ঈমানদারের  বৈশিষ্ট্য

ডা: মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৯:০১ পূর্বাহ্ণ

আল্লাহতায়ালা পবিত্র কালামে পাকে অনেকগুলো আয়াতে ঈমানদারগণের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। সূরা আল ম’ুমিনুনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে ঈমানদার মানুষেরা মুক্তি পেয়ে গেছে। অর্থাৎ তারা ভাগ্যবান হয়েছেন এবং পরিত্রাণ পেয়েছেন। এই ঈমানদার ব্যক্তিদের বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, ‘যারা নিজেদের নামাজে বিনয়াবনত থাকে’। হযরত আলী ইবনে আবি তালহা (রহঃ) বলেন, ‘এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, তারা সালাত আদায় করা অবস্থায় অত্যন্ত বিনয়ী হয়। তাদের মন আল্লাহর দিকে ঝুঁকে থাকে এবং অন্যদের প্রতি থাকে বিনম্র। হযরত আলী ইবনে আবি তালহা (রহঃ) বলেন, ‘খুশু’ এর অবস্থান হল অন্তরে। হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বলেন, তাদের খুশু থাকে তাদের অন্তরে আর তাদের দৃষ্টি থাকে নিচের দিকে। এই বিনয় ও নম্রতা ঐ ব্যক্তিই লাভ করতে পারে যার অন্তকরণ খাঁটি ও বিশুদ্ধ হয়, সালাতে পুরোপুরি মনোযোগ থাকে এবং সমস্ত কাজ অপেক্ষা সালাতে বেশি আগ্রহী হয়। তখন মনে হয় আনন্দে আপ্লুত এবং চোখে আসে শীতলতা। হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, আমার কাছে সুগন্ধি ও মহিলা খুবই পছন্দনীয় এবং আমার চক্ষু ঠান্ডাকারী হল সালাত (আহমেদ ৩/১৯৯)। এরপরের আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা অর্থহীন বিষয় থেকে বিমুখ থাকে’। অর্থাৎ মুমিনরা বাতিল, শিরক, পাপ, বাজে এবং নিরর্থক কথা থেকে বিরত থাকে। যেমন: আল্লাহতায়ালা বলেন ‘এবং যখন তারা অসার ক্রিয়াকলাপে সম্মুখীন হয় তখন স্বীয় মর্যাদার সাথে তা পরিহার করে চলে’সূরা ফোরকান৭২। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা যাকাত প্রদান করে’। মুমিনদের আরেকটি বিশেষ গুণ হচ্ছে এই যে, তারা তাদের সম্পদের যাকাত আদায় করে কিন্তু একটি প্রশ্ন আসে যে, এটি তো মক্কী আয়াত, অর্থাৎ যাকাত ফরজ হয়েছে রাসূল (সাঃ) মদিনায় হিজরতের দ্বিতীয় বছর।

অতএব মক্কী আয়াতে যাকাতের বর্ণনা কেমন করে হয়? এর উত্তর এই যে, যাকাত মক্কায় ফরজ হয়েছিল তবে নিসাবের পরিমাণ কত, এটার হুকুমসমূহ মদিনায় নির্ধারিত হয়েছিল। অন্যত্র দেখা যায়, সূরা আনআম মক্কী সূরা অথচ এর মধ্যেও যাকাতের বিধান বিদ্যমান রয়েছে, ‘ফসল কাটার দিনই ওর যাকাত আদায় কর’সূরা আনআম১৪১। অর্থাৎ যাকাতের অর্থ এই হতে পারেনফসকে শিরক এবং কুফরীর পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র করে। যেমন: আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেই সফলকাম হবে, যে নিজেকে পবিত্র করবে এবং সেই ব্যর্থ হবে যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে’সূর আস শামস,১০। অর্থাৎ এও হতে পারে, নফস এর অভ্যন্তরীণ ও ধন সম্পদ এই উভয় জিনিসের পবিত্রতা হাসিল করতে বলা হয়েছে। কারণ ধনসম্পদের পবিত্রতা রক্ষা করার কথা মানুষ তখনই খেয়াল করবে যখন তার হৃদয় মন সব দিক থেকে পবিত্র থাকার চিন্তা ভাবনা করে। আরেকটি আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা তাদের যৌন অঙ্গসমূহের হেফাজত করে। তবে নিজেদের স্বামীস্ত্রী কিংবা নিজেদের অধিকারভুক্তদের উপর এটা প্রযোজ্য নয়, (এখানে যৌন অঙ্গসমূহের হেফাজত না করলে) কখনো তারা তিরস্কৃত হবে না, এছাড়া কেউ যদি অন্য কোন (পন্থায় যৌন কামনা চরিতার্থ করতে) চায়, তাহলে তারা হবে সীমালংঘনকারী। আল্লাহতায়ালা যে সব বিষয়ে নিষেধ করেছেন তা মেনে নিয়ে যারা নিজেদের গোপনাঙ্গ হেফাজত করে এবং আল্লাহতায়ালা যা নিষেধ করেছেন তা থেকে নিজেদের বিরত রাখে যেমন: ব্যভিচার, লম্পটতা পরিহার করে এবং বিয়ের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা তাদের জন্য যাদেরকে বৈধ করেছেন এবং যুদ্ধলব্ধ দাসী যাদেরকে আল্লাহতায়ালা হালাল করেছেন তারা ছাড়া অন্যদের কাছে গমন করে না। মুমিনদের আরেকটি অন্যতম গুণ হচ্ছে, ‘যারা তাদের (কাছে রক্ষিত) আমানত ও প্রতিশ্রুতিসমূহের হেফাজত করে’। অর্থাৎ তারা আমানতের খেয়ানত করে না বরং আমানত আদায়ের ব্যাপারে তারা অগ্রগামী হয়। তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। এর বিপরীত স্বভাব হল মুনাফিকের। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, মুনাফিকের লক্ষণ ৩টিযখন কথা বলে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে এবং তার কাছে কিছু আমানত রাখা হলে তার খেয়ানত করে– (ফাতহুল বারী ১০/৫৫২)। মহান আল্লাহতায়ালা ঈমানদারদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন, সেটি হল, ‘যারা নিজেদের নামাজসমূহের ব্যাপারে যত্নবান হয় অর্থাৎ তারা সালাতের সময়ের হেফাজত করে। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আল্লাহর নিকট কোন আমল সর্বাধিক পছন্দনীয়? উত্তরে তিনি বললেন, সময়মত সালাত আদায় করা। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোন আমল? তিনি জবাব দিলেন, মাতাপিতার খেদমত করা। আমি পুনরায় প্রশ্ন করলাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর প্রতি জিহাদ করা। হযরত কাতাদাহ (রহঃ) বলেন যে, সঠিক সময়ে যথাযথভাবে রুকুসেজদা ইত্যাদির হেফাজত করা মূল উদ্দেশ্য। এখানে একটি বিশেষ ব্যাপার লক্ষণীয়: প্রথমে একবার সালাতের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এরপর শেষেও আবার বর্ণিত হয়েছে। এর দ্বারা প্রমাণিত হল যে, সালাতের গুরুত্ব ও ফজিলত সবচেয়ে বেশি। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘তোমাদের আমলসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম আমল হল সালাত। আর অযুর হেফাজত শুধুমাত্র মুমিনরাই করে থাকে’ (ইবনে মাজাহ ২/১০১)। ঈমানদার ব্যক্তিদের এই প্রশংসনীয় গুণাবলীর বর্ণনা দেওয়ার পরই মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এই লোকগুলোই (হচ্ছে মূলত জমিনে আমার যথার্থ) উত্তরাধিকারী। যারা হবে জান্নাতুল ফেরদৌসের উত্তরাধিকারী। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে’। রাসূল (সাঃ) বলেন, তোমরা আল্লাহর নিকট জান্নাতের জন্য প্রার্থনা করলে ফেরদৌসের জন্য প্রার্থনা কর। এটি হচ্ছে সর্বোচ্চ এবং জান্নাতের মধ্যখানে অবস্থিত। সেখান থেকে জান্নাতের সমস্ত নহর প্রবাহিত হয়ে থাকে এবং এর উপরেই রয়েছে আল্লাহতায়ালার আরশ (ফাতহুল বারী ১৩/৪১৫)। হযরত ইবনে আবি হাতিম (রহঃ) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন তোমাদের প্রত্যেকেরই দুটি মঞ্জিল রয়েছে: একটি মঞ্জিল জান্নাতে এবং একটি মঞ্জিল জাহান্নামে। যদি কেহ মারা যায় ও জাহান্নামে প্রবেশ করে তাহলে তার মঞ্জিলের উত্তরাধিকারী হয় আহলে জান্নাত। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এটা হল ঐ জান্নাত যার অধিকারী আমার বান্দাদের করে থাকি, যারা আমাকে ভয় করে’সূরা মরিয়ম৬৩। অন্য জায়গায় আল্লাহতায়ালা বলেন, এটা হল ঐ জান্নাত যার অধিকারী তোমাদেরকে বানিয়ে দিয়েছেন তোমাদের কৃতকর্মের বিনিময় হিসেবে’সূরা যুখরুফ৭২। ঈমানদারদের উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য থেকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বর্ণনা সন্নিবেশিত করতে পারি। যেমন: ১। যারা কোরআন ও আল্লাহ রাসূল (সাঃ) এর কথা মেনে নিয়ে এই গুণাবলী নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করবে এবং এই নীতির অনুসারী হবে তারা যে কোন দেশ, জাতি, গোত্রের হোক না কেন অবশ্যই তারা দুনিয়া ও আখেরাতে সফলকাম হবে। ২। সফলতা নিছক ঈমানের ঘোষণা অথবা সচ্চরিত্র ও সৎ কাজের ফল নয় বরং উভয়ের সম্মিলনের ফল। মানুষ যখন আল্লাহর পাঠানো পথনির্দেশ মেনে চলে এবং সেই অনুযায়ী নিজের মধ্যে উন্নত নৈতিকতা ও সৎকর্মশীলতা সৃষ্টি করে তখন সে সফলতা লাভ করে। ৩। নিছক পার্থিব ও বৈষয়িক প্রাচুর্য্য ও সম্পদ এবং সীমিত সাফল্যের নাম সফলতা নয়। বরং তা একটি ব্যাপক কল্যাণকর অবস্থার নাম। দুনিয়ায় ও আখেরাতে স্থায়ী সাফল্য ও পরিতৃপ্তিকে এই নামে অভিহিত করা হয়। এটি ঈমান ও সৎকর্ম ছাড়া অর্জিত হয় না। পথভ্রষ্টদের সাময়িক সমৃদ্ধি ও সাফল্য এবং সৎ মুমিনদের সাময়িক বিপদ আপদকে এই নীতির সাথে সাংঘর্ষিক গণ্য করা যেতে পারে না। ৪। মুমিনদের এই গুণাবলীকে নবী করিম (সাঃ) এর মিশনের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে। অতএব আমরা আল্লাহর কালামে পেশকৃত ঈমানদার ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য অর্জনে সচেষ্ট হওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা করব, এতেই একদিন সাফল্যের আলো দেখতে পারবো ইনশাল্লাহ।

লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),

জেনারেল হাসপাতাল, রাঙ্গামাটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেরিতে হলেও যৌক্তিক চিন্তা চেতনা
পরবর্তী নিবন্ধআধুনিক বাংলা গানের কথা