আমাদের লড়াকু মেয়েরা দ্বিতীয়বারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে আসলো। পেলো ছাদখোলা বাসের ফুলেল অভ্যর্থনা, পেলো ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কোটি টাকা পুরস্কারের চেক। আমরা আনন্দে, আবেগে প্রশংসায় পঞ্চমুখ! আমাদের মেয়েরা কি দারুণ খেললো! আমাদের বুনোফুল ঋতু পর্ণা ছন্দে ছন্দে কি কাব্যিক গোলটাই না করলো!
২০২২ সালেও ওরা এমন জয় নিয়ে এসেছিলো। এই দশরথ রঙ্গশালাতেই নেপালকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো জয় নিয়ে এসেছিল। এবার দ্বিতীয় টানা জয়। শিরোপা অক্ষুণ্ন রাখার জয়।
স্যালুট আমাদের উড়ুক্কু পাখিগুলোকে। তোমরা তোমাদের নিজেদের যোগ্যতায় দেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছো!
গতবারও ওদের রাজসিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিলো, পুরস্কৃত করা হয়েছিল। তারপর ঐ গল্প ওখানেই থেমে গিয়েছিলো। না তাদের ঠিক মতো খাবার ব্যবস্থা ছিল, না তাদের ঠিকমতো বেতনের ব্যবস্থা ছিল, না তাদের খেলার ব্যবস্থা ছিল! না তাদের টিকে থাকার ব্যবস্থা ছিল! গতবারের অনেককেই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। প্রচন্ড দারিদ্র্যের মধ্যে ওদের যেতে হয়। আনিসুল হকের লেখা থেকে একটু উদ্বৃতি দেই, “সেই বছর প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বানানো হয় একটি প্রামাণ্যচিত্র ‘অদম্য মেয়েরা’। এই সিনেমার শুটিং করার সময় ফুটবলার মেয়েদের বলা হয়েছিল তোমরা তো অনেক সময় ও শ্রম দিচ্ছ কিছু একটা চাও। ওরা বলেছিলো আমরা একবেলা পেট ভরে ভাত খেতে চাই। চোখের জল গোপন করে প্রথম আলোর প্রতিনিধি বলেছিলেন, তোমরা আরও বেশি কিছু চাও; ওরা জবাব দিয়েছিল আমাদের বেশি করে খাবার দিন বাকিটা বাড়ি নিয়ে যাবো ভাই বোনেরা একবেলা পেট ভরে খাবে।”
এই মেয়েগুলোই আমাদের জন্য জয় নিয়ে এসেছে!
অপার সম্ভবনাময় সুলতানা রাজিয়া তো মারাই গেলো সন্তান প্রসব করতে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে। কে কোথায় ছিটকে পড়লো বাফুফে খবর রেখেছে? আমরা এমন এক জাতি আবেগের জায়গায় একেবারে টইটম্বুর! কিন্তু অর্জনগুলো ধরে রাখার মতো কোনো দায়িত্ববোধ আমাদের নেই। গতবারের অর্জন শুধুমাত্র সম্বর্ধনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারপর কে কোথায় বাফুফে আর খবর রাখার প্রয়োজনও মনে করেনি। নানা আর্থিক সংকট দেখিয়ে মেয়েদের ঘরোয়া ফুটবল খেলতে দেওয়া হয়নি। অলিম্পিক বাছাই খেলতে মিয়ানমারে পাঠানো হলো না। ঘরোয়া কোনো টুর্নামেন্ট খেলার সুযোগ পর্যন্ত পেলো না! আর্থিক অনিশ্চয়তা ও নানারকম হতাশায় দল ছেড়েছে অনেকে। এ–ব্যাপারে তৎকালীন বাফুফে সভাপতির মন্তব্যটা ধিক্কারের সাথে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে! এই সাবেক সভাপতি বলেছিলেন, “মেয়েরা যাচ্ছে, মেয়েরা আসবে এটাই তো নিয়ম! মেরাডোনা নেই, মেসি এসেছেন, মেসি ক্লাব ছেড়েছেন, রোনালদো এসেছেন, এই তো যাওয়া আসার প্রক্রিয়া!” যদিও সেই প্রক্রিয়া ব্যক্তিগতভাবে উনার জন্য প্রযোজ্য বলে তিনি মানেননি। উনার কি জানা ছিলো না এই মেয়েগুলো কত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, কত কাঠখড় পুড়িয়ে উঠে এসেছে! সমাজ তো বটেই নিজের পরিবারের সমর্থন পেতেও তো ওদের কম লড়তে হয়নি! এই সমাজ কাঠামোতে কীভাবে মেয়েদের জন্য মেরাডোনা মেসি উদাহরণ হতে পারে আমার মাথায় আসে না!
যাই হোক নতুন ম্যানেজমেন্ট এসেছে। বাফুফের সভাপতির পদে পরিবর্তন এসেছে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই এখানে দৃষ্টিভঙ্গি ও সিস্টেমে পরিবর্তন আসবে। লৈঙ্গিক বৈষম্যের অবসান হবে। এই ফুরফুরে, উদ্ভাসিত মেয়েগুলোর তাল–লয়–ছন্দ কোনোটাই যেন হারিয়ে না যায়। মেয়েদের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখার সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
গত সাফের সর্বোচ্চ গোলদাতা ও টুর্নামেন্ট সেরা সাবিনা এবার লক্ষ্য ভেদ করেছে দু’বার। ব্যক্তিগত নৈপুণ্য কেন নীচের দিকে সেই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন দুর্বল ঘরোয়া কাঠামোর কথা। তিনি বলেন “আমার যেটা দরকার সেটা না দিলে আমার কাছ থেকে ভালো ফল তো পাবেন না। আমাকে যদি ম্যাচ না দেন, ক্যাম্পে রাখেন আর এক–দুই বছর পর টুর্নামেন্টের আগে এসে বলেন সাবিনা তোমাকে দশটা গোল করতে হবে সেটা তো সম্ভব নয়।” তিনি যথার্থই বলেছেন। কোচ বাটলার নারীদলে আর থাকছেন না। তাঁর পরামর্শ হচ্ছে ঘরোয়া লিগটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে হবে। মেয়েদের ম্যাচের মধ্যে রাখার বিকল্প নেই। শুধু বাফুফে ভবনে ক্যাম্প করলে হবে না। ঘরোয়া লিগ টুর্নামেন্ট খুব জরুরি। অর্থহীন রাজসিক সম্বর্ধনার প্রয়োজন নেই। উড়ুক্কু পাখিদের ডানা মেলে উড়ার সুযোগ করে দিতে হবে। ওদের চোখে বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন। ওরা সাফের গন্ডি পেরিয়ে আরও দূরে যেতে চায়। সেই স্বপ্নের কথা জানিয়ে এসেছে যমুনায় অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূসকে। তাঁর সাথে তাদের অভিজ্ঞতার কথা, স্বপ্নের কথা, সমস্যার কথা শেয়ার করেছে মেয়েরা। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। আশ্বাস দিয়েছেন। বাংলাদেশ দলের ফরোয়ার্ড কৃষ্ণা রাণী সরকার তাঁর কাছে আবদার করেছেন মেয়েদের চ্যাম্পিয়ন লিগ জয়ী বার্সেলোনার সঙ্গে বাংলাদেশের একটা প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করার। শুধু দক্ষিণ এশিয়ার গন্ডিতে আটকে না থেকে মেয়েদের চ্যাম্পিয়ন লিগ জয়ী বার্সেলোনার সাথে খেলতে পারলে তারা অনেক কিছুই শিখতে পারবে সেই সাথে দলের অভিজ্ঞতা ও সামর্থ্য বাড়বে বলে তাদের বিশ্বাস। এ–ই আনন্দ উজ্জ্বল আত্মবিশ্বাসী মুখগুলোই হোক বাংলাদেশের মুখ। বারবার উচ্চারিত হোক শত কণ্ঠে শতবার–জিতিলো রে জিতিলো বাংলাদেশ জিতিলো। এই সুর ধ্বনি–প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে থাকুক পাহাড় থেকে সমতল পর্যন্ত।