“ কুমার নদের ওপর কাঠের সেতু। পাশেই বাজার। বড় বড় লঞ্চ, গয়না নৌকা যাতায়াত করত। পদ্মার ইলিশ বাজারে বিক্রি হচ্ছে। মনে হতো চকচকে জ্যান্ত ইলিশ। সেবার ফরিদপুর গিয়েছিলাম গীতাকে নিয়ে। তার প্রথম ফরিদপুর ভ্রমণ। আগে অনেকবার সে যেতে চেয়েছিল, হয়নি। আমি ঢাকায় এসে নানা অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থেকে ফিরে আসতাম কলকাতায়। ফরিদপুর গিয়ে ছবির মতো মনে পড়তে লাগল। দেখা হল অনেক পুরনো মানুষের সঙ্গে। বেঁচে ছিলেন না অনেকেই। আমার দাদা বলেছিলেন, ফরিদপুর গিয়ে অনাথদা’র (অনাথের আচারের দোকানের প্রতিষ্ঠাতা) সঙ্গে যেন দেখা করে আসি। দেখা হল তাঁর সঙ্গে। তিনি প্রথমে চিনতে পারেননি আমাকে। তারপর মুহূর্তেই জড়িয়ে ধরলাম। আমার শিক্ষিকা কিরণদি’র সঙ্গে দেখা। এমন আবহ তৈরি হল আমার মধ্যে, এক দিনের ভ্রমণে আমি ভুলে যাচ্ছিলাম আমি ফরিদপুরের, নাকি কলকাতার। মানুষের জীবনে কখনো অতীত এসে এমনভাবে উপস্থিত হয়। সবকিছুকে তার প্রিয় ও আপন মনে হয় তাৎক্ষণিক ভাবে। অতীতকে আমি মনে করি। কিন্তু নিজেকে দুর্দশাগ্রস্ত হতে দিই না। আমি সিনেমার মানুষ। কাতর হয়ে গেলে শিল্প ক্ষুণ্ন হয়, এটা আমি দেখেছি। চল্লিশে যখন কলকাতায় এলাম, ফরিদপুরে যেতে খুব ইচ্ছে হতো, কিন্তু মেনে নিয়েছিলাম কলকাতাকে।“
২০১৩ সালের ১৪ই মে কলকাতার গোর্কি সদনে নাসির আল মামুনকে দেয়া সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে এভাবেই স্মৃতিচারণ করছিলেন প্রয়াত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন, আরও বলেছিলেন তাঁর আদিনিবাস ফরিদপুরে বসবাস–কালীন সময়কার কথা, পল্লীকবি জসীমউদ্দিনের সাথে তাঁদের পারিবারিক বন্ধুত্বের কথা।
বাংলা সিনেমার প্রধান তিন শেরপা সত্যজিত–ঋত্বিক–মৃনাল এ বিষয়টা এখন এতটাই চর্বিত চর্বন যে এখন ক্ষেত্রবিশেষে খুব ক্লিশে মনে হয় এই আলোচনা। বরং যদি এঁদের তিনজনের মধ্যে আলাদা কী বৈশিষ্ট্য ছিল এমন প্রশ্নে একটু নড়েচড়ে বসে ঠিক যে উত্তরটা হুট করে মাথায় আসে, তা হল সত্যজিৎ সেরা তাঁর পরিমিতি বোধের কারণে। ঋত্বিক এর ছিল তুমুল আবেগ, যে আবেগ দর্শককে বাধ্য করেছে ডুবে যেতে, আর মৃণাল এঁদের চাইতে যে দিকটায় আলাদা তা হল তাঁর নিরীক্ষার মেজাজ। তিনি কখনই কোন বিশেষ ঘরানায় আঁটকে থাকেননি।
তাঁর তৈরি প্রায় প্রতিটি ছবিই ছিল সমাজ–দর্পণ। দর্শককে টেনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন বারবার তাঁদেরই গল্পের সামনে। নির্মাণে নতুন ভাবনাকে তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন, আর তাই হয়তো ২০০৪ সালে কবি শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করে চমকে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “আপনার নাম শ্রীজাত? আপনার একটি বই পড়ে ফোনটা করলাম। আপনি আমাকে চমকে দিয়েছেন। আসলে কী জানেন, ফর্ম নিয়ে নতুন ধরনের কাজ করলে আমার ভাল লাগে। আপনার এ বইটাতে অনেক জায়গায় ঝুঁকি নেওয়া আছে। এক্সপেরিমেন্ট আছে। নতুনত্ব আছে। আমি কবিতা খুব নিয়মিত পড়ি। কারও লেখা ভাল লাগলে জানাই আর কী। এই যেমন আপনাকে জানালাম। ভাল থাকবেন। আর হ্যাঁ, লেখা চালিয়ে যান”। তাঁর প্রতিটা সিনেমাই চিন্তার প্রগাঢ় প্রতিফলন এবং খুব সহজেই এগুলোর মাধ্যমে তাঁর সমসাময়িক চলচ্চিত্র নির্মাতাদের (যেমন সত্যজিৎ, ঋত্বিক ঘটক) থেকে তাঁকে আলাদা করে ফেলা যায়। সত্যজিৎকে অবশ্য রাজনীতি বিমুখ বলা যেতেই পারে আর ১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘যুক্তি তক্ক আর গপ্প’ এর আগ পর্যন্ত ঋত্বিকও এর থেকে দূরে ছিলেন। এমন বলতে চাইছি না যে রাজনৈতিক সিনেমা বানানোটাই একজন পরিচালকের মুখ্য কাজ। কিন্তু, পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ মনের মধ্যে যে দ্যোতনা তৈরি করে তা ফুটিয়ে তোলাইতো একজন শিল্পীর প্রকৃত লক্ষ্য। তাঁর কলকাতা ট্রিলজি অর্থাৎ ইন্টার্ভিউ (১৯৭১), ক্যালকাটা ৭১ (১৯৭২) এবং পদাতিক (১৯৭৩) ছবি তিনটির মাধ্যমে তিনি তৎকালীন কলকাতার অস্থির অবস্থাকে তুলে ধরেছিলেন।
আবার চলচ্চিত্রে কোন ছবিটা সমকালীন হবে, এই ব্যাপারে মৃণাল সেনের একটা সুস্পষ্ট চিন্তাধারা ছিল। কেবলমাত্র ঘটমান সামাজিক বা অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে ছবি করলেই সেটা সমকালীন ছবি হবে, এটা নয়। তিনি এ বিষয়ে একটা উদাহরণ টেনেছেন তাঁর একটা নিবন্ধে; লিখেছেন, ‘‘ ‘অ্যান্ড্রক্লিস্ ও সিংহে’র গল্প আজকের নয় গল্পটি প্রাচীন ও অতিপরিচিত। সেই গল্পটি নিয়ে বার্নার্ড শ একটি নাটক লিখলেন। নাম অহফৎড়পষবং ধহফ খরড়হ. নাটকটি যখন জার্মানির কোথাও মঞ্চস্থ হয় খুব সম্ভবত বার্লিনেই। তখন এক ডাকসাইটে রাজপুরুষ অভিনয় দেখতে দেখতে এতই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন যে নাটক শেষ হওয়ার আগে এক সময় তিনি হল থেকে বেরিয়ে যান। শ’ শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলেন, বলেছিলেন যাক ভদ্রলোক তা হলে আমাকে বুঝতে পেরেছেন। শাসকের নোংরা অস্বাস্থ্যকর চেহারাটা দেখানোই নাট্যকারের উদ্দেশ্য। এখানে এসেই গোটা কাহিনীটা একটা তাৎপর্য পেল। সঙ্গে সঙ্গে রাজ প্রতিনিধি নিজেকে দেখতে পেলেন শাসনযন্ত্রের রূপটি তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সে মঞ্চে এতগুলো লোকের সামনে তাকে বিদ্রুপ করতে লাগলো এবং শেষপর্যন্ত ভয়ে রাগে ও লজ্জায় ভদ্রলোক পালিয়ে বাঁচলেন এবং এ যুগের নাট্যকার শ’ আশ্বস্ত হলেন। পুরানো কোনও গল্প আজকের মানুষকে আজকের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে আজকের কথা ভাবিয়ে তুলতে পারে। আজকের বাস্তব জীবনের সঙ্গে একটা যোগসূত্র খুঁজে বার করে দিতে পারে তবে সেটা হবে সমকালীন।’’ অথচ, তিনিই আবার এক সাক্ষাৎকারে ‘পথের পাঁচালী’ সত্যজিতের শ্রেষ্ঠ ছবি বলে ভাবেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, নাহ্, সত্যজিৎ–এর শ্রেষ্ঠ ছবি আমার মতে, ‘অপরাজিত’ এটা এমন একটা ছবি, যা প্রমাণ করে সমকালীনতা মোটেও সেই পিরিয়ডের উপর নির্ভর করে না, বরং এটিচ্যুডের উপর নির্ভর করে
এই যে আজকের দিনে কম বাজেটের সিনেমা তৈরির হিড়িক এবং অনেক বড় বাজেটের সিনেমাকেও ঘোল খাইয়ে দিচ্ছে সামান্য বাজেটের সিনেমা, তা কিন্তু কেবল ইদানীং ঘটছে এমন নয়, এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে। কারিগরি উন্নয়নের পাশাপাশি সিনেমা বলবার ভাষাতেও উন্নয়ন ঘটেছে, এটা সময়ের সাথে তাল মিলিয়েই সিনেমার মূল রসায়নের পরিবর্তন আনছে। সেন এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘‘যুদ্ধোত্তর যুগে দুটি ধারা ‘নিওরিয়েলিজম’ এবং ‘নিউওয়েভ’ বিশ্বের চলচ্চিত্রে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। নিওরিয়েলিজমের যেমন একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল যেটা যুদ্ধের পরেই ইতালিতে এসেছিল, নিউওয়েভের সে রকম সামাজিক বা রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল না। নিওরিয়েলিজম যেমন বিদ্রোহ, সামাজিক অব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং একই সঙ্গে সে সিনেমার প্রথাসিদ্ধ নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সেই সময় ইতালির স্টুডিওগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত। কোন ব্যাপারই না, এরকম ভাবনা নিয়ে স্টুডিও ছেড়ে ক্যামেরা হাতে রাস্তায় নেমে পড়লেন। বসতবাড়িতে শুটিং করলেন, সিনেমা তৈরি করলেন। নিউওয়েভও সেনের মতে একটা প্রতিবাদ এবং অনেকটা দাপটের সঙ্গে যাবতীয় নিয়ম ভেঙেই এরা এগিয়ে এলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন সিনেমাটা কারও কুক্ষিগত নয়। হতে পারে না। নিউওয়েভ পরিচালকদের মধ্যে একমাত্র স্যাব্রল ছাড়া আর সবাই সিনেমার লোক নন, সাংবাদিক। তাই এঁদের কোনও মতাদর্শ ছিল না, ওঁরা তাই সিনেমার নিয়মগুলো ভাঙতে শুরু করলেন। এবং খুবই কম পয়সায় ছবি করতে আরম্ভ করলেন।’’ তিনি এই ধারাগুলোর যূথবদ্ধটা বুঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, – ঈধষষ রঃ ওঃধষরধহ হবড়ৎবধষরংস ড়ৎ ঋৎবহপয হবিিধাব ড়ৎ ঈরহবসধ ড়ভ ইৎরঃধরহ. ঞযবু ধৎব ধষষ ষধনবষবফ নু ঃযব লড়ঁ.
কথা–বার্তায় মৃণাল বরাবরই চাঁছাছোলা, তাঁর মধ্যে কোন ভাণ ছিল না। সত্যজিতের সাথে তাঁর খিটমিট লেগেই থাকতো। একবার গৌতম ঘোষ এক সাক্ষাৎকারে জানতে চাইলেন, আচ্ছা কখনও মনে হয়েছে আপনার যে সত্যজিৎ রায় পর্যায়ের প্রতিভার সমকালীন বড় পরিচালকের কাজ সম্পর্কে আরও দয়ালু হওয়া উচিত ছিল? কোথাও অন্তত পিঠ চাপড়ানির হাত রাখা যেত!
তুত্তরে মৃণাল বললেন, যত দিন পর্যন্ত জানা আছে এ আমার চেয়ে উপরে উঠবে না, তত ক্ষণ পিঠ চাপড়ানো যায়। যে মুহূর্তে আমি জানি, এ আমাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, তখন আমি আর হাতটা তুলব না। বলে না, বেশি বড় হয়ে গেলে অনেক মুশকিল হয়।
অথচ, এই মৃণালকেই যখন আবার বলা হল, এখনও দেখা যাচ্ছে সত্যজিত এর উপর আপনার প্রচুর ক্ষোভ রয়েছে। উত্তরে বললেন, দেখুন, ওঁর সঙ্গে আমার নানা সময়ে বিতর্ক এক্সচেঞ্জ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এটা মানতেই হবে টোটালিটি নিয়ে সত্যজিত রায়ের ধারে কাছে কেউ নেই। ওঁর পাশে আমি নেহাত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছি।
রাজনৈতিক এক উত্তাল সময়ের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন তিনি। তাঁর সিনেমাতেও তাই এর প্রতিফলন ঘটেছে। জন্ম ফরিদপুরে, পড়াশোনাও ফরিদপুর কলেজে। তারপরে যান কলকাতায়। সে সময়টা বিশ্বজুড়েই একটা অস্থিরতার। যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপের অর্থনীতির বেহাল দশা। তার আঁচ এশিয়ার দেশগুলোতেও পরেছে। এই দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ সমস্তকিছুর ভেতর দিয়েই তাঁকে যেতে হয়েছে এবং এ সমস্ত কিছুর গল্পই তিনি তাঁর সিনেমায় বলতে চেয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণও তাঁর মধ্যে খুব প্রভাব ফেলেছিল। ১৯৪১ এর ৭ই আগস্ট বিশ্বকবি দেহ ত্যাগ করেন। তাঁর শেষযাত্রায় প্রচুর মানুষের ঢল নেমেছিল রাস্তায়। মৃণালও ছিলেন সেই ভিড়ে। ভিড়কে পেছনে ফেলে উনি চেয়েছিলেন আগেই শ্মশানে পৌঁছে যেতে, এগিয়ে গিয়ে শ্মশানে চলে গিয়েছিলেন। ওখানে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলেন, একজন মাঝবয়সী লোক তাঁর সন্তানের দেহ কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, অপেক্ষা করছেন তাঁর মৃত সন্তানকে দাহ করবেন বলে। সেই ভিড়ে হঠাতই বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে মানুষ সামনে এগুতে চাইলে পদপিষ্ট হয়ে মারা যান অনেকেই। মৃণাল হারিয়ে ফেলেন ওই মানুষটাকে। হয়তো সেই লোকটিও মারা গেছেন। বিষয়টা তাঁকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে তিনি লিখেছেন, “গঙ্গার ধারে এই নিমতলা ঘাটটি ক’দিন ধরেই সরকারি নিরাপত্তার মধ্যে রয়েছে, যাতে কবির দেহের সৎকার সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়। পুলিশের কর্ডন ঘাটের গেটের সামনে। বাধ্য হয়েই আমি দূরে দাঁড়ালাম। আমার মতো আরও অনেকে উপায় না–দেখে দাঁড়িয়ে রইলো একটু দূরে। একটু তফাতে। কিন্তু সেই পুলিশ কর্ডনের ভেতর একটি লম্বা সুদর্শন যুবককে দেখে আমি একটু অবাকই হলাম। কতই বা বয়স হবে পঁচিশ–ছাব্বিশ। সাদা একটা ধুতি তাঁর পরনে আর গায়ে একটা কুর্তা। বিধ্বস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কর্ডনের ভেতরে। সেই যুবকের দুটি হাতের ওপর সাদা কাপড়ে মোড়া একটি মৃত শিশু, যাকে শ্মশানে দাহ করতে এনেছে যুবকটি. নিশ্চয়ই সেই শিশুটির বাবা।কিন্তু এখানে এসে এই নিষ্ঠুর পারিপার্শ্বিক অবস্থায় সে যুবকটি দ্বিধাগ্রস্ত। ও অন্য কোনও শ্মশানে গেলো না কেন!ভাবলাম আমি। যুবকটি একাই এসেছে মনে হল। হয়তো কোনও ব্যাপার আছে যে, এই নিমতলা ঘাটেই তার শিশুটিকে দাহ করতে হবে। হয়তো মনের ভেতর কোনও ইচ্ছে, যুবকটির কোনও বিশেষ অভিমান কাজ করছে। হঠাৎ ভিড়ের ঢেউ। সবদিক দিয়ে। কাতারে কাতার মানুষ শ্মশানঘাট অতিক্রম করতে চলেছে। অসংখ্য মানুষ ছুটে আসছে শ্মশানের দিকে। পুলিশের সবরকম রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা ভেঙেচুড়ে চুরমার হয়ে গেলো জনতার মিছিলে। চারদিকে বিশৃঙ্খলা। ভিড়ের চাপে মানুষের মৃত্যু। কোনোরকম বড় দুর্ঘটনা ঘটছে! কিন্তু মৃত ঐ শিশুটি! শিশুটি হারিয়ে গিয়েছে, ভিড়ের চাপে মৃতশিশুটি পদপিষ্ট হয়েছে! ঐ যুবকটি কি একমাত্র সন্তানের পিতা হয়তো, ‘হ্যাঁ’ হয়তো বা ‘না’।”[ ‘তৃতীয় ভুবন’]
১৯৪৩ সাধারণত পঞ্চাশের মন্বন্তর (বাংলা ১৩৫০ সালে) হিসেবে পরিচিত গুরুতর দুর্যোগ। এতে প্রদেশের প্রায় সাত লক্ষ পরিবারের অথবা ৩৮ লক্ষ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক মর্যাদার লক্ষণীয় অবনতি ঘটে। এর কারণ হল, তারা তাদের যাবতীয় সম্পত্তি তথা ভূমি, লাঙল, গবাদিপশু, গহনা, বাসন–কোসন, যন্ত্রপাতি ও কারিগরি সামগ্রী বিক্রি করতে বাধ্য হয় এবং এভাবে সাড়ে তিন লক্ষ পরিবার চরম দারিদ্র্যে নিপতিত হয়। এর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, একটি হিসাব অনুযায়ী দেখা যায় যে, ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সালব্যাপী দুর্ভিক্ষে এবং এর ফলে সৃষ্ট মহামারিতে ৩৫ থেকে ৩৮ লক্ষ লোক মারা যায়। এ মৃত্যুর হার ছিল স্বাভাবিক মৃত্যুর হারের চেয়ে বেশি। প্রকৃত পক্ষে, এ উপমহাদেশের যে কোনও অংশে ১৭৭০ সালের পর যেসব দুর্ভিক্ষ আঘাত হানে তার মধ্যে এটি ছিল চরম–তম। এই দুর্বিষহ অবস্থা মাথায় রেখেই মৃণাল নির্মাণ করেন তাঁর পরবর্তী সিনেমা ‘বাইশে শ্রাবণ’, যা সারাবিশ্বে খুব সাড়া ফেলে দিয়েছিল। এই সিনেমার সুবাদেই তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা পরিচালক হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। এই সিনেমাটা নিয়েও কম জল ঘোলা হয়নি, সেন্সর বোর্ড বাঁধ সেধেছিল এই সিনেমার নাম নিয়ে। কিন্তু মৃণাল অনড় ছিলেন। পরে অনেক কাঠখড় পুরিয়ে সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেয়েছিলেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে এক মাঝবয়সী ফেরিওয়ালা ও তার ষোড়শী বধূর মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েনের অম্লমধুর কাহিনী নিয়ে তৈরি হয়েছিল মৃণাল–এর এই বিখ্যাত সিনেমা। বাইশে শ্রাবণ এই অসমবয়সী দম্পতির বিবাহের তারিখ, কিন্তু কেন ‘বাইশে শ্রাবণ’? সেন্সর বোর্ডের আপত্তির জায়গাটা এখানেই, তাঁরা তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন নাম পাল্টাবার জন্য। এ বিষয়ে মৃণাল মোটেও আপোষ করেননি। একজন মহাপুরুষের মৃত্যুর তারিখ বাইশে শ্রাবণ বলেই সেটা কারো বিয়ের বা অন্য কিছুর তারিখ হতে পারবে না, এমন তো কোন কথা নেই! ‘বাইশে শ্রাবণ’ মূলত সমাজের প্রচলিত ট্যাবুকে ধাক্কা দেয়া ছবি। তিনি এ ছবি নিয়ে আরও বলেছেন, ‘‘২২শে শ্রাবণে দেখবেন অল্প বয়সের একটি মেয়ের সঙ্গে মাঝবয়সী একজন পুরুষের বিয়ে হয়। পুরুষটি সুদর্শন নয়। মেয়েটির সঙ্গে পুরুষটির সম্পর্কের জন্য ইরোশন ঘটে সম্পর্ক, যখন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তখন সেটা ঘটে যুদ্ধের ভেতর, দুর্ভিক্ষের সময়। যেখানে মেয়েটা বলে, না খেয়ে থাকাটা আমার কাছে বড় কথা নয়, আমি অনেকদিন না খেয়ে থেকেছি, যেটা আমাকে ভাবায়, আমাকে পীড়িত করে, তা হল মানুষটা এখন পালটে গেছে। আমি আমার শুভদৃষ্টির সময় ভেঙে পড়িনি কিন্তু আজ আর সহ্য করতে পারছি না মানুষটাকে। ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে পড়ে একটি সত্য কথা বেরিয়ে পড়লো মেয়েটির মুখে। ঝযব যধং নববহ ফবহরবফ ড়ভ ধ ড়িসধহ বীরংঃবহপব. সেটা সে পরে বুঝতে পেরেছে।’’
গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেবার মতন মানসিকতা তাঁর ছিল না। মার্কেজের মতন সাহিত্যিকের প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করবার মতন দৃঢ়তা ক’জনের থাকে! বিখ্যাত সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়াল গার্সিয়া মার্কেজকে সরাসরি ‘না’ বলে দিয়েছিলেন মৃণাল। মার্কেজ মনে করতেন সব সময় যে তাঁর গল্পের যা গঠন, তাকে উপজীব্য করে সিনেমা বানানো খুব দুরূহ। তাই, অনেক প্রস্তাবেও তিনি রাজী হননি। ১৯৮২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের জুরি বোর্ডে দু’জনের পরিচয় হয়, সেটা বন্ধুত্বতে গড়াতে বেশী সময় লাগেনি। এর কিছুদিন পরে হাভানাতে এক আড্ডায় মার্কেজ মৃণালকে জানান তাঁর ‘অটম অব দ্য পের্টিয়াক’ গল্পটা তিনি লিখেছিলেন ছোটদের একটা বইতে ভারতীয় একটা বাড়ির ছবি দেখে। মৃণাল তাঁকে জানান, এই গল্প ভারতীয় সেই ছবিটা মাথায় রেখে লেখা হলেও গল্পের সমস্তটাই লাতিন আমেরিকা নির্ভর, এটাকে ভারতীয় প্রেক্ষাপটের রূপ দেয়া সম্ভব নয়, সুতরাং তিনি এ ছবি বানাবেন না।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিদ্যা বিষয়ে পড়া–শোনা করবার সময়ে তিনি সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাঁখার সাথে যুক্ত হন। এরপর তিনি সমাজবাদী সংস্থা আইপিটিএর (ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন) সঙ্গে যুক্ত হন পড়াশোনা শেষে প্রথমে সাংবাদিকতা ও পরবর্তীতে একটি ওষুধ কোম্পানির বিপণন কর্মী হিসেবে কাজ করেন। এরপর সিনেমার শব্দ–কৌশলী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। তাঁর প্রথম সিনেমার নাম ‘রাতভোর’। এতে অভিনয় করেছিলেন কিংবদন্তী অভিনেতা উত্তম কুমার। এই সিনেমা একদমই সাফল্য পায়নি। যদিও জানা যায় এই রাতভোর সিনেমার আগে তিনি ‘দুধারা’ (১৯৫০) নামের একটি সিনেমা পরিচালনার সাথে জড়িত ছিলেন, কিন্তু ক্রেডিট লাইনে তাঁর নাম যায়নি। এই চলচ্চিত্রের অন্যতম মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন গীতা সোম, পরবর্তীতে যিনি মৃণাল সেনের স্ত্রী গীতা সেন। প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ভূপেন হাজারিকার পরিচালনা করবার কথা থাকলেও পরবর্তীতে ‘নীল আকাশের নীচে’ (১৯৫৯) সিনেমাটা পরিচালনা করেন মৃণাল। এই সিনেমাটাই তাঁকে আপামর দর্শকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এই যুগান্তকারী গানটাও এই সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছিল প্রথম। সিনেমায় দুটি গান ব্যবহৃত হয়েছিল, যদিও মৃণাল নিজে এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। কিন্তু হেমন্তবাবুর পরামর্শে এই গান দুটি সংযোজনের পরবর্তীতে এর জনপ্রিয়তা দেখে পরবর্তী সিনেমা ‘বাইশে শ্রাবণ’–এ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কেই সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব দেন। ছবি পরিচালনার পাশাপাশি চিত্রনাট্য লেখাতেও তিনি সিদ্ধ–হস্ত ছিলেন। তাঁর লেখা চিত্রনাট্য অবলম্বনে ‘কানামাছি’(১৯৬১), ‘জোড়া দিঘীর চৌধুরী পরিবার’ (১৯৬৬)’ ও ‘কাচ কাটা হীরে’(১৯৬৬) নির্মাণ করেন যথাক্রমে নির্মল মিত্র, টাস ইউনিট ও অজিত লাহিড়ী। এই ছবিগুলো বেশ সমাদৃত হয়। তাঁর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র মোট চারটি – ‘মুভিং পারস্পেকটিভস’ (১৯৬৭), ‘ত্রিপুরা প্রসঙ্গ’ (১৯৮২), ‘ক্যালকাটা মাই এলডোরাডো’(১৯৮৯), ‘অ্যান্ড দি শো গোজ অন’ (১৯৯৬)। বাংলা ভাষার পাশাপাশি মৃণাল সেন হিন্দি, ওড়িয়া এবং তেলেগু ভাষায়ও সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর শেষ চলচ্চিত্র ‘আমার ভুবন’ (২০০২)। এরপরে আর কোন সিনেমা পরিচালনা করেননি তিনি, কিন্তু সিনেমার প্রতি যে তাঁর ভালবাসা অটুট ছিল সব সময় সেটা তাঁর এই কথাতেই প্রতিফলিত হয়েছে পরবর্তীতে, ‘ও ধস ভঁষষ ড়ভ ঈরহবসধ হড়.ি ঞযধঃ রং ধষষ.’ তাঁর ‘জেনেসিস’ সিনেমাটার কথা উল্লেখ না করলে এই লেখা কিছুতেই পূর্ণতা পাবে না। এই সিনেমা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য এখানে তুলে ধরছি, “আমার নতুন ছবিতে ‘জেনেসিস’ এ এই স্পেস–টাইমের ব্যাপারটা আগাগোড়াই ভেঙেছি, ভাঙতে হয়েছে, ভাঙতে গিয়ে মজা পেয়েছি। হয়তো খানিকটা সাহসের পরিচয় দিয়েছি। ব্যাপারটা বলি, রাজস্থানের মরুভূমির যে অঞ্চলে আমরা কাজ করেছি তা এক বিশাল পরিত্যক্ত গ্রাম। বিশাল ছড়ানো, কোনকালে জমজমাট ছিল। বর্তমানে হতশ্রী শ্মশান … সেখানে তিনটি মাত্র চরিত্রের বাস আমাদের ছবিতে। দুই পুরুষ এক নারী, একমাত্র জলাধার একটা বিশাল কুয়ো অনেক দূরে। তিনজনের বাস তিনটে ঘরে। ফারাক অনেকখানি। অথচ তিনজনেই থাকে একসঙ্গে। রান্নাঘরও দূরে। একসঙ্গে থাকে বলেই খাওয়াদাওয়াও একসঙ্গে। জলতোলা খাওয়া দাওয়া কাজ করা সবকিছুর মধ্যেই এক ধরনের ঢ়যুংরপধষ পড়সঢ়ধপঃহবংং আনতে হবে, অথচ অসম্ভব ছড়ানো ব্যাপারটাকেও দর্শকের চোখে ধরিয়ে দিতে হবে। এই দুটোর মধ্যে একটা বিরোধ বা বৈপরীত্য পরিষ্কার ঢ়যুংরপধষ পড়সঢ়ধপঃহবংং ধহফ ংঢ়ৎধষিরহম ঃড়ঢ়ড়মৎধঢ়যু এবং এই দুটোকেই ছবিতে তুলে ধরা এবং ঘটনা ও চরিত্র তিনটের মধ্যে একটা ঘনত্ব আনা আমার কাছে একটা রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মতোই হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং তা সম্ভব হয়েছে ছবি তোলা, কম্পোজিশন নেওয়া আর সম্পাদনা এই তিনের ব্যবহারে।”
গত ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৮ সালে ৯৫ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত রোগে প্রয়াত হন ভারতের প্যারালাল সিনেমার জনক এই কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁর মৃত্যু পরবর্তীতে শ্যাম বেনেগাল বলেছেন, ুসত্যজিৎ–ঋত্বিক–মৃণাল ভারতীয় সিনেমার তিন দিকপাল ও কিছুটা সমসাময়িক ঠিকই। কিন্তু তারা একে অন্যের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ঘরানার – আর মৃণাল–দার কাজ তো তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে অনন্য!…সত্যজিৎ রায়কে যেমন সারা দুনিয়া ্তুপথের পাঁচালী্থর জন্য চেনে, তেমনি শুধুমাত্র ভুবন সোমের জন্যই মানুষ মৃণাল সেনকে মনে রাখবে।”
২০১৩ সালে নেয়া গৌতম ঘোষের সেই সাক্ষাৎকারের শেষ প্রশ্ন ছিল, আজ থেকে পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছর বাদে মৃণাল সেনের কাজ কী ভাবে স্মরণ করা যাবে বলে নব্বই ছোঁয়া মৃণাল সেনের মনে হয়? উত্তরে বলেছেন, জানি না। সে জন্যই মাঝে মাঝে কৌতূহল হয় যদি উঁকি দিয়ে দেখতে পারতাম, কে কী বলছে–টলছে তখন আমার সম্পর্কে!
তথ্য সূত্র: আত্মজীবনী ‘তৃতীয় ভুবন’, ভিউজ অব সিনেমা, দ্যা এবসেন্স ট্রিলজি, অলওয়েজ বিয়িং বর্ন, এক নজরে মৃণাল সেন (ইলিয়াস কমল)