সময়ের চাকা ঘুরে মুমিনের জীবনে সমবেত হলো রবিউল আউয়াল মাস। এমাসের ১২ তারিখ সুবহি সাদিকের সময় হলো মহাকালের মহেন্দ্রক্ষণ। এদিনে পৃথিবীর জমিনে শুভ আগমন হয়েছিল আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম নেয়ামত, মানবতার মুক্তির দিশারী এবং সকল সৃষ্টির মূল প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের। তিনি উম্মতের কাণ্ডারী, পরম হিতৈষী, অবারিত রহমতের অধিকারী ও রাহমাতুললীল আলামিন। হাফেজ আবু বকর ইবনে আবী শায়বাহ্ (ওফাত ২৩৫ হিজরী) সহীহ সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন, হযরত জাবের ও হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বীয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শুভাগমন হয়েছিল ঐতিহাসিক ‘হস্তি বাহিনী বর্ষে’ ( যে বছর আবরাহা তার হস্তিবাহিনী নিয়ে কাবা শরীফ ধ্বংস করতে এসে নিজেই ধ্বংস হয়েছিল) ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার দিন। (আল বেদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড–২,পৃষ্ঠা–১৮৯)। সিরাতে ইবনে ইসহাক গ্রন্থেও এই অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।
প্রিয় নবীজির শুভাগমনের মুহূর্তে সমগ্র সৃষ্টিজগত আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিল। মানবজাতির জন্য দিনটি ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিসেবে স্বীকৃত। ঈদ হলো খুশি, মুসলমানদের আনন্দের দিন, খুশির কোন অনুষ্ঠান ইত্যাদি। আমাদের জন্য ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার ন্যায় আরো ঈদ রয়েছে। যেমন, সাপ্তাহিক জুমার দিন ও আরাফাতের দিনকে হাদীসের ভাষায় ঈদের দিন বলা হয়। হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আঃ) আসমান থেকে খাবার নাজিলকে ঈদের দিন বলেছেন। আবার লাইলাতুল কদর ও লাইলাতুল বরাতকে ফেরেশতাদের জন্য ঈদের রাত বলা হয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন, আপনি বলে দিন! আল্লাহর অনুগ্রহ (ফদল) ও রহমতের উপর খুশি পালন কর। এটিই উত্তম সে সমুদয় থেকে যা তারা সঞ্চয় করেছে। (সূরা ইউনুস, আয়াত–৫৮)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, উক্ত আয়াতে ‘ফদল’ অর্থ হলো ইলম, আর ‘রহমত’ দ্বারা হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বুঝানো হয়েছে।
প্রিয় নবীজির শুভাগমনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে আল্লাহ তাআলার নির্দেশে অসংখ্য ফেরেশতা জুলুস সহকারে হযরত আমেনা খাতুনে জান্নাতের ঘরে নূরানী পতাকা সহ হাজির হয়েছিলেন। ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ুতি (রহঃ) বর্ণনা করেন, প্রিয় নবীজির শুভাগমনের মুহূর্তে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের বলেছেন, আসমানি রহমতের দরজাগুলো খুলে দাও এবং জান্নাতের দ্বারগুলো উম্মুক্ত করে দাও। হযরত উসমান ইবনে আবিল আস (রাঃ) স্বীয় মাতা ফাতিমা বিনতে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন যে, প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুভাগমনের মুহূর্তে আমি দেখলাম বায়তুল্লাহ শরীফ নূরের জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় হয়ে উঠেছে। তারকারাজি যমীনের এতো নিকটবর্তী হয়ে পড়ে যে, আমার মনে হলো হয়তো আমার উপর এসে পড়বে (বায়হাকী)। অপর এক বর্ণনা রয়েছে, সেই সময়ে পবিত্র কাবা ঘর আনন্দে নেচে উঠেছিল। প্রিয় নবীজির সম্মানার্থে ওই বছর আরবের সকল মহিলার গর্ভে পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করেছিল। ইতোপূর্বে আরবরা দুর্ভিক্ষ ও দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকলেও নবীজির আগমনের বছর তারা আর্থিক সচ্ছলতা, ফসলের প্রবৃদ্ধি উপভোগ করেছিল। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত ইরবায বিন সারিয়াহ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আমি আল্লাহর নিকট তাঁর লওহে মাহফুযে তখনও সর্বশেষ নবী হিসেবে লিখিত ছিলাম, যখন আদম কাদা অবস্থায় পড়ে ছিলেন। আর এর তাৎপর্য এই যে, (আমার নবুয়তের প্রথম বিকাশ ঘটে) আমার পিতা ইবরাহীমের দোয়া, ঈসা‘র তাঁর কাওম বা জাতিকে দেওয়া সুসংবাদ এবং আমার আম্মার দেখা সেই স্বপ্নের মাধ্যমে, যাতে তিনি তাঁর নিকট থেকে এমন জ্যোতি বের হতে দেখেন যা, শাম দেশের (সিরিয়ার) অট্টালিকাসমূহকে আলোকিত করেছিল। আর অনুরূপই আম্বিয়া (সালাওয়াতুল্লাহি আলাইহিম) এর আম্মাগণ দেখে থাকেন। (মেশকাত, হাদীস–৫৭৫৯)
আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য দিয়েছেন অসংখ্য নিয়ামত। প্রিয় নবীজি হলেন সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত। তার শুভাগমনে সমগ্র পৃথিবী আলোকিত হয়েছে। কুসংস্কারের করালগ্রাস থেকে পৃথিবীর মানুষ মুক্তির ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। কুফর ও শিরকের অমানিশার অন্ধকার থেকে মুক্তি পেয়েছে। মানবজাতি ফিরে পেয়েছে তার হারানো গৌরব। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কত সুন্দর করে বলেছেন, ‘ত্রিভূবনের প্রিয় মোহাম্মদ, এলো রে দুনিয়ায়/ আয়রে সাগর আকাশ বাতাস, দেখবি যদি আয়’। সত্যিই তিনি সৃষ্টির সকলের প্রিয়। অসাধারণ তাঁর মহানুভবতা।
আল্লাহ তাআলার নেয়ামত অসংখ্য এবং বর্ণনাতীত। তিনি বলেন, এবং যদি আল্লাহর অনুগ্রহ সমূহ গণনা করো, তবে সেগুলোর সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাপরায়ণ, দয়ালু। (সূরা আন নাহাল, আয়াত– ১৮) কিন্তু সকল নেয়ামতের শ্রেষ্ঠ নেয়ামত হলো প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র সত্তা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি আপনাকে জগৎসমূহের রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি’। (সুরা আম্বিয়া–১০৭)।
তিনি কোনো কাফির মুশরিকদের উপর অভিশাপ দেননি। তিনি বলেছিলেন, আমি অভিশাপকারীরূপে প্রেরিত হইনি, আমি কেবল করুণারূপে প্রেরিত হয়েছি। (সহীহ মুসলিম, হাদীস– ২০০৬)। গাছপালা তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতো, এমনকি অবুঝ প্রাণীরাও প্রিয় নবীজির কাছে অভিযোগ পেশ করতেন। তিনি তাদের প্রতি কোমল মাখা হাত বুলিয়ে দিতেন। আল্লাহ তাআলা চান বান্দা যেন তার নিয়ামতকে স্মরণ করে এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আল্লাহর বান্দা যখন তার নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তখন আল্লাহ তাআলা তাকে নিয়ামত আরো বাড়িয়ে দেন, তার প্রতি রহমতের দৃষ্টি প্রদান করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহর সে অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর যা তোমাদের উপর রয়েছে। (সূরা বাকারা, আয়াত–২৩১)।
নিঃসন্দেহে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করার মাধ্যমে আল্লাহর সুমহান নিয়ামতের কথাই স্মরণ করা হয়। বিশ্ব বিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা ইসমাইল হাক্কি (রহঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের জন্মদিন উদযাপন তাঁর প্রতি সম্মানেরই অংশ, যদি তাতে গর্হিত কোনো কাজ না থাকে।
ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি (রহঃ) বলেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম উপলক্ষে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের জন্য মুস্তাহাব বা উত্তম আমল। আল্লামা ইবনুল জাওজি (রহঃ) বলেন, ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা হলো সেই বছরের জন্য নিরাপত্তা এবং মহান প্রতিপালকের কাছে কাম্য ও আকাঙ্ক্ষিত বিষয় চাওয়ার সুযোগ। তিনি আরো বলেন মক্কা শরীফ, মদিনা শরীফ, মিশর, ইয়ামেন, শাম এবং পূর্ব পশ্চিমের সকল আরব দেশের বাসিন্দারা সর্বদা মিলাদুন্নবীর মাহফিল উদযাপন করে আসছেন। (আল্লামা ইবনে জাওজী, মিলাদুন্নবী, পৃ–৫৮)।
সুতরাং ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপলক্ষে প্রিয় নবীজির জীবনী আলোচনা করা, কোরআন তেলাওয়াত করা, নাতে রাসুল পরিবেশন করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, নেক আমল বা সাওয়াবের কাজ করা, তাবারুকাতের ব্যবস্থা করা, অসহায় দরিদ্রদের সাহায্য করা, শোভাযাত্রা বের করা, আলোকসজ্জা করা অতীব পূর্ণময় কাজ। এই সমস্ত কাজগুলোর মাধ্যমে প্রিয় নবীজির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় প্রকাশ পায়। নবীজির সুন্নাত পালনের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা অর্জনের জন্য প্রথমে প্রয়োজন প্রিয় নবীজির অনুসরণ ও অনুকরণ। ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের মাধ্যমে প্রিয় নবীজির অনুসরণ ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পথই উন্মুক্ত হয়।
লেখক: শিক্ষক, খতিব ও প্রাবন্ধিক।