ইস্তেগফার তথা আল্লাহতায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এটি মুমিন তথা মুত্তাকীদের জন্য এক বিশাল নেয়ামত। ইস্তেগফার–মুমিন বান্দাদেরকে আল্লাহতায়ালার খুব কাছাকাছি নিয়ে যায় তথা নৈকট্যলাভের জন্য অত্যন্ত সহায়ক শক্তি। ইস্তেগফার–তাওবার একটি অংশ মাত্র। তাওবার আভিধানিক অর্থ ফিরে আসা তথা প্রত্যাবর্তন করা। তাওবা একটি পূর্ণাঙ্গ প্রক্রিয়া, যেখানে একজন ব্যক্তি কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে এবং ভবিষ্যতে ভুল না করার প্রতিজ্ঞা করে। আল্লাহতায়ালা তাঁর কালামে পাকে বলেন, ‘হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, তোমরা (গুনাহখাতার জন্য) আল্লাহর দরবারে তাওবা কর–একান্ত খাঁটি তাওবা। আশা করা যায় তোমাদের রব তোমাদের গুণাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন এবং এর বিনিময়ে তিনি তোমাদের এমন এক জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে ঝর্ণাধারা’ –সূরা আত–তাহরিম–০৮। প্রত্যেক নবী–রসূলগণই ইস্তেগফার করেছেন আল্লাহতায়ালার কাছে। তাঁরা ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এজন্য নয় যে, তাঁরা গুণাহগার (নাউজুবিল্লাহ)। তাঁরা ইস্তেগফার করেছেন আল্লাহতায়ালার কাছে নিজেদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য এবং স্বীয় উম্মতকে ইস্তেগফারের শিক্ষা দেওয়ার জন্য। আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত বিধান মেনে চলা এবং তা পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্র জীবনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এতে এই নির্দেশ পালন করতে গিয়ে অনেক ভুল–ভ্রান্তি হতে পারে শয়তানের প্ররোচনায়। সেই ভুল–ভ্রান্তির জন্যে আল্লাহতায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার সুযোগ রয়েছে। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) দিনে ৭০ কিংবা ১০০ বার ইস্তেগফার করতেন। ইস্তেগফার এর তিনটি অংশ রয়েছে। প্রথমত: অতীত ভুল–ভ্রান্তির জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে লজ্জিত হওয়া ও অনুতপ্ত হওয়া। দ্বিতীয়ত: সেই ভুলভ্রান্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করে ফিরে আসা এবং আল্লাহতায়ালার কাছে ক্ষমা চাওয়া। তৃতীয়ত: ভবিষ্যতে যেন আর ভুলভ্রান্তি না হয় সেজন্য আল্লাহতায়ালার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া। বান্দা যতই ইস্তেগফার করেন ততই আল্লাহতায়ালা খুশি হন। হযরত আদম (আঃ) তাঁর ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এভাবে, ‘অতঃপর তারা দু’জনেই বলে উঠলো, হে আমাদের রব আমরা আমাদের নিজেদের উপর জুলুম করেছি, যদি তুমি আমাদের মাফ না কর এবং আমাদের উপর দয়া না কর তাহলে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাব’–সূরা আরাফ–২৩। ইস্তেগফার একজন মুমিনকে নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষ জীবন দান করে। মুমিনকে নিয়ে যায় ঈমান ও আমলের ক্ষেত্রে উন্নতি ও মর্যাদার সু–উচ্চ শিখরে। হযরত নূহ (আঃ) আল্লাহতায়ালার কাছে ইস্তেগফার করেছেন এভাবে, ‘হে আমার রব, তুমি আমাকে, আমার পিতা–মাতাকে এবং তোমার উপর ঈমান এনে যারা আমার ঘরে আশ্রয় নিয়েছে এমন সব ঈমানদার পুরুষ ও মহিলাদের ক্ষমা করে দাও, জালেমদের জন্য চূড়ান্ত ধ্বংস ছাড়া কিছুই তুমি বৃদ্ধি কর না’–সূরা নূহ–২৮। অনেক সময় ইস্তেগফার করলেও আল্লাহতায়ালা সেটা গ্রহণ করেন না। যেমন মুনাফেকদের জন্য নবী করিম (সাঃ) এর ইস্তেগফার আল্লাহতায়ালা গ্রহণ করেননি, ‘এদের জন্য তুমি ক্ষমা প্রার্থনা কর কিংবা না কর (দুটিই সমান), তুমি যদি ৭০ বারও আল্লাহতায়ালার কাছে তাদের জন্য ক্ষমা চাও আল্লাহতায়ালা কখনো তাদেরকে ক্ষমা করবেন না কেননা তারা আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূল (সাঃ)কে অস্বীকার করেছে, আল্লাহতায়ালা কখনো নাফরমান লোকদেরকে হেদায়াত করেন না’–সূরা আত তাওবা–৮০। অনেক সময় আল্লাহতায়ালা বান্দার নাফরমানির জন্য শাস্তির নির্দেশ থাকলেও পরবর্তীতে তা প্রত্যাহার করে নেন। যেমন: হযরত ইউনুস (আঃ) এর কওম কে আল্লাহতায়ালা নির্ধারিত শাস্তি থেকে রেহাই দেন। হযরত ইউনূস (আঃ) তাঁর কওম কে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন এবং তাদেরকে বহুভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু তারা তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিল না বরং তারা অবাধ্যতা ও সীমালংঘনে ডুবে থাকল। তখন থেকে আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি আসার প্রতিশ্রুতি শুনিয়ে দিলেন। হযরত ইউনুস (আঃ) যেহেতু বুঝতে পেরেছেন যে, তাদের উপর তো এখন শাস্তি আসা অবধারিত তাই তিনি নিজ এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলেন। তারা হযরত ইউনুস (আঃ)কে যখন খুঁজে পেল না–তখন তারা বুঝতে পারল যে, এখন তো আমাদের উপর শাস্তি এসেই যাবে তাই তারা তাওবা–ইস্তেগফার করতে লাগল। তাদের এই অবস্থা দেখে আল্লাহতায়ালা আর শাস্তি প্রেরণ করলেন না। এভাবেই তারা তাওবা–ইস্তেগফারের ফলে আল্লাহর শাস্তি থেকে বেঁচে গেল। আর সেটি আল্লাহতায়ালা তাঁর কোরআনে কোড করেছেন এভাবেই, ‘কেন কোন জনপদ ঈমান আনয়নকারী হল না? তাহলে তাদের ঈমান তাদের উপকারে আসত। তবে ইউনুসের সম্প্রদায় ব্যতিক্রম। তারা যখন ঈমান আনল তখন আমি পার্থিব জীবনে তাদের উপর থেকে লাঞ্চনার আযাব তুলে নিলাম এবং তাদেরকে একটা সময় পর্যন্ত জীবন উপভোগ করতে দিলাম’–সূরা ইউনুস–৯৮। আল্লাহতায়ালার ক্ষমা, দয়া এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সবদিক থেকে তাঁর সাহায্য লাভ করার জন্য তাওবা ও ইস্তেগফারের বিকল্প নেই। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি বেশি বেশি ইস্তেগফার করেন আল্লাহতায়ালা তার সকল সংকট থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা করে দেন, তার সকল পেরেশানি দূর করে দেন এবং তাকে এমন জায়গা থেকে রিজিক দান করেন যা সে কল্পনাও করতে পারে না– (সুনানে আবু দাউদ–১৫১৮)। তাওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে একজন মুমিনের জীবন সুন্দর ও সফল হয় এবং আল্লাহতায়ালার নিকটতম বান্দায় পরিণত হয়। জিন্দেগীর সগিরা ও কবিরা গুণাহসহ সব ধরনের অপরাধ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহতায়ালা কুরআনুল মজিদে মুত্তাকীদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘তারা সেই সকল লোক যারা কখনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা নিজেদের প্রতি জুলুম করলে আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করে এবং নিজেদের গুণাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে আর আল্লাহতায়ালা ছাড়া কেই বা আছে যে গুণাহ ক্ষমা করতে পারে। আর তারা জেনে শুনে তাদের কৃতকর্মে অবিচল থাকে না’–সূরা আল ইমরান–১৩৫। হযরত সালেহ (আঃ) কর্তৃক তাঁর উম্মতকে তাওবা ও ইস্তেগফারের শিক্ষা দিয়েছেন এভাবেই, আমি সামুদ জাতির কাছে সালেহকে প্রেরণ করেছি। তিনি বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায় তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন মাবুদ নেই, তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে তাতে বসবাস করিয়েছেন, তাই তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন কর। নিশ্চয় আমার রব অতি নিকটে এবং দোয়া কবুলকারী’– সূরা হুদ–৬১। ইস্তেগফার পাপকে নেকিতে পরিবর্তন করতে সহায়তা করে। নেক আমলের মাধ্যমে পাপগুলো নেকিতে পরিবর্তন হয় যা বান্দাকে পূর্ণতা ও সঠিক পথের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহর কুরআন মজিদ বলছে, ‘কিন্তু যারা তাওবা করেছে, ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, আল্লাহতায়ালা এমন সব লোকদের গুণাহসমূহ তাদের নেক আমল দ্বারা বদলে দিবেন, আল্লাহতায়ালা ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। যে ব্যক্তি তাওবা করে এবং নেক আমল করে সে আল্লাহ অভিমুখী হয়ে পড়ে’– সূরা আল ফোরকান– ৭০–৭১। গুণাহমুক্ত জীবনের উৎকৃষ্ট অনুপ্রেরণা হল ইস্তেগফার। অনিচ্ছাকৃত ভুল–ত্রুটির জন্য আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে কান্নাকাটি করে নিজের জিন্দেগীর সমস্ত গুনাহ খাতার জন্য একমাত্র তাঁর কাছেই সাহায্য চাই কোন মাধ্যম ছাড়াই। যখন সমগ্র পৃথিবী নীরব, ঘুমিয়ে থাকে সে সময় জাগ্রত হয়ে রাতের শেষ অংশে আল্লাহতায়ালার কাছে নোনাজারি করে মুমিন বান্দারা এভাবেই বলেন, ‘যারা তাদের মালিকের উদ্দেশ্যে সেজদাবনত হয়ে ও দন্ডায়মান থেকে রাতগুলো কাটিয়ে দেয়। যারা বলে, হে আমাদের মালিক তুমি আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে দূরে রাখ কেননা তাঁর আযাব হচ্ছে নিশ্চিত বিনাশ’– সূরা আল ফোরকান–৬৪–৬৫।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল
 
        
