আমাদের কাছে সেই অনাড়ম্বরপূর্ণ ঈদই ছিলো সত্যিকারের আনন্দ উৎসব। আমাদের জীবনযাত্রাও ছিল সহজ সাধারণ। সারা বছর জুড়ে দুটো ঈদ একটা পূজা এতেই আমাদের আনন্দ, এতেই আমাদের উৎসব। উদযাপনের কোনো কমতি ছিলো না। সবটাই ছিল সার্বজনীন উৎসব। মানুষ মিলেমিশে এসব আনন্দযাপন করতো। আন্তরিক একটা পরিবেশ বিরাজমান ছিলো সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। তখনকার ব্যবসায়ীরাও এত ঠগ, এতো জোচ্চর ছিলো না। বাজারের পরিধিও কম ছিলো। নীতি নৈতিকতার ব্যাপারটা কিছুটা হলেও মানুষ পরোয়া করতো। খাদ্য নিরাপত্তা ছিলো। যতই দিন যাচ্ছে কেবলই শুভ বোধগুলো উধাও হয়ে যাচ্ছে মানুষের। ইসলাম শান্তির ধর্ম, সত্যের ধর্ম, সমতার ধর্ম। অথচ রমজান আসলে মানুষকে খাদ্য সংকটে ফেলার যত আয়োজন সবই করে আমাদের ব্যবসায়ীরা। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে ওদের সিন্ডিকেটের গুরুরা। সরকারও কিছুই করতে পারে না। খাদ্যে এমন সব মিশানো হয় যা মানব শরীরে সাংঘাতিক ক্ষতিকর। আমরা এসব ফল মূল খেয়ে চলেছি। বিনাদ্বিধায় অসৎ ব্যবসায়ীরা নিরন্তর এ–কাজগুলো করে যাচ্ছে। কিছুতেই যেন হিসেবে মিলে না একাল আর সেকালের। ঈদের আনন্দটা ছিল সার্বজনীন সামাজিক উৎসবের মতো। মানুষের আনন্দময় মিলনে, যোগে, একাত্মতায় নিজের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসাটাই ঈদের তাৎপর্য। সেটা আমরা মানছি কই? আমাদের চারপাশে সমাজে রাজনীতিতে, মানুষে–মানুষে যে বিভেদ, ভাঙন কখনো ধর্মেও দোহাই, কখনো ভিন্নমত, কখনো নারীর প্রতি সহিংসতা, অসম্মান, কখনো শ্রমিকের প্রতি বঞ্চনায় আমরা ঈদের মর্মার্থ হারিয়ে ফেলি! তবুও ঈদ আসে আমরা উদ্যাপন করি। কিন্তু যে ঈদের স্মৃতি আমরা আজও যা লালন করি তার যেন তুলনা হয়না! মায়ের মুখের মতো ভেসে আসে প্রজাপতিময় আমাদের শৈশব কৈশোরের ঈদ। আহা! সারা রমজান জুড়ে ঈদের আগমনী সুর ধোঁয়ামোছার সাথে, মহিলাদের তৎপরতার সাথে সাথে বেজে চলতো! ইফতারও ছিলো মা–ভাবীদের মায়ায় জড়ানো কত কি! বুট পেঁয়াজুর সঙ্গে থাকতো নানান পদের পিঠা। একটা পিঠার নাম ছিল মরিচ্চা পিঠা মচমচে করে ভাজা। বেশ সুস্বাদু। মনে আসে মাঝে মাঝে কিন্তু আর কখনো বানানোর চেষ্টা করিনি। তা থাকুক স্মৃতির পাতায়। দুধচিতই, চুটকি পিঠা আরও নানা রকমের পিঠা আয়োজনের যেন কমতি ছিলো না। সেহরিতে ছিলো সর্বশেষ দুধ ভাত। দুধের সাথে থাকতো গাবা ঘি। গরম ভাতে ঘি চিনি মেখে পরে দুধ দেওয়া হতো। এটাও আর কখনো খাওয়া হয়নি। ঈদের কাপড় নিয়ে সে কি উৎসাহ। গজ হিসেবে কাপড় নিয়ে আসা হতো। তারপর দর্জিকে খবর দেওয়া হতো। দর্জি বাড়ি এসে মাপজোখ নিয়ে যেতো। এরপর শুরু হতো আমাদের দৌড়াদৌড়ি। প্রতিদিন একবার জিজ্ঞেস করে আসতাম কখন দিবে? তারপর জুতার বক্স বিছানায় রেখে ঘুমানো, কাউকে ঈদের কাপড়চোপড় না দেখানো এ–সব ছিল আমাদের কমন ব্যাপার। ঈদের দিন সকালে উঠে ঈদগাহ গিয়ে ছোটাছুটি, ঈদের সালামী সংগ্রহ, সবাইকে (বড়দের) কদমবুচি করাও ছিল নিয়ম। দল বেঁধে এ–ঘর ও–ঘর। একটু বড় হওয়ার পর ঈদ সংখ্যা আরও পরে বিটিভির অনুষ্ঠান। এসব আর কিছুই নেই এখন! আমাদের মা চাচিরা এতটা ব্যস্ত থাকতেন রান্নাবান্নায়, মেহমানদারিতে বিকেলের আগে তারা অবসরই পেতেন না নতুন শাড়ি পরার। ঈদের দিনে সবার চেহারায় আলাদা একটা দীপ্তি ছড়াতো। অথচ এখন এই বৈচিত্র্যময় বাহুল্যময় ঝকঝকে ঈদে ও মানুষের চেহারায় এক ধরনের তৃপ্তিহীন, এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করে। কেমন একটা একাকীত্ব ছুঁয়ে থাকে। এখন আর সেই মেহমান কোথায়! মানুষ যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।
এখন আমরা নিজেদের ঈদ নিজেরাই করি, নিজের জন্য কিনি, নিজেরাই খাই আর মানুষকে জানান দেই কতটা ভালো খেলাম আর কতটা ভালো পরলাম! অথচ সে সময় ছিল কে কত মানুষ খাওয়াতে পেরেছে, কত “ডেক” গেছে! মধ্যেবিত্ত পরিবারে এটাই ছিল সন্তুষ্টির ও আনন্দের! সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে আমরা নিজেরাই কখন বদলে গেছি! ঈদুল ফিতর কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয় এটা সার্বজনীন সামাজিক উৎসব। রমজান মাসে মুসলিমদের সংযম সাধনা করা ফরজ। এই সংযমের মূল সুর হলো কথা–কর্ম ও চিন্তাকে অন্যের কল্যাণে নিবেদিত করার অনুশীলন। আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন করা। ঈদের আনন্দের আহবান কেবল মুসলমানদের জন্য নয় এর আহ্বান মানবতার প্রতি। ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সব সমপ্রদায়ের মধ্যে। মানুষে মানুষে সমতার বিশ্বাসই হচ্ছে ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য! ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম, সত্যের ধর্ম কথাটা সবাই মানেন কিন্তু ধর্মের তাৎপর্যময় অর্থ কেউ বুঝতে চায় না। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।