পবিত্র রমজানে দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার কষ্ট ও ক্লান্তির পর মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাপী এক শ্রেষ্ঠ উপহার হলো পবিত্র ঈদুল ফিতর। মহান আল্লাহর অনুকম্পা, ক্ষমা, অনুগ্রহ ও নৈকট্য লাভের লক্ষ্যে ঈদুল ফিতর বিশ্ব মুসলিমের জন্য এক অনন্য উৎসব। বলা হয়ে থাকে, এটি মুসলিম জাহানের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ঈদ শুধু আনন্দ উৎসবই নয়; এটি আমাদের শান্তি, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও ত্যাগের শিক্ষা দেয়। পরস্পরের মধ্যে আনন্দ ও দুঃখ ভাগাভাগি করার মাধ্যমে আমরা মৈত্রী ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হই।
হিংসা–বিদ্বেষ ও হানাহানি ভুলে মানুষ একে অপরের ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ঈদ ধনী–গরিব নির্বিশেষে সবার জীবনে আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। ঈদের আনন্দ আমাদের সবার।
ঈদ আরবি শব্দ। এটি ‘আওদ’ শব্দমূল থেকে উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ হল ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা, বার বার আসা। মুসলমানদের জীবনে চান্দ্র বৎসরের নির্দিষ্ট তারিখে প্রতি বছরই দুটি উৎসবের দিন ফিরে আসে। তাই দিন দুটিকে ঈদ বলা হয়। ফিতর শব্দের অর্থ হলো ভেঙে ফেলা, বিদীর্ণ করা। মুসলমানরা রমজানের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রোজা রাখা আরম্ভ করে এবং শাওয়ালের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রোজা ভেঙে দেয় তথা রোজা রাখা ছেড়ে দেয়। সে কারণে এটিকে ঈদুল ফিতর তথা রোজা ভাঙার আনন্দ বলা হয়।
ইসলামী চিন্তকদের মতে, ঈদ এমন এক নির্মল আনন্দের আয়োজন, যেখানে মানুষ আত্মশুদ্ধির আনন্দে পরস্পরের মেলবন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং আনন্দ সমভাগাভাগি করে। মাহে রমজানের রোজার মাধ্যমে নিজেদের অতীত জীবনের সব পাপ–পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার অনুভূতি ধারণ করেই পরিপূর্ণতা লাভ করে ঈদের খুশি। ঈদুল ফিতর বা রোজা ভাঙার আনন্দ–উৎসব এমনই এক পরিচ্ছন্ন আনন্দ অনুভূতি জাগ্রত করে, যা মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের পথপরিক্রমায় চলতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সানন্দে ঘোষণা করেন, ‘প্রতিটি জাতিরই আনন্দ–উৎসব রয়েছে, আমাদের আনন্দ–উৎসব হচ্ছে এই ঈদ।’ (বুখারি ও মুসলিম)।
ইসলামী চিন্তাবিদরা বলেন, ঈদ মানে ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তিত হওয়া। তাই ঈদের মাধ্যমে খুশির উৎসব ও প্রত্যাবর্তনের বার্তা লিপিবদ্ধ রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে খুশির হাওয়া বইতে থাকে, সর্বত্র উৎসবের আমেজ বিরাজ করে, মানুষের পুনর্মিলনী বা সম্মিলন ঘটে, তাই প্রাণের এ উৎসবকে আমরা ঈদ বলে থাকি। আবার মহাকালের ঘূর্ণাবর্তে প্রতি বছরই ঈদ আমাদের মাঝে ফিরে ফিরে আসে, মানবচিত্তে আনন্দ–উল্লাসের দোলা দিয়ে যায়, সমাজ–মানসে নিখুঁত শিল্পীর অদৃশ্য তুলি দিয়ে প্রত্যাবর্তনের চিত্রাঙ্কন করে বেড়ায় এবং এ প্রত্যাবর্তনের গল্পে থাকে তাৎপর্যময় ও জীবন–জগতের জন্য পরম শিক্ষা। তাই আমাদের উচিত, ঈদ পালনের ভেতর দিয়ে শুধু উৎসবের সাগরে অবগাহন না করে প্রকৃত অর্থে এই প্রত্যাবর্তনের বার্তা, তাৎপর্য ও শিক্ষাকে গ্রহণ করা; তবেই আমাদের ঈদ উদযাপন সার্থক হয়ে উঠবে।
ঈদ একতার শিক্ষা দেয়, সমাজের বিভেদ ও বৈষম্য দূর করার শিক্ষা দেয়। ধর্মীয় বিধিবিধানের মাধ্যমে ধনী–গরিব সর্বস্তরের মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেয়। সর্বোপরি পরস্পরের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা দেয়। মহান আল্লাহর কাছে আমাদের প্রত্যেকের প্রার্থনা, পৃথিবীর সকল মানুষের সুখ–শান্তি, কল্যাণ ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি। বর্তমানের ওপর দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতকে তৈরী করা; আগামী দিনগুলোতে যেন মানুষ শির তুলে চলতে পারে। আমরা চাই সবার জীবন সত্য, সুন্দর ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হোক! হাসি–খুশি ও ঈদের অনাবিল আনন্দে প্রতিটি মানুষের জীবন পূর্ণতায় ভরে উঠুক!
ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, সংযম, সৌহার্দ্য ও সমপ্রীতির মেলবন্ধন পরিব্যাপ্তি লাভ করুক– এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা। হাসি–খুশি ও ঈদের অনাবিল আনন্দে প্রতিটি মানুষের জীবন পূর্ণতায় ভরে উঠুক। বিশ্বের সব মানুষের সুখ–শান্তি, কল্যাণ ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি হোক– মহান আল্লাহর কাছে এ প্রার্থনা আমাদের।