মাদক সমস্যা তথা মাদক দ্রব্যের অবাধ ব্যবহার ও অবৈধ পাচার একটি জটিল, বহুমাত্রিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যা। মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও চোরাচালান সমস্যা দেশ–কাল, ধর্ম–বর্ণ, সমাজ নির্বিশেষে আজ সারা বিশ্বকে গ্রাস করছে। ধনী–দরিদ্র, উন্নত–উন্নয়নশীল কোন দেশই মাদক সন্ত্রাস থেকে মুক্ত নয়। মাদককে ঘিরে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, সংঘাত–দ্বন্দ্ব, কলহ, দুর্ঘটনা, ধ্বংস ও মৃত্যুর যে খেলা চলছে তাকে নিবারণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। মাদকাসক্তি আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গন যথা– স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–ছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে।
গত ৯ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীতে ‘৪৫ রুটে ঢুকে ইয়াবা, টেকনাফে সর্বনিম্ন দাম, ঢাকায় সর্বোচ্চ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে টার্গেট করে কক্সবাজারের উখিয়া–টেকনাফ এবং বান্দরবানের সীমান্ত কেন্দ্রিক ইয়াবা কারখানা গড়ে তুলেছে মিয়ানমার। ২০০৫ সালের দিকে ইয়াবা পাচারের সূচনা হয়। ২০০৬ সালে প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ইয়াবার চালান ধরা পড়ে। সেই থেকে ক্রমান্বয়ে ইয়াবার প্রকোপ বেড়ে চলেছে। মিয়ানমারও ইয়াবার কারখানা বাড়িয়েছে বহু গুণ। বর্তমানে দেড় শতাধিক ইয়াবা তৈরির কারখানা গড়েছে মিয়ানমার। উৎপাদিত ইয়াবার ৯০ শতাংশই পাচার করছে বাংলাদেশে। বর্তমানে বাংলাদেশে ইয়াবার ভয়ংকর আগ্রাসন চলছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে মাদকের জগতে ইয়াবা প্রধান ব্যবহৃত মাদক। এর নেটওয়ার্ট এখন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। শহর থেকে পাড়া গাঁ সবখানে ভয়াল থাবা বসিয়েছে ইয়াবা। বড় লোকের ছেলে থেকে ভিক্ষুকের ছেলে পর্যন্ত এখন ইয়াবায় আক্রান্ত। পরিসংখ্যান মতে, পাচার, বিক্রি এবং বহন সহজলভ্য হওয়ায় এবং দাম কমে যাওয়ায় ইয়াবার আগ্রাসন দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, দেশের পাচারচক্রের মধ্যে রয়েছে কয়েক স্তরের লোক। এর মধ্যে গডফাদার থাকে মুখ্য ভূমিকায়। তাদের আশ্রয়ে পাচারের মুখ্য পাচারকারী, মধ্যম পাচারকারী এবং বাহক পাচারকারী থাকে। মুখ্য পাচারকারীর সাথে মিয়ানমারের থেকে পাচারকারীর যোগাযোগ রয়েছে। এদেশের মুখ্য পাচারকারী ইয়াবা চালানের সাথে সরাসরি জড়িত থাকে না। মধ্যম পাচারকারীর মাধ্যমে বড় বড় চালান দেশে ঢুকে এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ করে। এরপর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাচারে ব্যবহৃত হয় বাহক। তারা চালান প্রতি নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে এ কাজ করে। এই তালিকায় বেশিরভাগ রয়েছে জেলে। এছাড়া বেকার যুবক, নারী, কাঠুরিয়া, কৃষক, ফেরিওয়ালা, বিভিন্ন গাড়ির চালক–হেলপার, শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লোকজনও রয়েছে।
আইনজীবীসহ অনেকের অভিযোগ, পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জানেন, মাদক ব্যবসা কাদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু তাদের ধরা হয় না। ধরা পড়ে চুনোপুঁটি, যারা পরিবহন বা সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করে। এছাড়া আদালতে বিচারের মাধ্যমে অপরাধী প্রমাণিত না হলে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদক যেভাবে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, তাতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো এর কারণ খুঁজে বের করে তা দূর করার ব্যবস্থা নেওয়া। সচেতন মানুষ আশা করছে, এখন যেহেতু নতুন আইন হয়েছে, মাদকের ভয়াবহ বিস্তার রোধে এই আইন কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আইন–শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্বে শিথিলতায় অসাধু মাদক কারবারীদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে মাদক দেশে ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেছে। স্কুল–কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি নগর–শহরের অলিগলিতে হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক। শহরের বাইরে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও মাদক এখন সহজলভ্য। পাশাপাশি তরুণদের অনেকেই অনলাইনেও রমরমা মাদকের ব্যবসা চালাচ্ছে। অতীতে মাদক সেবনের সঙ্গে শুধু ছাত্ররা জড়িত থাকলেও বর্তমানে ছাত্রীরাও মাদক সেবন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানো হলেও বিভিন্ন কৌশলে মাদক কারবারীরা দেশে মাদকের চালান স্থানান্তর করছে। অ্যাম্বুল্যান্স, সবজিসহ নিত্যপণ্যের গাড়িতে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ নানা মাদক তারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতেও মাদকের বিপুল প্রভাব পরিলক্ষিত। অবৈধ মাদক আমদানির জন্য দেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। ২০২৩ সালের জুনে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আংকটাড) এর প্রতিবেদনে উপস্থাপিত হয় যে, শুধু মাদকের কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৫ হাজার ৮৪১ কোটি টাকারও বেশি অর্থ পাচার হয়ে যায়। তাই মাদক ব্যবসায়ী, মাদক বহনকারী ও মাদকসেবী–সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে।