ইয়াবা এখন নানা জায়গায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কেননা মাদকের নীল দংশন পুরো দেশকে গ্রাস করে ফেলছে। এ সব মাদকের মধ্যে বর্তমানে ইয়াবার চালান একেবারে অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে। লাখে লাখে পাচার হচ্ছে এ ট্যাবলেট। কখনো বাসের চাকায়, কখনো বাইকের তেলের ট্যাংকে, কখনো বা সিএনজি টেক্সির সিলিন্ডারে করে যে যেভাবে পারছে সেভাবে পাচার করছে ইয়াবা। র্যাব–পুলিশের অভিযানে ধরাও পড়ছে পাচারকারীরা। তবুও যেন থামানো যাচ্ছে না ইয়াবা পাচারকারীদের।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদীতে ‘বছরে সাড়ে ৩শ কোটি টাকার ইয়াবা ঢুকছে ২২ রুটে’ শীর্ষক প্রকাশিত হয়েছে একটি সংবাদ। এতে বলা হয়েছে, মাদক পরিবহনে প্রশাসনের নজর এড়াতে নিত্য নতুন কৌশল আর রুট পরিবর্তনকে বলা হয় এ ব্যবসার প্রধান মূলধন। মিয়ানমারের ৪৫টি ইয়াবা কারখানায় তৈরি ইয়াবার চালানে প্রায় প্রতিদিনই লাখ লাখ ইয়াবা প্রবেশ করছে চট্টগ্রাম হয়ে সারা দেশে। মিয়ানমার থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৩০ কোটি টাকার ইয়াবার চালান আসছে। এই হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর সাড়ে ৩শ কোটি টাকার ইয়াবার চালান আসছে। বাংলাদেশের বাজারকে টার্গেট করে মিয়ানমারের এ ইয়াবা কারখানাগুলোতে তৈরি হচ্ছে ১৩ ধরনের ইয়াবা। প্রতিমাসে এসব ইয়াবা ঢুকছে ২২টি রুট দিয়ে। দেশের কারাগারগুলোতে মোট আসামির ৭০ ভাগই মাদক মামলার। এদের বেশিরভাগই শুধু বাহক। মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে মাদক আমদানি করেই চলেছে। ইয়াবার উৎপত্তিস্থল মিয়ানমার থেকে নৌপথে প্রবেশ করতো ইয়াবা। এরপর চোরাচালানে নতুন সংযোজন হয় স্থলপথ ও পাহাড়। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলোর গহীন অরণ্য হয়ে উঠে ইয়াবা পাচারের অভয়ারণ্য। মিয়ানমার থেকে স্থল পথে মোরং পাহাড় হয়ে বান্দরবানের আলীকদম–থানচিসহ আশপাশের ৬টি পাহাড় মাদক চোরাচালানের নতুন পথ হয়ে উঠে। পাহাড়ের দুর্গম পথ ধরে এসব ইয়াবা চলে যাচ্ছে চট্টগ্রাম–ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় ইয়াবা পাচারে ব্যয়বহুল বেসরকারি হেলিকপ্টারের ব্যবহার। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান দেশে আনতে ও দেশের ভেতর বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিতে নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করছেন কারবারিরা। এই কৌশলের অংশ হিসেবে শুধু নতুন রুটই না, নতুন নতুন মুখও ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সারা দেশে ইয়াবার খুচরা বিক্রেতা বা বাহক পর্যায়ে অহরহ অনেকে ধরা পড়লেও সীমান্ত গলিয়ে আসা ‘মূল স্রোত’ বন্ধের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তাঁরা বলেন, কোনো জিনিস সহজলভ্য হলে তার বিস্তার ঘটে দ্রুত। ইয়াবার ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। ইয়াবার সহজলভ্যতা রোধে আইনরক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। অথচ অভিযোগ রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক কেনাবেচা ও পাচারে সহায়তা করে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়াও মাদক পাচারের সঙ্গে প্রভাবশালীদের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। মাদক ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবানদের বিন্দুমাত্র ছাড় না দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থানের কথা সর্বজনবিদিত। তবে তা কতটা কার্যকর হচ্ছে, এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ ইয়াবা সমস্যাকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ইয়াবাসহ অন্যান্য অবৈধ ও ক্ষতিকর মাদক দ্রব্যের পাচার ও ব্যবহার বন্ধে সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করলেও এ সমস্যা সমাধানের নৈতিক ও দার্শনিক অবস্থান সঠিক নয় বলে তাঁরা মনে করেন। তাঁদের মতামত হলো, ‘বিষয়টিকে এখন পর্যন্ত শুধু আইন–শৃঙ্খলা বা চোরাচালানগত সমস্যা বলে মনে করা হয়। এক শ্রেণির নীতিনির্ধারক মনে করেন, সীমান্তরক্ষী ও আইন–শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী বাহিনীর ব্যর্থতা, পেশাগত দুর্বলতা, অদক্ষতা ও অসততার জন্যই ইয়াবার এতটা প্রসার ঘটছে। তাই প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা হিসেবে তারা আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা উন্নয়ন কিংবা অসততা দূরীকরণের কিছু পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষপাতি। যেমন, সীমান্ত এলাকায় বিজিবির সংখ্যা বাড়ানো, পুলিশ ও বিজিবির কঙবাজার এলাকায় রদবদল ইত্যাদি হয়েছে। এতে যে সাময়িক সুবিধা পাওয়া যায়নি, তা নয়। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে অন্যান্য উপাদানগুলো অভিন্ন ও সমান সক্রিয় থাকলে শীঘ্রই অবস্থা আগের মতো হবে। অধিকন্তু দেশের অভ্যন্তরে ইয়াবার চাহিদা তথা ব্যবহার অভিন্ন থাকলে ইয়াবা ভিন্ন পথে দেশে ঢুকবে। ভিন্ন দেশ দিয়ে ঢুকবে এবং ভিন্ন নাম দিয়ে ঢুকবে।’ তাঁরা বলেন, ইয়াবাসহ ক্ষতিকর মাদকের অপব্যবহার রোধ করতে হলে সমস্যাটিকে শুধু আইন–শৃঙ্খলাজনিত নয়, সামাজিক বলে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাই এর সমাধানও সামাজিক প্রক্রিয়ায় হতে হবে।
সামাজিকভাবে ইয়াবার পাচার প্রতিরোধ করা গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনি অনেকটা সহযোগিতা লাভ করতে পারে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি আওতায় আনতে হবে। মাদক ব্যবসায়ীরা যেমন পাচারের কৌশল পাল্টায়, তেমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচক্ষণ কর্মকর্তাদেরও কৌশলী হতে হবে।