় দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে সময় ও মাটিমানুষের বহুমুখী জটিলতার বিভ্রমে ঢাকা এক মূরতি। রাষ্ট্র, দেশ, জাতি, জাতীয়তা, ধর্ম তথা নানাবিধ মোড়কের আড়ালে মানুষের আত্মিক সংকট প্রকট করে বেনিয়াদের ক্ষমতায়ন, মানুষের সামগ্রিক ক্ষেত্র সীমিত করে তুলেছে। ঠিক যেন সুধীন্দ্রনাথের কবিতার লাইনের মতো প্রকট হয়ে উঠেছে ‘জাতিভেদে বিবিক্ত মানুষ, নিরঙ্কুশ শুধু একনায়কেরা।’ একদিকে মানুষ যেমন প্রকৃতি থেকে অনেক দূরে চলে গেছে, তেমন মানুষে মানুষে দূরত্বও বেড়েছে ঢের। প্রকৃতির ধর্ম থেকে স্খলিতপ্রায় মানব সমাজ নিয়ে তারপরও থেমে নেই মিথ্যে অহংবোধের হাস্যকর চর্চা।

আজকের দিন পর্যন্ত মানুষ জ্ঞানবিজ্ঞানে যে অভূতপূর্ব উৎকর্ষ সাধন করেছে তা যদি মানুষের সামষ্টিক শক্তির ইতিবাচক বিকাশ ঘটাতে না পারে তবে তা সমগ্র মানব জাতির জন্য নিঃসন্দেহে কোনও শুভ ফল নিয়ে আসবে না। মানুষের সামষ্টিক ব্যর্থতায় আমার দায় থাক বা না থাক, আমি বা আমাদের তার ফল ভোগ করতে হয় করতে হচ্ছে। আবার আশার বিষয় যে, মানুষের সামষ্টিক সাফল্যে, আমার অবদান থাক বা না থাক, আমি বা আমাদের তার সুফল কখনও বঞ্চনা করে না ু করছেও না। আমি তাই ইতিবাচকতার পূজারী, সামষ্টিক সাফল্যের উপাসক।

গল্পগুলো চন্দ্রনাথ পাহাড়ের নয়

চন্দ্রনাথ পাহাড়। অনেক গল্প তাকে ঘিরে। শৈশবেই শুনেছিলাম তাকে ঘিরে নানা চমকপ্রদ বিবরণ। একবার বন্ধুদের কোনও একজনের মুখ থেকে যখন প্রথম এই পাহাড়ের গল্প শুনি তখন বিষয়টা তাৎক্ষণিক মেনে নিতে পারিনি। বিষয়টা আমার কাছে এরকম ছিল, এমন কোনও পাহাড়ের অস্তিত্ব থাকতে পারে না যার নাম আমি জানি না, আমার বন্ধুরা জানে! ঘরে ফিরে যখন ছোড়দিকে জিজ্ঞেস করি, দেখি সেও চন্দ্রনাথের খবর জানে। যেনতেন খবর নয় একদম তীর্থযাত্রীদের মতো করে জানে। ছোড়দি জানে অথচ আমি এর বিন্দুবিসর্গই জানি না, বিষয়টা মোটেও মেনে নিতে পারছিলাম না৷ আর সেদিনের গল্পের আড্ডায় এটাও চোখে পড়েছিল যে অন্য বন্ধুরাও এই পাহাড়ি তীর্থের নাম বা গল্পের সাথে পরিচিত । মনে মনে একটু আহত হলেও আবার এটা ভেবেও নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম, ব্যাটারা আমার আগে জানলে কী হবে, আমার দিদি কিন্তু আগ থেকেই জানে। যেহেতু দিদি আমাদের বড়ো, সেহেতু সে আগ থেকে জানার কৃতিত্বটা আমারও জন্মসূত্রে প্রাপ্য! সে রাতে ঘুমোবার সময় ছোড়দি গল্প শুরু করল। কী রোমাঞ্চকর বর্ণনা! ওই বর্ণনা যে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ নয় তা ঘুণাক্ষরেও কেউ বুঝতে পারবে না। মনে হচ্ছিল তীর্থযাত্রী যেন ছোড়দি নিজেই! উপর থেকে নিচের দিকে তাকালেই মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে! হাঁটু কেপে ওঠে! কত উঁচু! বাপরে বাপ। আমি তখন দেখতে পাচ্ছিলাম লাঠি ব্যবহার করে সাঁ সাঁ করে ছোড়দি উঠে যাচ্ছে, সাথে আমিও! এমন দৃশ্য কল্পনা করতে করতে ঘুমিয়ে গেছি কত রাত! একই গল্প শুনেছি বারবার! ছোড়দিও কতদিন ঘুমিয়ে পড়েছে গল্প বলতে বলতে। আমি হয়ত জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছি তারপর? ছোড়দি আর আমি কাছাকাছি বয়েসের। আমি যখন ফোরে তখন সে এইটে। এখন তার কন্যাই হাইস্কুলগামী! আর আমার পুত্র প্রাথমিকে! চন্দ্রনাথের গল্পবলা বন্ধুদের মধ্যে কারা যে এখন কোথায় আছে তা জানি না। সংসারী হয়েছে সবাই। কেউ কি কখনও সত্যিসত্যিই চন্দ্রনাথে গিয়েছে কিনা জানি না। আমার ছোড়দি যে আজও যায়নি তা নিশ্চিত। সে এক পাক্কা গৃহিণী। তারপরও আমাদের বিশাল শৈশবপ্রান্তর থেকে ভেসে আসা স্মৃতিসুখ উঁকি মারে। আহা! কতশত কল্পনাভ্রমণ! হিমালয়উচ্চতার উপরে উঠে মেঘে চড়ে ভেসে বেড়ানো দিন!

সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের মানুষ আমি। সমতলের মানুষ। আমার বাড়ি থেকে জেলা সদরের তুলনায় সিলেট শহর অনেক কাছে। শৈশবে তো আমাদের উপজেলার মানুষদের সুনামগঞ্জে সড়কপথে যেতে হলে সিলেট শহর হয়ে ঘুরে যেতে হতো, এখন অবশ্য জগন্নাথপুর থেকে সুনামগঞ্জে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। তো সুনামগঞ্জ জেলাশহর হলেও কোর্টকাচারি ব্যতীত আমাদের সিংহভাগ মানুষের সিলেটমুখিতা বেশি ছিল, এখনও একই। বুদ্ধিবয়সের শুরুতে সিলেট শহর আমার কাছে স্বপ্নপুরীর মতো এক জায়গা মনে হতো বিশেষত এর বাগবাড়ি, পাঠানটুলা, গোপালটিলা, ভাঙাটিকর, কাষ্টঘর ও টিলাগড়ের জন্য। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের বিভিন্ন নিকটাত্মীয়ের বাস ওসব জায়গায়। তাদের বাড়িতে নানা পরবে, উৎসবে, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা ও বেড়াতে যাওয়া আনন্দদায়ক ছিল। বাগবাড়ি, পাঠানটুলা, গোপালটিলা, টিলাগড় আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ববাহী এলাকা। কারণ ওই এলাকাগুলো ‘পাহাড়’সমৃদ্ধ। যদিও সবাই ‘পাহাড়’গুলোকে স্থানীয়ভাবে ‘টিল্লা’ বলে, যা টিলা শব্দটির স্থানীয় উচ্চারণ। কিন্তু আমার শিশুমনে টিলাগুলোই পাহাড়ের মর্যাদা পেয়েছিল। ওই টিলাগুলোর মাথায় বাড়িগুলোতে হেঁটে উঠতে পারা বিশ্বজয়ের মতোই মনে হতো। উপরে আকাশ আর নিচে জনপদকিশোরমনে দিতো এক অনন্য প্রশান্তির দোলা। শহর থেকে গ্রামে ফিরলে আমার ‘পাহাড়’এর গল্প বন্ধুদের সাথে ভাগ করার কৃতিত্ব ও আনন্দ বড়োই নিখাঁদ ছিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধ‘বেলা’ যুগের একজন সংগীতশিল্পী