ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট করবে সরকার ও বিপিসি

প্রকল্প একনেকে অনুমোদন, ব্যয় নির্ধারণ ৩৫ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা ২০৩০ সালের জুনে শেষ করার লক্ষ্য, হবে ২০টি প্রসেসিং ইউনিট

হাসান আকবর | বুধবার , ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ

সরকার এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) যৌথভাবে ইস্টার্ন রিফাইনারীর দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপন করছে। বিদেশি ঋণের জন্য অপেক্ষা করে গত ১৫ বছরে প্রকল্পটির ব্যয় তিন গুণের বেশি বেড়ে যাওয়ার পর সরকার যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের জন্য ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৬৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকার ২১ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা এবং বিপিসি নিজস্ব তহবিল থেকে ১৪ হাজার ১৮৭ কোটি টাকার যোগান দেবে। প্রকল্পটি গতকাল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন করেছে। একনেকের অনুমোদনের পর প্রকল্পটি গতি পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শুধু জ্বালানি তেল পরিশোধন কিংবা আর্থিক সাশ্রয় নয়, এই প্রকল্প দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বড় ভূমিকা রাখবে।

সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে বছরে ৭০ লাখ টনের বেশি জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। এর সামান্য অংশ পরিশোধনের সক্ষমতা রয়েছে বিপিসির। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র জ্বালানি তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি বছরে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টনের মতো ক্রুড অয়েল পরিশোধন করতে পারে। বাকি সব তেল বিদেশ থেকে পরিশোধিত অবস্থায় আমদানি করতে হয়। পরিশোধিত তেলের দাম ক্রুড অয়েলের তুলনায় অনেক বেশি। পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে বাধ্য হওয়ায় দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। ক্রুড হিসেবে আমদানি করে দেশে পরিশোধন করা গেলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা পেত। কিন্তু ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব না হওয়ায় দেশে ক্রুড অয়েল আমদানি বাড়ানো যাচ্ছে না। বৈদেশিক মুদ্রায় শত শত কোটি টাকা বাড়তি অর্থ ব্যয় করে বছরের পর বছর ধরে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে হচ্ছে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ১৯৬৮ সালে নির্মিত ইস্টার্ন রিফাইনারির উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১০ সালে গ্রহণ করা হয় ইস্টার্ন রিফাইনারি দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণ প্রকল্প। বছরে ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন ইস্টার্ন রিফাইনারি২ নামে নতুন একটি রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ওই সময় প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৩ হাজার কোটি টাকা। পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারির ২শ একর জায়গার এক পাশে ৭০ একর জায়গায় দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৫ বছর ধরে ঢিমেতালে চলা প্রকল্পটির ব্যয় ইতোমধ্যে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা ছুঁয়েছে। অবশ্য পরবর্তীতে সংশোধিত প্রকল্পে ব্যয় সাড়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

প্রকল্পটি নিয়ে অনেকদিন ধরে আলোচনা চলছে। নানাভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করে আসছিল বিপিসি। তারা সরকার থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণসুবিধা নিয়ে প্রকল্পটি করতে চেয়েছিল। পরবর্তীতে এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত হয় দেশের আলোচিত শিল্পগ্রুপ এস আলম। তারা প্রকল্পটিতে অর্থায়নের প্রস্তাব দেয়। ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট২’ শীর্ষক প্রকল্পটি ইআরএল এবং এস আলম গ্রুপের সাথে এমওইউ স্বাক্ষর করা হয়। এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে ৩০ লাখ টনের পরিবর্তে ৫০ লাখ টন ক্রুড পরিশোধন ধারণক্ষমতা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এস আলম গ্রুপের সাথে যৌথভাবে ইস্টার্ন রিফাইনারি নির্মাণের ব্যাপারে নানা প্রক্রিয়া চালানো হয়। প্রকল্পের ডিপিপি প্রস্তুত করে দেওয়া হয় মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় থেকে ফাইল পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। ওখান থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসার আগেই কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সৃষ্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতন হলে ইস্টার্ন রিফাইনারি দ্বিতীয় ইউনিটের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সরকার এস আলমের সাথে করা চুক্তি বাতিল করে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রকল্পটি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করে। ‘ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ (ইআরএল)’ নামের এই প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন থেকে প্রকল্পটি নিয়ে বেশ কিছু অবজারভেশন দেয়। সেগুলো পুনরায় সংশোধন করা হয়। এতে প্রকল্প ব্যয় ৪৩ হাজার কোটি টাকা থেকে কমে ৩৫ হাজার ৪৬৫ কোটি ১৪ লাখ টাকায় নেমে আসে। এর মধ্যে সরকার ২১ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা এবং বিপিসি নিজস্ব তহবিল থেকে ১৪ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা যোগান দেবে।

গতকাল ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টা ও একনেকের চেয়ারপারসন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পটি ২০৩০ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণে নতুন ২০টি প্রসেসিং ইউনিট স্থাপন করা হবে। এতে ইউরো৫ মানের জ্বালানি তেল উৎপাদিত হবে, যা পরিবেশ সুরক্ষায় সহায়ক হবে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।

উল্লেখ্য, ইস্টার্ন রিফাইনারি আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল পরিশোধন করে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল, বিটুমিন, এলপিজি, জেট ফুয়েলসহ ১৭ ধরনের পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট উৎপাদন করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকনেকে ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকার ২২ প্রকল্প অনুমোদন
পরবর্তী নিবন্ধবিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে ৪০ কৃষক