ঈদুল আজহা ইসলামের দ্বিতীয় বড় উৎসব। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত এই উৎসবের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো তাকওয়া তথা আল্লাহভীতির চর্চা। লোকদেখানো বা ব্যক্তিগত অহমিকা প্রদর্শন নয় আল্লাহর ভয় হৃদয়ে ধারণ করে প্রিয়তম বস্তুটি আল্লাহর পথে বিসর্জন দেওয়াই কোরবানি। আল্লাহ তাআলার নির্দেশিত পন্থায় যথাযথভাবে কোরবানি দেওয়াই তাকওয়ার প্রমাণ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে–কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলিকে সম্মান করলে তা তো তার হৃদয়ের তাকওয়া–সঞ্জাত। (সুরা হজ : ৩২) ইসলামের যেসব আমলে হৃদয়ে সবচেয়ে বেশি তাকওয়ার চাষ হয় তার মধ্যে ঈদুল আজহা উল্লেখযোগ্য। এ ক্ষেত্রে কোরবানি শব্দটিও বহুল প্রচলিত। ঈদুল আজহাকে কোরবানির ঈদ বলা হয়। কোরবান মানে নৈকট্য। যে বস্তু কারও নৈকট্যলাভের উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয় তা–ই কোরবানি। তবে পরিভাষায় জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখে পশু জবাইয়ের মাধ্যমে যে আচার পালন করা হয় তা–ই কোরবানি। কোরবানির মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর কাছাকাছি আসে প্রিয় থেকে প্রিয়তর হয়। এতে মানুষের নৈতিক জীবন সবচেয়ে বেশি উৎকৃষ্ট হয়।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুসলিম জাতির জন্য সৌভাগ্যের পুরস্কার স্বরূপ বছরে দুটি ঈদ দিয়েছেন তার একটি ঈদুল ফিতর আরেকটি হলো ঈদুল আজহা। আজ ঈদুল আজহা সম্পর্কে আলোচনা করব। বছর ঘুরে আমাদের মাঝে আবারো ফিরে এসেছে পবিত্র ঈদুল আযহা। ঈদুল আযহা মুসলমানদের অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। সারা বিশ্বে মুসলমানরা হিজরী বর্ষের দ্বাদশ মাস জিলহজ্বের ১০ তারিখে ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ উদযাপন করে। আরবের অনেক দেশে একে বড় ঈদ বা ঈদুল কুবরাও বলা হয়ে থাকে। অন্যান্য দেশেও এর নিজস্ব ভিন্ন নামও রয়েছে তবে এর অর্থ ও তাৎপর্য অভিন্ন। মহান আল্লাহতায়ালার আদেশে হযরত ইবরাহীম (আ.) এর নিজ পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.) কে আল্লাহর জন্য কুরবানী করার ইচ্ছা ও ত্যাগের কারণে সারা বিশ্বের মুসলমানেরা আল্লাহর কাছে নিজেদের সোপর্দ করে দেয়ার লক্ষ্যে পবিত্র হজ্বের পরের দিন ঈদুল আযহা উদযাপন ও পশু কুরবানী করে থাকে। আল্লাহতায়ালা হযরত ইবরাহীম (আ.) এর আনুগত্যে সন্তুষ্ট হন এবং পুত্রের পরিবর্তে তাকে পশু কুরবানী করার নির্দেশ দেন। ইবরাহীম (আ.) এর সে সুন্নাত অনুসরণে ঈদুল আযহার সময় মুসলমানরা পশু কুরবানী করেন।
পবিত্র কোরবানি হলো মুসলিমদের একটি ইবাদত যা প্রতি বছর বিত্তবানদের ওপর আরোপিত হয় নির্দিষ্ট সময়ে। এই ইবাদাতের মাধ্যমে মুসলিমরা মহান আল্লাহতাআলার নৈকট্য লাভ করে থাকেন। আল্লাহর রাহে যথাসর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার এক আহ্বান নিয়ে প্রতি বছর আমাদের মাঝে হাজির হয় পবিত্র ঈদুল আযহা। মানব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে কুরবানির রেওয়াজ চলে আসছে। হযরত আদম (আ.) এর দুসন্তান হাবিল ও কাবিল কুরবানি করেছিলেন। হাবিল ঐকান্তিক আগ্রহ ও নিষ্ঠার সাথে উৎকৃষ্ট জিনিস কুরবানি করলে তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়। পক্ষান্তরে কাবিল অনাগ্রহ ও নিকৃষ্ট জিনিস উৎসর্গ করলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। কোরবানি মানব সমাজে সবসময়ই কোনো না কোনোভাবে চালু ছিল। আমাদের প্রতিবেশী হিন্দু সমাজেও বলিদান প্রথা চালু আছে। বর্তমান মুসলিম সমাজে চালুকৃত কুরবানি মূলত হযরত ইবরাহীম (আ.) ও তাঁর পরিবারের চরম আত্মত্যাগের স্মরণ হিসেবেই চলে আসছে। কাল পরিক্রমায় প্রতিবছর পবিত্র হজের পরে ঈদুল আজহা ফিরে আসে যার প্রধান আকর্ষণ ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত কোরবানি।
ঈদের দিন কোরবানিকে কেন্দ্র করে ধুমধামের সঙ্গে চলে মনের পশুপ্রবৃত্তি ত্যাগের মহোৎসব। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কোনো আমল আল্লাহর কাছে নেই। কোরবানিকারী কিয়ামতের দিন জবেহকৃত পশুর লোম, শিং, ক্ষুর, পশম ইত্যাদি নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। কোরবানির রক্ত জমিনে পতিত হওয়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা কোরবানির সঙ্গে নিঃসংকোচ ও প্রফুল্লমন হও। কোরবানির গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের এক ভাগ আত্মীয়স্বজনদের ও এক ভাগ গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া মুস্তাহাব। কোরবানির চামড়া বা তার নগদ অর্থ এতিমখানা বা গরিব–মিসকিনদের দান করতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত দীন–দুঃখীরাও যাতে ঈদের আনন্দ করতে পারে সে লক্ষ্যে কেবল ভোগ নয় ত্যাগ তিতিক্ষার মনোভাব নিয়ে তাদের মধ্যে কোরবানির গোশত অকাতরে বিলিয়ে দিতে হবে এবং দান–সাদকা করতে হবে। হালাল উপার্জন, তাকওয়া ও একনিষ্ঠতাই হলো কোরবানি কবুল হওয়ার অপরিহার্য শর্ত।
হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে মহানবী (সা.) বলেন অতএব তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি করে তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবির (আল্লাহু আকবার) এবং তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) পড়বে। মুসলমানদের শুধু কোরবানির প্রতীক হিসেবে পশু জবাইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বিশ্ব মানবতার শান্তি ও কল্যাণের জন্য সবাইকে উৎসর্গিত ও নিবেদিত প্রাণ হতে হবে। মানুষের অন্তর থেকে পাশবিক শক্তি ও চিন্তা চেতনাকে কোরবানি করে দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে কোরবানি জীব জানোয়ার বা পশু হনন করতে আসে না বরং কোরবানির মাধ্যমে পশু প্রবৃত্তিকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার এটি যে একটি উত্তম ব্যবস্থা তা স্মরণ করিয়ে দিতে ঈদুল আজহা প্রতিবছর ফিরে আসে। তাই আজকের দিনে আমাদের প্রার্থনা আমরা যেন যথাযথ নিয়ম মেনে আল্লাহর রাহে কুরবানি দিতে পারি। আর আমাদের অর্থ হতে হবে হালাল এবং আমাদের নিয়ত হতে হবে কেবলমাত্র আল্লাহকে রাজী ও খুশি করা। ঈদে আমরা আত্মীয়স্বজন, গরীব মিসকিন, এতিম ও অসহায় মানুষকে সার্বিকভাবে সহায়তা করা। মানুষের কল্যাণে আমাদের কাজ করতে হবে। আসুন আমরা কুরবানীর ঐতিহাসিক এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমি ও আমাদের পরিবারকে এক আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করার মানসিকতা তৈরী করি। প্রিয় নবী (সা.)-বলেছেন আল্লাহতাআলা তোমাদের স্বাস্থ্য চেহারা এবং ধনসম্পদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না বরং তিনি দৃষ্টি দেন তোমাদের অন্তর এবং আমলের প্রতি। সুতরাং কোরবানির পূর্বেই কোরবানি দাতার নিয়ত বা সংকল্প শুদ্ধ করে নিতে হবে। অতএব লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বড় বড় গরু ক্রয় করে প্রদর্শন করা বাহাদুরী জাহির করা অথবা গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি হবে না বরং হালাল উপার্জন ইখলাছ ও একনিষ্ঠতাই হলো কোরবানি কবুল হওয়ার আবশ্যকীয় শর্ত কে কত টাকা দিয়ে পশু ক্রয় করলো কার পশুটি কত মোটাতাজা বা সুন্দর আল্লাহ তা দেখেন না। তিনি দেখেন সহীহ নিয়ত ও তাকওয়া।
ঈদুল আজহা মুসলমানদের দ্বিতীয় বড় ধর্মীয় উৎসব। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত এ উৎসবে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে পশু কুরবানি করেন। সমাজের সব স্তরের মানুষের মাঝে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়া তাকওয়ার দাবি। এটিই ঈদুল আজহার মূল প্রাণ। এ জন্য কোরবানির এত বেশি সওয়াব। হজরত আয়েশা (রা.)-বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-ইরশাদ করেছেন কোরবানির দিন বনি আদমের কাজসমূহের মধ্যে আল্লাহর নামে কোরবানি করার চেয়ে প্রিয় কাজ আর নেই। কিয়ামতের দিন কোরবানির পশু শিং, চুল খুরসহ উপস্থিত হবে। আর কোরবানির পশুর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়। কাজেই তোমরা সন্তুষ্ট চিত্তে কোরবানি করো। আল্লাহ আমাদের সকলের কোরবানি কবুল করে নিন আমীন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট