বছরজুড়ে চলে আসা অনলাইন ব্যবসা ঈদ মৌসুমের কেনাকাটায়ও ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ই–কমার্স, এফ–কমার্স (ফেসবুক কমার্স) এবং অনলাইন সার্ভিস ভিত্তিক ব্যবসার পরিমাণ হু হু করে বাড়ছে। মার্কেটে মার্কেটে ভিড়ের পাশাপাশি মোবাইল ল্যাপটপেও শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য চলছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) ব্যাপক প্রসার অনলাইন ব্যবসা সম্প্রসারণের নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। সম্ভাবনার পাশাপাশি আস্থার সংকট এই ব্যবসাকে বেশ বড় রকমের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে। এক পণ্যের ছবি দিয়ে অন্য পণ্য সরবরাহ দেয়াসহ বিশ্বাস ভঙ্গ এবং আস্থাহীনতাসহ বেশ কিছু সমস্যা সম্ভাবনাময় এই খাতকে সংকটে ফেলছে। শুধু বিশ্বাস এবং আস্থা ধরে রেখে মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে এই ব্যবসা অচিরে আকাশ ছোঁবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র জানিয়েছে, তথ্য প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে দেশে অনলাইন ব্যবসা শুরু হয়। বেশ কয়েক বছর আগ থেকেই দেশে অনলাইন ব্যবসার কার্যক্রম চলছে। তবে করোনাকালে দেশব্যাপী লকডাউন চলাকালে বিভিন্ন ই–কমার্স ও ফেসবুকভিত্তিক এফ–কমার্স সাইটগুলো বহু মানুষেরই কেনাকাটার অন্যতম অবলম্বন হয়ে উঠে। হাজার হাজার মানুষ চাল ডাল থেকে শুরু করে গাড়ি পর্যন্ত কিনে অনলাইনে। কোরবানির গরুর পাশাপাশি মাছ মাংস তরিতরকারি পর্যন্ত সবই কেনা হচ্ছে অনলাইনে। মহিলাদের শাড়ি গয়না থেকে শুরু করে ব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্য অনলাইন শপিং থেকে কেনাকাটা করেন। শপিং মল বন্ধ থাকা, দোকানপাট লকডাউনের আওতায় থাকা, গণপরিবহনসহ যান চলাচল বন্ধ থাকাসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় মানুষের অবলম্বন হয়ে উঠে হোম ডেলিভারির অনলাইনে কেনাকাটা।
করোনাকালে অনলাইন কেনাকাটার বিশাল বাজার গড়ে উঠে। শত শত কোটি টাকার পণ্য কেনাবেচা হয় অনলাইনে। একটি সমীক্ষার উদ্বৃতি দিয়ে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটি ছাড়িয়েছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা অনলাইন ব্যবসার বিশাল সম্ভাবনাময় এক বাজার তৈরি করেছে। দেশে ই–কমার্সের বাজার প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় ২ লাখ অনলাইন ব্যবসা বর্তমানে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যার মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি ফেসবুক–ভিত্তিক (এফ–কমার্স) দোকান রয়েছে। দেশের প্রায় ২০ লাখ মানুষ অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস যেমন বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় ই–কমার্স লেনদেনকে সহজ করেছে। বাংলাদেশে ই–কমার্স প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দারাজ, চালডাল, রকমারি, সহজ, পিকাবু, গ্রোসারি বাজার, বইবাজার ইত্যাদি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর বাইরেও শত শত সাইটের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ নানাভাবে অনলাইন ব্যবসা করছে। একজন মানুষের প্রাত্যহিক প্রয়োজনের এমন কোন জিনিস বা পণ্য নেই, যা অর্ডার করলে বাসায় হাজির হচ্ছে না। অনলাইন ব্যবসা মানুষের জীবনযাত্রাকেও সহজ করে দিয়েছে। সময় এবং অর্থ দুটোই বাঁচিয়েছে অপ্রত্যাশিতভাবে। দেশের ই কমার্স প্ল্যাটফরমগুলোতে প্রতিদিন কয়েক লাখ পণ্যের অর্ডার ও ডেলিভারি হচ্ছে। পণ্য ভেদে বর্তমানে ই কমার্সের প্রবৃদ্ধি ৩শ’ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত হয়েছে।
একটি সমীক্ষার উদ্বৃতি দিয়ে দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০২২ সাল শেষে ই–কমার্সের বাজারের আকার ছিল ৬৬০ কোটি ডলার। আগামী চার বছরে ই–কমার্সের বাজার আরও প্রায় ৪০০ কোটি ডলার বাড়বে। আগামী বছরের শেষ দিকে ই কমার্সের বাজার ১ হাজার ৫০ কোটি ডলার বা ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
সূত্র বলেছে যে, ই–কমার্সের বাজার সমপ্রসারণের সবগুলো সূচকেই বাংলাদেশ খুবই শক্ত অবস্থানে রয়েছে। ফেসবুকে সক্রিয় বিশ্বের এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। এদেশের কোটি কোটি মানুষ রাতে দিনে ফেসবুকে সক্রিয় থাকেন। ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয় করে এমন দশটি শীর্ষ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। ফেসবুক, গুগল, অ্যামাজনের মতো অনাবাসী প্রতিষ্ঠানগুলোও বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে অনলাইন ব্যবসা যে আরো সম্প্রসারিত হবে তাতে অনেকেরই কোন সংশয় নেই।
তবে এই ব্যবসা বড় ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখেও রয়েছে। আস্থার সংকট এই ব্যবসার একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এক ধরণের পণ্য দেখিয়ে নিম্নমানের পণ্য গছিয়ে দেয়ার অভিযোগ প্রায় প্রতিদিনই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু প্রতারিত ক্রেতা ফেসবুকে নিজের ক্ষোভ ঝাড়া ছাড়া প্রতারক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। বিষয়টি খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায় যে, ই–কমার্স নিয়ে সরকারিভাবে কোনো নীতিমালা প্রণীত হয়নি। নীতিমালা না থাকার কারণে ই–কমার্সে প্রতারণা, জালিয়াতি, অনিয়ম হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। দেশের সাধারণ আইনে প্রতারণার মামলা করার সুযোগ থাকলেও থানায় মামলা রেকর্ড বা মামলা প্রমান দুটোই কঠিন একজন সাধারণ ক্রেতার কাছে। এভাবে বহু প্রতারক ফেসবুকে অনলাইন ব্যবসার সম্ভাবনাকে নষ্ট করছে। আস্থার ঘাটতিই দেশে ই–কমার্সের বাজার সম্প্রসারণে প্রধান বাধা হয়ে উঠেছে। প্রতারণার এই সংকট কাটানোর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও নিতে হবে বলে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, ই কমার্সের সম্ভাবনা অনেক। বিশাল এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে শুধু ই–কমার্সই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব। এতে উদ্যোক্তা তৈরির পাশাপাশি ব্যাপক কর্মংস্থান সৃষ্টির সুযোগও রয়েছে বলেও তারা মন্তব্য করেছেন।
ঈদকে সামনে রেখে দেশের অনলাইন ব্যবসা জমজমাট বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, শাড়ি, পাঞ্জাবি, মেয়েদের নানা অলংকার, সেমাই–চিনি, চাল–ডালসহ প্রায় সব ধরণের পণ্যেরই পসরা সেজেছে অনলাইন দুনিয়ায়। কিন্তু বিশাল এই কেনাকাটায় শত শত প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। পণ্যের মান, দাম ঠিকঠাকভাবে থাকছে না। ক্রেতারা প্রতারিত ও বিড়ম্বিত হচ্ছেন, যা সম্ভাবনাময় খাতটির দিক থেকে ত্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। সামনের দিনগুলোতেও অনলাইন ব্যবসা ধরে রাখতে আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটা অনেক পোক্ত হওয়া দরকার বলেও একাধিক ক্রেতা গতকাল মন্তব্য করেছেন। এই ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়নের জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।