‘শোয়াচান পাখী আমার / শোয়াচান পাখী / আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’। হুমায়ুন আহমেদের চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত এ গানটির আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তার মাধ্যমে আমরা উকিল মুন্সীর নাম জানতে পারি। গানটি উকিল মুন্সীর বলে দেশের সবাই জেনে গেলেও আসলে এ গানটি ময়মনসিংহ গীতিকাঞ্চল নেত্রকোনার বাউল কবি রসিদ উদ্দিনের রচনা। কোনো গবেষণায়, আলোচনায়, সমালোচনায়, অনুসন্ধানে, তথ্য উপাত্তে, এতদঞ্চলের গুণীজন, বাউল, শিল্পী, সংগীতানুরাগীদের সাক্ষাৎকারে এ গানটি উকিল মুন্সীর বলে কোথাও জানা যায়নি বা তার এ যাবত রচিত ও সংগৃহীত কোনো লেখায় এ গান উকিল মুন্সীর বলে প্রমাণিত নয়। সবার একই কথা এ গান বাউল রশিদ উদ্দীনের।
সে যাই হোক, আমরা একজন উকিল মুন্সীকে তো জানলাম, চিনলাম। উকিল জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক নেত্রকোনার সন্তান প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদের চলচ্চিত্র ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’–এ ঐ এলাকার বিরহী বাউল উকিল মুন্সীর গান এতদঞ্চলের আর এক কিংবদন্তী শিল্পী বারী সিদ্দিকীকে দিয়ে গাওয়ানোর কারণে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা লাভ করলে উকিল মুন্সীর গান সবার মুখে মুখে চলে এসে প্রচুর জনপ্রিয়তা পায়। যেমন ‘আষাঢ় মাইষ্যা ভাসা পানিরে’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ আবার ‘কাংখের কলসী আমার গিয়াছে ভাসি’ বা ‘তুই যদি আমার হইতি রে’ আরও অনেক গান।
জগত সংসার আর জীবনের গান লিখে এবং নিজের সুরে, নিজের কণ্ঠে গান গেয়ে মানুষের মনে ঠাঁই করে নেন উকিল মুন্সী। ক্রমান্বয়ে তার গান জনপ্রিয় হতে শুরু করে। অল্প বয়সে বিশাল জলরাশির হাওড় অঞ্চলে তার গান, তার সুর, বাণী ও গায়কী মানুষের মন কেড়ে নেয়। তিনি হয়ে উঠেন বিখ্যাত বাউল গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক।
যৌবন কাল থেকে একতারা আর চাটিয়া বাজিয়ে, ঘেটু গান গেয়ে মাতিয়েছেন যুবক সমাজকে। গানের শব্দ চয়ন, অপূর্ব উপমা হাওরের মাটির, স্রোতধারা, ভালোবাসা প্রেম বিরহের স্বাক্ষর রেখেছেন।
আমরা জানি কুষ্টিয়ার মহাত্মা লালন ফকিরের সাধনা ও সৃষ্টি বাউল সমপ্রদায়ের আলোকবর্তিকা। ফলে লালন পরবর্তী আমরা পাই হাছন রাজা, রাধারমন দত্ত, পাগলা কানাই, কাঙাল হরিনাথ, গগন হরকরা, দুদ্দুশাহ, শানাল ফকির, আলেফচান দেওয়ান, মহীন শাহ, শীতালং শাহ, মন মোহন দত্ত, পান্জুশাহ, উকিল মুন্সী, রশিদ উদ্দীন, সৈয়দ শাহনুর, জালাল খাঁ, জালাল দেওয়ান, শাহ আবদুল করিমসহ শত শত বাউল সাধকের সৃষ্টি সম্ভার যে গান বাঙালির মানস ফসল, বাঙালির আত্মদর্শন, তত্ত্বসাহিত্য।
বিশ শতকে সারাদেশের মতো ময়মনসিংহ গীতিকাঞ্চল নেত্রকোনার সমাজ জীবনেও বাউল গান প্রবল উত্তাপ ছড়ায়। সেই সময় এ অঞ্চলের মরমী সাধকদের গান মানুষজনের মনকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়।
অনেক স্বনামধন্য বাউল কবির জন্ম নেত্রকোনায়। এর মধ্যে চান খাঁ পাঠান, হৃদয় সরকার, উকিল মুন্সী, রশীদ উদ্দিন, জালাল খাঁ, দীন শরৎ, তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, আব্দুল মজিদ তালুকদার, আবদুস সাত্তার, জাহের বখত, ইদ্রিস মিয়া, খেলু মিয়া, আলী হোসেন সরকার, চাঁন মিয়া প্রমূখবাউল কবি তাদের সাধন কর্মে ভাব, শব্দ, রূপক, উপমাও নান্দনিক বাক্যে গেঁথে লোকায়ত সাহিত্যধারাকে বেগবান করেছে।
আমরা গায়ক বাউল কবি, মরমী কবি উকিল মুন্সী, বাউল ফকির উকিল মুন্সী, দরদী বাউল উকিল মুন্সী, বাউল কবি উকিল মুন্সী, বিরহী বাউল উকিল মুন্সী, হযরত উকিল মুন্সী যাই বলি না কেন, যে নামেই তার পরিচিত পাই, যে অভিধায় তাকে চিনি না কেন তার পুরো নাম আব্দুল হক আকন্দ। উকিল তার ডাক নাম। আর তাঁর ইমামতি পেশার কারণে মুন্সী যুক্ত হয়। কারো কারো মতে তার মাতার নাম যেহেতু উকিলেন্নেসা তার সাথে মিল রেখে উকিল নামটি রাখা হয়।
উকিল মুন্সী নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার নুরপুর বোয়ালী গ্রামে ১৮৮৫ সালে ১১ জুন জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম গোলাম রসুল আকন্দ ও মাতার নাম উকিলন্নেসা। নেত্রকোনা জেলা পীর ফকির দরবেশ প্রভাবিত লোকসংস্কৃতি সম্মৃদ্ধ অঞ্চল। নেত্রকোনার অসংখ্য বাউল সাধকই কোনো না কোনো পীর দরবেশের মুরীদ। তাদের গানে সুফী দর্শনের প্রভাবের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। উকিল মুন্সী পীরের মুরিদ এবং খেলাফতপ্রাপ্ত ছিলেন। উকিলেরও অনেক মুরীদ ছিল। শিল্পী উকিল আর পীর উকিলের মধ্য থেকে জগত সংসার শিল্পী উকিলকেই বেছে নিয়েছে। যেহেতু সভ্যতা সৃষ্টির পক্ষে যায়। উকিল মুন্সী নিতান্ত শৈশবেই বাংলার পাশাপাশি আরবী, ফারসী ও কোরআন শিক্ষা নেন। তিনি ময়মনসিংহ গীতিকার পালাকার কবি দ্বিজ কানাই, মনসুর বয়াতি, কঙ্ক, দামোদর, রঘুসুতের উত্তরসূরি। লক্ষ করা যায় উকিলের গানে বিশেষ করে ‘বিরহী ভাব’ সংগীতাঙ্গনে আলাদা একটি অবস্থান সৃষ্টি করেছে। আবার কখনো ‘জল’ উকিল মুন্সীর গানের মৌল বিষয় হয়েছে প্রবল প্রতাপে। তাইতো নতুন পানির জোওয়ানী উকিলের প্রেরণা, অবলম্বন। তার গান নিজেকে নিয়ে, নিজের চারপাশ, পরিবেশ প্রতিবেশ নিয়ে, প্রকৃতি নিয়ে, নদীমাতৃক বাংলার ভাটি জীবনের ভাব সংস্কৃতি নিয়ে, প্রপঞ্চময় জগতে অন্তর্গত ভাঙনে বিরহী আর্তি ও অভিমান নিয়ে– প্রেমের জন্য, সুন্দরের জন্য, মংগলম ঈশ্বরের জন্য অন্তর্লীন প্রার্থনা। উকিল মুন্সীর আধ্যাত্মিক অণ্বেষণ পুরো মানব জীবন ও প্রকৃতিকে ঘিরেই সম্পূর্ণ আবর্তিত। উকিলের ভাব ও প্রেম মরমী আধ্যাত্মিক সাধনাকে ঘিরে যা সুন্দরের আরাধনা। এই সব চিরকালীন অনুসঙ্গ সত্ত্বেও মেধা ও প্রতিভার গুণে আঞ্চলিকতার গণ্ডি পেরিয়ে উকিলের গান যুগান্তরে–কালান্তরে এসেও শ্রোতাদের মনকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। তাই তার গানের মধ্যে প্রেমতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব ও প্রকৃতিতত্ত্বের গান গুলো বেশি জন প্রিয় :
যেমন – ‘সুজন বন্ধুরে আরে ও বন্ধু / না জানি ঠিকানা/ এ দাসীরে কান্দাইয়া / কোন দাসীর মন রাখ রে বন্ধু।’
উকিল মুন্সীর পথ প্রেমের। সেই প্রেম দিন যাপনের সঙ্গে জীবিকার সঙ্গে ব্যপ্ত হয়ে ব্যক্তি বোধের সংকীর্ণ অনুভূতি ছাড়িয়ে সমষ্টি ও সামগ্রিকসত্তায় জায়গা করে নেয়। উকিলের গান শুধু ভাবের আতিশয্যে প্রেমের বাণী নির্ভর নয়। চিত্রকল্পের পর চিত্র কল্পে জল, হাওয়া, মাটির গন্ধ ও অভিজ্ঞানে আবহমান বাঙালির নাড়ির যোগ টের পাওয়া যায়।
ভাটি তথা নদীমাতৃক বাংলার প্রকৃতি, আর্থ– সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনচিত্র, মানবতাবাদী সুফিদর্শন ও প্রাচ্য আধ্যাত্মবোধের এষণায় উকিল মুন্সীর গান বর্ষার পানির মতো তাজা। বাউলসত্তার আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, নবীতত্ত্ব সহ নানা তত্ত্বের ধুলোবালি– কাদামাটি সত্ত্বেও উকিলের গানকে সকল শ্রেণির শ্রোতার কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছে তার মেধাশক্তির স্ফুর্তি ও শিল্পগুণ।
শিল্পগুণই বাউল ঘরানার কুপ ছাড়িয়ে পরমের প্রতি উকিলের প্রেমময় অভিব্যক্তি ও বিরহী আর্তমানবতাবোধের স্মারক হয়ে সবার মাঝে জায়গা করে নিয়েছে। তাই প্রকৃতিজ লোকায়ত দর্শন বাউলমতের প্রধান সূত্র।
আবার ‘বিরহী’ অভিধায় খ্যাত উকিল মুন্সী। বিরহী বিনয়ী ভাব ও সুর তা গানের মূল প্রবণতা। তার বিরহী আর্তি আবহমান বাংলার মানসবোধ, হাওড় অঞ্চলের জীবন ও সংস্কৃতির রূপ, রস, গন্ধে ভরা। তার বিরহী আর্তি জীবন সংসার জগতের দোলাচলে প্রেমের মানুষ ও পরমাত্মার জন্য। উকিল গেয়ে ওঠেন, ‘কোন কলিমায় ডাকব তোমায় রে / আরে ও বন্ধু / কেমনে হবে সুখী / বিরহী উকিলের এ ভাবনায় রে অন্ধ হইল আঁখি/ সুজন বন্ধু রে।
প্রকৃতি দর্শন ও পরমাত্মার কাছে ফেরার আধ্যাত্মবোধ তার গানকে আলাদা দ্যোতনায় আলাদা ব্যঞ্জনা দিয়েছে। আঞ্চলিক শব্দ, প্রতীক, উপমা, রূপক ব্যবহারে ভাটির ভাষার সুর মাধুর্য ও স্ফুর্তিতে তা গানের মূর্ছনা অবিনশ্বর প্রেমের মনুমেন্ট তৈরি করে। অধরাকে ধরার জন্য, অধরার সঙ্গে মিলনের জন্য, এতটুকু শান্তির জন্য করুণ আকুতি ও হাহাকার উকিলের গানের তূরীয় ভাব। জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে অভেদ্য সাধনকরণই সহজিয়া মরমী সাধকদের ধ্যান জ্ঞান। এই প্রেম প্রচলিত ধর্ম নীতি, প্রথা ও বিশ্বাসের দিকে যায় না। এই প্রেম প্রকৃতির সঙ্গে ঐতিহ্যের, শিকড়ের সঙ্গে গাছের পাতার, জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার অন্তর্নিহিত সত্যকে উপলব্ধির, সৌন্দর্যকে অবলোকনের।
বাউল মতবাদ ধর্ম মত নয়। একটি বিশেষ দার্শনিক মতবাদ। অসীমকে সীমায় আবদ্ধ করা, সীমার মাঝে অসীমের সাধনাই বাউল তত্ত্ব। উকিল মুন্সী ব্যতিক্রম ধর্মী বাউল চরিত্র। তিনি গৃহত্যাগ হয়েও গৃহী, শিল্পী হয়েও পীরের মুরিদ, বাউল হয়েও মসজিদের ইমাম। উকিল মুন্সী সাধক ছিলেন। তাঁর যাপিত জীবন ও জীবন দর্শনের সঙ্গে সংগীত সাধনা একাকার হয়েছিল। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত শিল্পী ছিলেন এই মুন্সী। তিনি মত্ত ছিলেন সংগীত চর্চায়। সাধকেরা বলেন, ‘যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তা আছে দেহভাণ্ডে’। বৈষ্ণব ও বাউল মতে মানুষের হৃদয়েই পরমেশ্বরের অবস্থান। তাই দেখা যায় বাউল উকিল মুন্সীর গানে রাধা– কৃষ্ণ, লাইলী–মজনু, যা জীবাত্মা–পরমাত্মারই রূপক। উকিলের গানে আমরা কখনো দেখি ‘বন্ধুয়া’, কখনো ‘শ্যামচাদ’ , ‘সুজন বন্ধু’, ‘নাইয়া’, ‘মাঝি’, ‘মুর্শিদ’ বা পরম মানবেরই রূপক। মথুরা বৃন্দাবন, রাধাকৃষ্ণ, বিরহ বিচ্ছেদ এ সকল বিষয় অনায়াসে ব্যবহৃত হয়েছে তাঁর লেখায়।
সুফীবাদ, দেহতত্ত্ব, ভাবসংগীত, মরমী, বিরহী আর্তি তার গানের মূল ভাব। নারী পুরুষের অন্তরের আকুতি, প্রেম ভালোবাসা, সুখদুঃখ, বিরহগাথা নিয়ে উকিল লিখেছেন অনেক গান। যেমন: ‘মেঘের আশে চাতকিনী / কাঁদে সারারাত / তেমনি দশা হইল আমার / না পাইয়া সাক্ষাত। সে সাক্ষাৎ অধরার জন্য, নিরাকারের জন্য, সৃষ্টিকর্তার জন্য। আবার, ‘পাষাণ বন্ধু রে / দুঃখ দিয়া হিয়ার ভিতর /একদিনও না লইলে খবর /একি তোমার প্রেমের পরিচয় রে বন্ধু। এ আকুতি সৃষ্টি কর্তার উদ্দেশ্যে, আর এক বিরহী আকুতি।
তার গান ও সুরে বিরহের ব্যাকুলতা প্রকাশ প্রাধান্য পেয়েছে। সুরের সাধনার তিনি এই আমলের মানুষের জীবনকেই হাযির করেছেন। তার গানে দার্শনিক মূল্যবোধ ভাটি অঞ্চলের মানুষের চিন্তাকে ব্যাপক প্রভাবিত করেছে।
বাংলা বিচ্ছেদ গানের সাধক পুরুষ তিনি। বাউল গানের জগতে তিনি এমন এক বিচ্ছেদ গানের সুর স্থাপন করেছেন যা স্বতন্ত্র ও অনন্য।
গানের জগতে উকিল মুন্সী ছিলেন এক বিরহী ডাহুক। তিনি নারী ও পুরুষের অন্তরের আকুতি প্রেমভালোবাসা, সুখদুঃখ বিরহ গাথা নিয়ে অনেক গান রচনা করেছেন এবং সৃষ্টিকর্তাকে উদ্দেশ্যে করে বিরহের অনুভূতি প্রকাশ করতেন। হাওর অঞ্চলের বিচ্ছেদ গানের ধারায় তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ ও আদরণীয়। শরীয়ত, জীবনদর্শন, মসজিদে ইমামতি, মক্তবে শিক্ষকতা তার সংগীত চর্চায় বাধা হতে পারেনি। শরীয়ত পন্থী বলে তিনি নিজের ছবি পর্যন্ত তোলেন নি। পুত্র শোক ও বার্ধক্যজনিত কারণে ১৯৭৮ সনের ১২ ডিসেম্বর ৯৩ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
[সহায়ক গ্রন্থ: উকিল মুন্সীর গান, সংগ্রহ ও সম্পাদনা– মাহবুবুল কবির, প্রকাশক– ঐতিহ্য ২০১৩। বাংলা বাজার, ঢাকা ।
বিবিধ পত্র পত্রিকা, সাক্ষাৎকার, আলোচনা, সাময়িকী ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে সংগৃহীত তথ্য উপাত্ত।]
লেখক: প্রাবন্ধিক, সংগীত শিল্পী।