আমার অনুজপ্রতিম এক ভাই গ্রামে থাকে। পল্লী চিকিৎসাসহ অন্যান্য ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে। তার দুই মেয়ে লেখাপড়ায় ভাল। গ্রামের স্কুল কলেজে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়েছে। তাদের ইচ্ছা ডাক্তারি পড়বে। বাবারও ইচ্ছে তাই। ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার আগে থেকেই ভাইটি এ নিয়ে আমার সাথে পরামর্শ করছে। পরীক্ষা দেওয়ার পর তার দুই মেয়েই ভর্তিযোগ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে। সে কথা আমাকে খুব আনন্দের সাথে জানিয়েছে। তবে সরকারি কোন মেডিকেল কলেজে নয়, ভর্তি হতে হবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে। একজন ভর্তি হতে লাগবে ১৬ থেকে ২০ লাখ টাকার মত। দুই মেয়ের ভর্তি করাতে গেলে ফতুর হতে হবে। কি করা যায়- এ নিয়ে সে মহা দুশ্চিন্তায়। আমি নিজেও বেশ কয়েকজন ডাক্তার বন্ধুর সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেছি। একজন পরামর্শ দিলেন দুই মেয়েকে ডাক্তারি পড়ানোর দরকার কি। একজনকে ভর্তি করাতে পারলেও তো হয়। সেই ভাইটিকে একথা জানিয়েছি। সে বলেছে তা কি করে হয়। কোন মেয়েকে বলব তোর পড়ার দরকার নেই। পড়লে দুজনেই পড়বে। মেয়েরা বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে খোঁজখবর নিচ্ছে কত খরচ লাগতে পারে ভর্তি হতে। শেষ পর্যন্ত মেয়ে দুটির ডাক্তারি পড়া আদৌ হবে কিনা- ওদের বাবা এত টাকা জোগাড় করে তাদের ভর্তি করাতে পারবে কিনা এসব ভবিষ্যৎই বলবে। ১ জুন প্রথম আলো পড়তে গিয়ে আমার চোখ আটকে যায় বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির একগাদা বিজ্ঞাপন দেখে। তখনই গ্রামের ভাইটির কথা আমার মনে পড়ে গেল। মেয়ে দুটিকে আমি দেখিনি। কিন্তু কল্পনায় ওদের চেহারাটাও ভেসে উঠল। আহারে মেধা তালিকায় টিকেও শুধু অর্থের অভাবে ওদের ডাক্তারি পড়া কি হবে না।
এদিন আলোচ্য পত্রিকাটিতে যত বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে তার বেশিরভাগই মেডিকেলে ভর্তির বিজ্ঞাপন। সরকারি মেডিকেল কলেজে যারা ভর্তি হতে পারবেন না তাদের আকৃষ্ট করতেই বিজ্ঞাপন। একটি দুটি নয়, কৌতূহল হওয়ায় গুনে নিলাম। মোট ৩৪ টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তির বিজ্ঞাপন এইদিন একই পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। বেশিরভাগ ঢাকার। চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ এবং খুলনারও আছে। পণ্যের প্রচার ও প্রসারে বিজ্ঞাপনের বিকল্প নেই। চিকিৎসা শিক্ষা যে একটি বাণিজ্যিক পণ্য সেটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে বিজ্ঞাপনের এই প্রতিযোগিতায়। ভাবনার পরিসমাপ্তি ঘটাতে না পেরে মেডিকেল শিক্ষায় সরকারি এবং বেসরকারি মেডিকেল কলেজে খরচের বিষয়াদি ইত্যাদির তথ্য তালাশ শুরু করলাম।
বাংলাদেশে সরকারি- বেসরকারি মিলিয়ে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা এখন ১১০ এর মত। এরমধ্যে ৩৭ টি সরকারি এবং বেসরকারি ৭৩ টি। সরকারি মেডিকেল কলেজসমূহে মোট আসন সংখ্যা ৪ হাজার ৩৫০। এবার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ৪৪ হাজার ৭৫৪ জন। এদের মধ্যে তালিকায় যারা উপরের দিকে আছে তারা সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবে। ভর্তি পরীক্ষায় পাসমার্ক ৪০। যারা বেশি নম্বর পেয়ে পাস করেছে তারাই সুযোগ পাবে সরকারিতে। বাকি ৪০ হাজার ৪০৪ জনকে দৌড়ঝাপ শুরু করতে হয়েছে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার চেষ্টায়। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সমূহেও সরকার আসন সংখ্যা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সব মিলিয়ে এখানে আসন সংখ্যা ৭ হাজার ৩৫৫। ভর্তিযোগ্যদের মধ্যে যাদের অভিভাবকের অর্থনৈতিক সক্ষমতা রয়েছে তারাই ভর্তি হয়ে যাবে। মেধা ও যোগ্যতা থাকা সত্বেও ভর্তি হতে পারবে না ৩৩ হাজার ৪৯ জন। তথ্য যা পেয়েছি তাতে দেখা যায়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে যারা ভর্তি হবে তাদের ডাক্তারি পাস করে বের হওয়া পর্যন্ত সেশন ফি ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে মোট খরচের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার মত। বেশিরভাগ বেসরকারি মেডিকেল কলেজে নেই অবকাঠামো সুবিধা। অভাব রয়েছে শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরণের। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক থাকা দরকার ২৫ হাজার ৩০০ জন। এখন সাকুল্যে শিক্ষক আছেন ৯ হাজার ৪০০ জন। অর্থাৎ ৬৩ শতাংশ শিক্ষক কম আছেন। সরকার প্রতি জেলায় একটি করে সরকারি মেডিকেল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পর্যায়ক্রমে তা হচ্ছে। বেসরকারি পর্যায়েও নতুন মেডিকেল কলেজের অনুমোদন থেমে নেই। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন সময়ে নতুন করে আর মেডিকেল কলেজের অনুমোদন না দেওয়ার কথা বলেছেন যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখিয়ে।
এবার আসি বৈষম্যের কথায়। যারা সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবেন তারা অতি সৌভাগ্যবান। তাদের ভর্তি হতে লাগবে ৭ হাজার টাকার মত। এমবিবিএস পাস করা পর্যন্ত মাসিক বেতন ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে তাদের মোট খরচ হবে ২৬ হাজার টাকার মত। একই ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেও যারা বেসরকারিতে ভর্তি হচ্ছেন তারা অতি দুর্ভাগা। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে শিক্ষা অধিকার হলেও বেসরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন সেই অধিকার থেকে। সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। আর বেসরকারি কলেজে যারা পড়ছেন তাদের বাণিজ্যিক মূল্যে কিনতে হচ্ছে শিক্ষা নামক পণ্যটি। এটা চরম বৈষম্য বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। একই চিত্র সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষা ব্যয়ের ক্ষেত্রে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এই বৈষম্য কিভাবে দূর করা যায় তা নিয়ে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে ইতিবাচক আলোচনা বা প্রস্তাব সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা প্রত্যাশা করি। যা কল্যাণমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের জন্য সহায়ক হয়।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।