ঈদ উদযাপন : সেকাল আর একাল

আলী আশরাফ চৌধুরী | শুক্রবার , ২১ এপ্রিল, ২০২৩ at ১১:২৭ পূর্বাহ্ণ

জীবন জীবিকার পরিবর্তনের সাথে সাথে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানাদিও যে কিভাবে বদলে যাচ্ছে তা কল্পনাই করা যায় না। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদুল ফিতর। আমাদের ছোট বেলায় অর্থাৎ ’৬০ এর দশকে আমরা কীভাবে ঈদ উদযাপন করতাম আর এখন আমাদের ছেলেমেয়েরা সেটা কীভাবে পালন করছে ভাবতেই অবাক লাগে, কতো পরিবর্তন এসেছে সমাজে।

আমরা ছোট বেলায় রোজার আগমনী চাঁদ দেখা নিয়ে সে কী আনন্দ, বিকেল থেকেই পশ্চিমের আকাশে সকলের দৃষ্টি কোথায় লুকিয়ে আছে রমজানের বাঁকা চাঁদ। সময়মতো দেখা গেলেইতো ভালো, না হয় সে কী বিড়ম্বনা কোথায় কার বাড়িতে রেডিও আছে খবর শুনতে হবে কাল রোজা শুরু হচ্ছে কি না ? ঠিক তদ্রুপ মাস শেষে ঈদের চাঁদ দেখা গেলো কি না, আগামীকাল ঈদ হচ্ছে তো? ছোট বেলায় রোজা আমাদের জন্য ফরজ হোক বা না হোক সেহেরীতে উঠতেই হবে দুধ কলা দিয়ে ভাত খাবো বলে। আজকাল বাচ্চারাতো দুধ ভাত খেতেই চায় না। ফাস্টফুডের প্রতি তাদের যতো আসক্তি।

রোজা শুরু হবার সাথে সাথে ভাইবোনদের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে যেতো ঈদের নতুন কাপড় নিয়ে। সকলের জন্যে বরাদ্দ থাকতো এক সেট কাপড়। ছেলেরা পাবে শার্ট ও পেন্ট আর জুতা আর মেয়েরা পাবে ফ্রক, সেলোয়ার সাথে সেন্ডেল। এটাই যথেষ্ট, এতেই সবাই মহা খুশী। বেশিরভাগ ঈদে আমরা পেতাম রেডি মেইড জামা। দর্জির বিড়ম্বনা আর বিলম্বের কারণে হয়তো। সারা বছরের জল্পনা কল্পনার অবসান হয়ে যেতো যখন কাপড়গুলো ঘরে আসতো, সে রাতে কারো চোখে ঘুম নেই। আম্মার তাগাদা থাকতো কাপড় এবং জুতাগুলো যেন এক সাইজ বড় কেনা হয়। কারণ কয়েকদিন পর এগুলো ছোট হয়ে যাবে। আসলে এগুলো ছোট হবে না আমরাই বড় হয়ে যাবো। ঈদের কাপড়গুলো সাধারণত বাইরের কাউকে দেখানো হতো না পুরানো হয়ে যাবে বলে। আমরা যার যার সুবিধা মতো কাপড়গুলো ভাঁজ করে ঠাণ্ডা ইস্ত্রীতে দিয়ে নিজেদের হেফাজতে রেখে দিতাম। ঈদের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ‘বিলাতী সাবান’ দিয়ে গোসল সেরে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে যেতাম মসজিদে যাবার জন্যে। ঈদের নামাজ, কোলাকুলি আর কবর জেয়ারত শেষে ঘরে এসে পরিবারের সবাইকে পায়ে ধরে সালাম করতাম। ঈদের আগের দিন চাঁদরাতে প্রত্যেক ঘরে ঘরে গুড়ি পিঠা ও কদুর সেমাই বানানো হতো। সেগুলো আমরা খেতাম। তারপর দেশি সেমাই। ভি.আই.পি আত্মীয় স্বজন ও মেহমানদের জন্য বিলাতী সেমাই মানে লাচ্ছা সেমাই ও আমাদের কাট্টলী এলাকার ঐতিহ্যবাহী ‘শীলভাজা’ বানানো হতো। এটি পুডিং এর আদি সংস্করণ (ডিম, দুধ, চালের গুড়া, নারিকেল, চিনি এসব দিয়ে বানানো হতো)। প্রত্যেক ঈদে আমাদের ঘরে গরুর পায়া ও ভুনা গোশত রান্না হতো আবশ্যিক ভাবে। আমাদের আত্মীয় স্বজনেরা খুবই মজা করে খেতেন আমার আম্মার এ রান্না।

আমাদের ছোট বেলায় তখনো ঈদির প্রচলন হয়ে উঠেনি। ভাই বোনেরা সবাই একসাথে বেড়াতে যেতাম বাড়ি বাড়ি আত্মীয় অনাত্মীয় সকলের ঘরে ঘরে। প্রত্যেক ঘরে খাওয়া হতো না, তাড়াতাড়ি সালাম করে বেড়িয়ে যেতাম। দুপুর পেরিয়ে বিকেল অবধি এ ঘুরাঘুরি চলতো। ইতিমধ্যে অনেকের চোখে ১ টাকা দামের ১টি চশমা ও ২ টাকা দামের ১টি হাত ঘড়ি শোভা পাচ্ছে, মাঝে মাঝে এক টাকা দামের আইসক্রিমও খাওয়া হতো, তাতেও কতো আনন্দ।

প্রায় ঈদেই দেখতাম নতুন জুতার কারণে পায়ে ফুসকা পড়ে যেতো। তাই, বাড়ি ফেরার পথে জুতা জোড়া হাতে না হয় বগলে স্থান পেতো। ঈদের পরদিন খালা, ফুফু ও বোনদের বাড়ি যাওয়া হতো। এখনকার ছেলেমেয়েরা আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি যাওয়ার চেয়ে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ঘুরাঘুরিতে বেশি আগ্রহী। রোজার সময় আমরা আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে ঘরে বানানো ইফতারী নিয়ে যেতাম টিফিন কেরিয়ারে করে। আর এখন সবাই হোটেল রেস্টুরেন্টের উপর নির্ভরশীল অর্ডার দিয়েই সারা। সে কারণে হয়তো বর্তমান গৃহিনীরা অনেকটা ঝামেলামুক্ত আছেন। আজকাল ছেলেমেয়েরা ঈদ উপলক্ষে পাচ্ছে ৪/৫ সেট করে জামা কাপড় তাতেও কেমন জানি তাদের মাঝে সেই উপচে পড়া আনন্দ দেখি না। এখন কেনা কাটা হয় অনলাইনে অর্ডার দিলেই জিনিসপত্র ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে চাহিদা মাফিক। ঈদের দিনে ডাইনিং টেবিল ভর্তি হয়ে যাচ্ছে রকমারী দেশি বিদেশি বিভিন্ন পদের খাবারে। আগের মতো এখন আর ছেলে মেয়েরা সবাইকে পায়ে ধরে সালাম করতে আসে না। কারণ ফেইসবুক ও ইউটিউব এর মাধ্যমে এরা জেনেছে এটা নাকি বেদায়েত। অথচ আমরা এটাকে শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে জানতাম। বর্তমানে ঈদুল ফিতরের বিশেষ আকর্ষণ হলো ‘ঈদি’। ছেলেমেয়ে, বৌজামাই, আত্মীয় স্বজন কেউ এর আওতা থেকে বাইরে নেই। জিনিসপত্র আর ক্যাশ টাকার মাধ্যমে এই ঈদির আদান প্রদান চলছে। ছেলে মেয়েরা ঈদির টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করে বেড়াচ্ছে আর বিভিন্ন নামীদামী হোটেল রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করছে মহা আনন্দে।

লেখক: আইনজীবী, সাবেক সহসভাপতি, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশৈশব-স্মৃতিতে ঈদ
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা