কর্ণফুলী থেকে উচ্ছেদ, নাকি অবৈধ দখল মুক্তি? চট্টগ্রাম তথা দেশের প্রাণের নদী, অর্থকরী নদী, জোয়ার ভাটার নদী কর্ণফুলী। কর্ণফুলীকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন অর্থনীতি, সম্পদ-সমৃদ্ধি, অগ্রগতি, অদম্য গতি- কোনটির কথাই ভাবা যায় না। ভাবার সুযোগ নেই। একটি জাতিসত্তার অতীত-বর্তমানের সাথে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত, সম্পৃক্ত নদীর নাম কর্ণফুলী। নদীমাতৃক বাংলাদেশের অনন্য চরিত্রের এই নদী আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরকে ধারণ করে। লয়েড রেংকিং এ যে বন্দরটি আটান্নতম অবস্থানে অবস্থান করে। ধারণ করে আমাদের এগিয়ে যাওয়া অদম্য গতির বাংলাদেশের স্বপ্ন-সাধ, সমপ্রীতি, সংহতিকে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া তথা সারা বিশ্বের সাথে সংযুক্তি, সমপ্রীতির গেট ওয়ে এই কর্ণফুলী এবং এর মোহনা।
হাজার বছরের সংস্কৃতি, সামাজিকতা এবং সংযুক্তির মিলন ক্ষেত্র এই নদী। দেশের আন্ত এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের শতভাগ সম্পাদনের একমাত্র মাধ্যম এই নদী। ঐতিহ্যবাহী মুক্তিযুদ্ধে, হাজার বছরের সংস্কৃতি বৈচিত্র্য সৃষ্টিতে, অনন্তকালের সামাজিকতার স্বপ্নীল বন্ধনে, নৃজাতি ও স্বজাতিসত্তার বর্ণিল মিলনে এই নদীর অবদানের কথা, ঐতিহ্যিক সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করার, বিপন্ন বা বিভ্রান্ত করার কোনো সুযোগ নেই। কর্ণফুলী তাই বাংলাদেশের অন্যতম, অনন্য পরিচয়ের মাধ্যমও বটে।
বাংলাদেশ অংশে ১৮৭ কিলোমিটারের এই নদীটি খরস্রোতা, পলিবাহী, পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে পতেঙ্গার কাছে বঙ্গোপসাগরে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে যায় প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টা প্রতি মিনিট, প্রতিমুহূর্তে। এর জলের আছে ঐতিহ্য, গতিতে আছে মাধুর্য, অবয়বে আছে অলংকার, কল কল ধ্বনিতে আছে বেদনা ও সুখের ব্যঞ্জনা, পরিবর্তনের বার্তা। এ অঞ্চলের মানুষের সুখ, দুঃখ, বেদনা।
শিল্প বিপ্লবের প্রায় শতবর্ষ পরে এদেশে শিল্প, কল কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গত শতকের মাঝামাঝি থেকে এদেশে নদীগুলোর উপর অযাচিত, অবাঞ্চিত, অশোভন, অনাকাঙ্ক্ষিত যাতনা ও নির্যাতন নেমে এসেছে। শিল্পের নামে, শিল্পের বর্জ্যের কারণে। শিল্পের মাধ্যম দিয়ে নদী দখল হয়েছে, দূষিত হয়েছে, পথ হারিয়েছে। শিল্পের বিপন্নতাকে কাজে লাগিয়ে লোভী মানুষের রোষানলে, কূপানলে পড়েছে ধারাবাহিকভাবে এদেশের নদ-নদীগুলো। আস্তে আস্তে এদের প্রবাহ সংকুচিত হয়েছে। দেহ লুট হয়েছে এবং নদীগুলোকে গলা টিপে মেরে ফেলার প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। এসব অপকর্মের ধারাবাহিকতায় নদীখেকো, নদী দখলকারী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এদেশের নদীগুলো এক এক করে দূষণ-দখলে অস্তিত্ব হারিয়েছে। নদী দখল, নদীর দূষণ নিকট অতীতেও আমলে নেয়া হয়নি। তাই দখলকারীদের দৌরাত্ম্য এবং সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে গিয়েছে।
কর্ণফুলী এখনো জাতীয় নদী না হয়েও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি নদী হয়ে অস্তিত্বকে সময়ে সময়ে, জায়গায় জায়গায় সুরক্ষা দিতে পারেনি। আমাদের নির্লিপ্ততা, আইনের প্রয়োগের অনুপস্থিতি, আইনের যথার্থতা, ভূমিদস্যুদের অর্থ ও দাপটের সাথে যুক্ত হয়েছে ধীরে ধীরে, ধারাবাহিকভাবে, রাজনীতির নামে অপরাজনীতি। জনপ্রিয়তার নামে জনসম্পদ শোষণের একশ্রেণীর মানুষ।
নদী সম্পদ, সম্ভার, সমৃদ্ধির একটি মাধ্যম। ঐতিহ্য ও অহংকারের একটি প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ। সামাজিকতা ও সংস্কৃতির মাধ্যম। এগিয়ে যাওয়া একটি জনগোষ্ঠীর অহংকারের অংশ। নদীর জাত কূল নেই। কিন্তু সকল জাতকে, সকল কূলের সমন্বয়কারী, সংশোধনকারী, পরিশুদ্ধি ঘটে এই নদীর মাধ্যমে। অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করা, সামাজিকতাকে পরিশুদ্ধ করা, সংস্কৃতির শোভাকে বাড়িয়ে দেয়া নদীর নিরন্তর কাজের অংশ।
অতীতে এবং বর্তমানেও নদীকে আমরা শাসন করি। মহাখননের নাম দিয়ে কর্ণফুলীকে আমরা অর্থ উপার্জনের উৎসে পরিণত করেছি। সরকারি এবং বেসরকারি ভাবে। নদী যোগাযোগ এবং ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে হলেও, নদীর দেহকেই আমরা অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে পরিণত করে ফেলেছি প্রায় অর্ধ শতক যাবত। কর্ণফুলী এজাতীয় অনাচারের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এর দেহকে ভাগ করে, ভোগ করে আমরা বাণিজ্যিক প্রয়োজনে স্থাপনা গড়েছি। এর মাটি নিয়ে ব্যবসা করেছি। পানি নিয়ে ব্যবসা করেছি। এর চর দখল করে বস্তি গড়ে অর্থ উপার্জন করছি। এসব কাজের কোনোটিই সদাচরণ নয়। মানবিক আচরণ অবশ্যই নয়। রাজনৈতিক আচরণতো হতেই পারে না। ঐতিহ্য নিয়ে ব্যবসা করা যায় না। ঐতিহ্য গর্বের, অহংকারের অংশ, অঙ্গ। আমরা অর্থকরী এই নদীকে নিয়ে ব্যবসায় মেতে আছি।
দেশে উন্নয়নের প্রগতিশীল সরকার জনগণের অদম্য স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য দেশে বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে, পুরস্কৃত হচ্ছে। নদী সুরক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করেছে সরকার। কিন্তু এই দেশেই ঢাকার নদীর সাথে চট্টগ্রামের নদীর তুলনা করলে আমরা ব্যাপক বৈপরীত্য দেখতে পাই। ঢাকায় যখন সরকারের সকল অঙ্গের সমন্বয়ে বুড়িগঙ্গাকে দখলমুক্ত করার প্রক্রিয়া চলে, তখন চট্টগ্রামে রাজনৈতিক অথবা অপরাজনৈতিক হুংকার শুনতে হয় ‘লালদিয়ার চরে বস্তি উচ্ছেদ করা যাবে না। আগে বস্তিবাসীদের পুনর্বাসন করতে হবে।’ একটি চরে, নদীর একটি অংশে -অঙ্গে কিভাবে বসতি স্থাপিত হয়, তার হিসাব পিছনে পড়ে যায়। এখানে বসতি স্থাপন করে রাজনীতির নামে ব্যবসা করা হয়। দখলদারিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়। নদীর অবদানের কথা আমরা ভুলে যাই। নদীর মুক্তির কথা আমরা ভুলে যাই। এভাবেই কর্ণফুলী অঙ্গকে ব্যবসার অংশ বানিয়ে আমরা অতীতে এখানে ফিস মার্কেট করেছি, নদীর দেহ ব্যবহার করে ওয়াক ওয়ে করেছি। নদীকে সংকুচিত করেছি। নদীর প্রবাহকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি। নদীর ভূমি ব্যবসায়িক কারণে লিজ দিয়েছি।
এটি কোন্ প্রকারের ব্যবসা অথবা রাজনীতি অথবা সামাজিকতা- আমাদের বোধে আসে না। দেশের একমাত্র টানেল রাস্তা তৈরি হচ্ছে কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে পতেঙ্গার কাছে। এটি দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে যেমন বিস্তৃত করবে, তেমনি অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে। কর্ণফুলী কেন্দ্রিক, কর্ণফুলী ঘেঁষে এবং এর পূর্ব-পশ্চিমে সাগর ঘেঁষে শত মাইল ব্যাপি আন্তর্জাতিক আধুনিক বন্দর, শিল্প জোন, শিল্পের বৈচিত্র্যময় পরিকল্পনা, ব্যাপক কর্মসংস্থান দেশকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদম্য নেতৃত্বে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে। তা এই চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে।
স্বপ্নহীন প্রাণেও স্বপ্ন জেগেছে, স্বপ্ন বাসা বেঁধেছে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের তীব্র আকাঙ্ক্ষা কাজ করছে। এমন একটি উর্বর সময়েও কর্ণফুলীর স্বাস্থ্য নিয়ে অপরাজনৈতিক স্লোগান শুনতে হচ্ছে এদেশের মানুষকে। যা বুড়িগঙ্গার ক্ষেত্রে উচ্চারিত হয়নি। এসব অপরাজনীতিক, সুবিধার সাথে সংসারীদের তীব্র নিন্দা জানায় এ অঞ্চলের মানুষ।
নির্মিতব্য বে টার্মিনাল, কন্টেইনার টার্মিনাল এদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। সৎ, দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ীদের চাহিদা পূরণের পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেই সময় কর্ণফুলীর জায়গা দখল করে পর্দার আড়ালের প্রথম এবং দ্বিতীয় পক্ষ বস্তিবাসী ভাড়াটিয়া তৃতীয় পক্ষকে উস্কানোর চেষ্টা করছে। এটি যেকোন মূল্যেই নিবৃত্ত করতে হবে। ৫০-৬০ একরের লাল দিয়ার চরের উচ্ছেদ শান্তিপূর্ণভাবেই সম্পন্ন হবে। সকলের প্রত্যাশা। এভাবে ধাপে ধাপে প্রাণের নদী কর্ণফুলীর রাহু মুক্তি ঘটবে, আমাদের আশা।
কর্ণফুলীকে এদেশের জন্য, কর্ণফুলীর জন্য আগামীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য, বে টার্মিনাল সহ কন্টেইনার টার্মিনালগুলোকে কার্যকর করার জন্য চূড়ান্ত অবমুক্তি দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে এই ঐতিহ্যিক, ঐতিহাসিক নদীর সাথে আরো পাঁচটি শাখা নদীর জীবন মরণের সম্পৃক্ততা আছে।
এর সাথে সম্পৃক্ত, সংশ্লিষ্ট, সংযুক্ত দখলদারদের, উসকানিদাতাদের, পরিকল্পনাকারীদের নিবৃত্ত করতে হবে। সেই সাথে কর্ণফুলীকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা সময়ের দাবি। স্বপ্ন বাস্তবায়নের সাথে স্বাধীনতার ৫০ বছরে এ প্রত্যয়ও ভুলে গেলে চলবেনা। আমরা কর্ণফুলীর সাথে সম্পৃক্ত সকল প্রকার অবকাঠামো, দখলদারিত্ব, বস্তি সম্পৃক্ততা এবং দখল সংযুক্ততার দ্রুত নিষ্কৃতি এবং নিষ্পত্তি চাই। প্রাণের নদী কর্ণফুলী বেঁচে থাক সমৃদ্ধির বাতিঘর হয়ে। সংকট, সংশয়, দূষণ, দখল ও বিড়ম্বনামুক্ত হয়ে। প্রাণময় প্রত্যাশা এই।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক, কর্ণফুলী গবেষক।