ঈদ আসে ঈদ যায়

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ২৯ এপ্রিল, ২০২৩ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

ঈদ আসে সময় যেমনই থাক। প্রতি বছর একবার এসে মনে করিয়ে দিয়ে যায় মানুষের আনন্দমিলনে, মানুষ যোগে, একাত্মতায়, নিজ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে মমতার হাতটুকু বাড়িয়ে দিলে শান্তির প্রগাঢ় ছায়া ফেলে সমাজে। আমাদের চারপাশে, সমাজে রাজনীতিতে, নারীপুরুষ ভেদাভেদে যা কিছু চলছে তা বিভেদ ও ভাঙনের। কখনো ধর্মের নামে, কখনো ভিন্ন মতের, কখনো নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতায়, কখনো শ্রমিকের প্রতি বঞ্চনায়। ঈদ আসে মিলনের বার্তা পৌঁছে দিতে। মানুষের কুপ্রবৃত্তিগুলো দূর করার উপলক্ষ হয়ে।

পূর্ব বাংলায় ঈদের প্রচলন খুব বেশিদিনের নয়। একসময় দরিদ্রপীড়িত এই অঞ্চলের মানুষগুলোর কাছে ঈদ ছিল ঈদের দিনে জমিদারদের রাজকীয় সুশোভিত হাতির মিছিল থেকে ছুড়ে ফেলা পয়সা কুড়িয়ে নেওয়া। আবার কখনো ষাঁড়ের লড়াই, মুরগির লড়াই, ফুটবল খেলা এসবই ছিল ঈদ উদযাপনের অনুষঙ্গ। গত শতকের ত্রিশের দশক থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আত্মপ্রকাশ ও আত্মবিকাশের ফলে বাঙালি মুসলমানের সামনে নতুন দরজা খুলে যায়। বাঙালি মুসলমানের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। নব আঙিকে নব ব্যঞ্জনায় ধর্মীয় এই ঈদ উৎসবকে প্রাণবন্ত করে তোলে।

বাঙালি মুসলমান সমাজে গানবাজনা নিষিদ্ধ ছিল। এই বাস্তবতায় কাজী নজরুল ইসলাম ইসলামী গান লেখা শুরু করেন। তাঁর গানগুলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়। প্রফেসর শামসুজ্জামান খান ঈদ সম্পর্কে লিখেছেন ‘এই উৎসবের নব সৃজনে একে ফজলুল হক সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতায় নব চিন্তার লেখক, সাংবাদিক, গায়ক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদেরও অবদান ছিল। এবং এক্ষেত্রে নজরুলের অবদান বৈপ্লবিক। তার সঙ্গে এই নব যাত্রায় যোগ দিলেন কিংবদন্তী প্রতিম গায়ক আব্বাসউদ্দীন আহমদ। তখন রেকর্ড কোম্পানি বের করলো নজরুলের ইসলামী গানের জনপ্রিয় রেকর্ড।

বাঙালি মুসলমানের ঈদ উৎসব সামাজিক তাৎপর্যই লাভ করলো না হয়ে উঠলো এক নতুন সাংস্কৃতিক জাগরণের সার্বজনীন উৎসবও।’ বিশেষ করে ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’ এই একটি মাত্র গান সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দেয় ঈদের আনন্দবার্তা। আজও সেই গান শুনে মানুষ ঈদের আনন্দ উপভোগ করে। এই গানের আবেদন এতটুকু কমেনি। এই গানই উচ্চবিত্ত পরিবারের ঈদকে সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়।

এখন ঈদ মানে বাজার অর্থনীতি। হাজার হাজার কোটি টাকার বিপণন। বিশাল দৈত্যকায় ঈদ যেন জাঁকিয়ে বসে। বিপণি কেন্দ্রগুলোতে ছিল মানুষে ঠাসা। উৎসব উদযাপনে ছিল দিশেহারা মানুষ! আলো ঝলমলে এই উৎসবের ভেতর থেকে কখনও কখনও এই উৎসবের অংশী হতে না পারার বেদনার্ত গল্পও উঠে আসে। সংগতিহীন পরিবারের কোন আদুরে মেয়ে একটি জামার জন্য, অল্প বয়সী কোন গৃহবধু একটি শাড়ির জন্য অথবা দরিদ্র বাবার একমাত্র ছেলে একটি লুঙ্গি না পাওয়ার কষ্টে বেদনায় হতাশায় আত্মহননের পথও বেছে নেয়। প্রদীপের নীচে এই খবরগুলো অন্ধকার হয়ে থাকে।

এসব নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাই না আমরা! আমাদের ঈদকে ঘিরে, আমাদের নববর্ষকে ঘিরে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ। মধ্যরাত পর্যন্ত চলে বিকিকিনি। কর্মচারীরা ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। অথচ কয়েক দশক আগেও ঈদের এমন জমকালো চেহারা ছিল না।

এখনও মনে পড়ে আমাদের সেই অনাড়ম্বর অথচ অনেক বেশি আনন্দের স্মৃতিময় দিনগুলো। নতুন জামা সেলাই হয়েছে কিনা জানার জন্য খলিফার(দর্জি) কাছে বারবার ছুটে যাওয়া। জুতার বাক্স মাথার পাশে নিয়ে ঘুমানো, নতুন জামা লুকিয়ে রাখা। ঈদের সালামী রাখার জন্য ব্যাগ সংগ্রহ করা, হাতে চুনের ফোটা দিয়ে মেহেদী লাগানো। আরও কত কি। এতেই আনন্দের সীমা ছিল না।

ঈদের দিন সকালে ভোরে উঠে গোসল করে নতুন জামা পরে, মায়ের হাতের সেমাই খেয়ে ঈদগাহের আশেপাশে ছুটাছুটি, দলবেঁধে এঘরওঘর। আর একটু বড় হলে ঈদ সংখ্যায় মুখ গুঁজে থাকা আরও পরে বিটিভির অনুষ্ঠানের মুগ্ধ দর্শক হয়ে বসে থাকা। আমাদের পরিবারের মেয়েরা আমাদের দুই চাচার ঘর ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার অনুমতি ছিল না। বহুদিন আগে জমিদারী চলে গেলেও জমিদারী ভাবখানা অক্ষত ছিল আমাদের পরিবারে।

ঈদের দিন শুধু বন্ধুদের বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি মিলতো। তখন বাঁধনহারা ছুটতাম। কি অসাধারণ ছিল সেই স্বাধীনতা! এত আনন্দ, এত স্বাধীনতার আনন্দে ভাসতে ভাসতে সন্ধ্যার দিকে দেখা যেতো অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আনন্দ তখন ও সালামীর ব্যাগে ভরপুর হয়ে থাকতো। মা,ভাবীরা বিকেলের দিকে নতুন কাপড় পরতেন। কারণ তারা এত ব্যস্ত থাকতেন রান্নাবান্নায়, মেহমানদারীতে সময় করে উঠতে পারতেন না।

আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর আনাগোনা তাদের খাওয়ানোর দায়িত্ব শেষ করে নিজেদের দিকে নজর দিতেন। রোজা শেষে ঈদের দিনে সবার চেহারায় আলাদা একটা দীপ্তি ছড়াতো। এখন মানুষের এই বৈচিত্র্যময় ঈদ, অনেক অনেক পাওয়ার ভীড়ে সেই দীপ্তির ছটা যেন আর দেখা যায় না! তৃপ্তিহীন, একাকীত্বের বেড়াজালে যেন আটকে আছে। আগের মতো মেহমানের আনাগোনা নেই। নিজেদের ঈদ নিজেরাই করি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই এখন ঈদ উদযাপনের বড় অনুষঙ্গ। আমরা সবাইকে জানান দেই এই মাধ্যমে। কি পরলাম, কি খেলাম কোথায় গেলাম!

সময় আসলে আমাদেরকে বদলে দিয়েছে সেই দরিদ্র কৃষিভিত্তিক কাঠামোতে দাঁড়িয়ে থাকা সমাজ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। আমাদের খাওয়াদাওয়া, পোশাকআশাকে রুচিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।

মুঘল ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তান আমলের সঙ্গে বর্তমান ঈদের পার্থক্য সম্পর্কে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ঈদের মূল বিষয়টি একই আছে ধাপে ধাপে এর জৌলুশ বেড়েছে। তখন ঈদের ব্যাপকতা ছিল না। পাকিস্তান আমলে তা একটা অবয়ব পায়। ঈদকে ঘিরে এখন একটি অর্থনীতি তৈরি হয়েছে, ফ্যাশন তৈরি হয়েছে। মিডিয়াগুলো বেশ কিছুদিন ধরে ঈদের অনুষ্ঠান প্রচার করে। এমনকি ঈদ এখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গেও যুক্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশে ঈদ কেবলই ধর্মীয় উৎসব নয়। এটা এখন সার্বজনীন সামাজিক উৎসব। রমজান মাসে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সংযম সাধনা করে। এই সংযমের মূল সুর হলো কথা, কর্মে ও চিন্তাকে অন্যের কল্যাণে নিবেদিত করার। অনুশীলন ও আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন করা।

ঈদের আহ্বান সমস্ত মানব জাতির প্রতি। বাংলাদেশ একটি অসামপ্রদায়িক রাষ্ট্র। এই ভূখন্ডের মানুষ সবসময় সব ধর্ম বর্ণের এক এবং অভিন্ন বন্ধনে বেঁধে রাখতে অভ্যস্ত। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে যদিও মাঝে মাঝে এর ব্যতিক্রমী ঘটনাও ঘটে যা অত্যন্ত লজ্জাজনক ও দুঃখজনক। উৎসবের মূলে থাকে ভেদ পেরিয়ে যাওয়ার একটা সংকল্প। ঈদ চলে গেছে, ঈদের মহিমা যেন আমরা যেন লালন করতে পারি। কুপ্রবৃত্তি দূর হোক, মানুষের সুমতি হোক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারীমুক্তির নতুন দুয়ার
পরবর্তী নিবন্ধহালিশহরে গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার