এবার রীতিমত বিস্ফোরিত হলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা; নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সমালোচনা করে আসা নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারকে নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়লেন প্রকাশ্যে, তার সামনেই। গতকাল মঙ্গলবার ‘জাতীয় ভোটার দিবসের’ অনুষ্ঠানে সিইসি বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে হেয়, অপদস্ত ও নিচে নামানোর জন্য যা করা দরকার, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার সবই করে চলেছেন। নূরুল হুদা অভিযোগ করলেন, ব্যক্তিগত স্বার্থে ও উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ইসিকে হেয় করে চলেছেন কমিশনের এই সদস্য। নির্বাচন ভবনের অডিটরিয়ামে এ অনুষ্ঠানে সিইসি যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন, মাহবুব তালুকদারসহ চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব, অতিরিক্ত সচিব, এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক ও প্রকল্প পরিচালক তখন মঞ্চে বসা। আর নির্বাচন কমিশনের হাজার খানেক কর্মীর সঙ্গ সাংবাদিকরাও মিলনায়তনে উপস্থিত। সবার শেষে বক্তব্য দিতে উঠে সিইসি যখন মাহবুব তালুকদারকে নিয়ে কথা বলছিলেন, তখন এই নির্বাচন কমিশনারও পড়েন অস্বস্তিতে। তবে তিনি মঞ্চ ছেড়ে যাননি। খবর বিডিনিউজের।
সিইসির ঠিক আগেই অনুষ্ঠানে নিজের লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান মাহবুব তালুকদার। সেখানে তিনি বরাবরের মতই দেশের নির্বাচন পরিস্থিতি এবং কমিশনের ভূমিকা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। তার পরে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে এসে সিইসি কে এম নূরুল হুদা বলেন, মাহবুব তালুকদার সাহেব অভ্যাসগতভাবে সারাজীবন আমাদের এ নির্বাচনে যোগ দেওয়ার পরদিন থেকে যা কিছু ইসির নেগেটিভ দিক, তা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে পাঠ করতেন। আজকে এর ব্যতিক্রম হয়নি। ভোটার দিবস উপলক্ষ্যেও মাহবুব তালুকদার ‘একটি রাজনৈতিক বক্তব্য’ দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন সিইসি।
তিনি বলেন, দেশের নির্বাচন কমিশনের স্বার্থে তিনি (মাহবুব তালুকদার) কাজ করেন না; ব্যক্তি স্বার্থে ও একটা উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য এ কমিশনকে অপদস্ত করার জন্য যতটুকু যা করা দরকার, যখন যতটুকু করা দরকার, ততটুকু করেছেন উনি।
ক্ষোভের সঙ্গে সিইসি বলেন, এ নির্বাচন কমিশনে যোগ দেওয়ার পর যতগুলো সভা হয়েছে, সবসময় মাহবুব তালুকদার একই আচরণ করে আসছেন। ভেবেছিলাম ভোটার দিবস হিসেবে তিনি কিছু বলবেন; কিন্তু তিনি রাজনৈতিক বক্তব্য রাখলেন। ইসিকে কতখানি হেয় করা যায়, কতখানি নিচে নামানো যায়, অপদস্ত করা যায় তা তিনি করে চলেছেন।
তিনি অভিযোগ করেন, ‘নিজের বই লেখার প্রস্তুতির জন্যই’ কমিশনের নানা নেতিবাচক তথ্য সংগ্রহ করে উপস্থাপন করে থাকেন নির্বাচন কমিশনার তালুকদার। আর তা করতে গিয়ে তিনি ‘ভুল তথ্যও উপস্থাপন’ করেন মন্তব্য করে সিইসি নূরুল হুদা বলেন, ইভিএমে যে ৮৫% ভোট পড়েছে, তা তিনি (মাহবুব তালুকদার) দেখেননি। যেখানে ৬০%, ৭০% ভোট পড়েছে, তাও তিনি দেখেননি। তা কোনোদিনও তিনি বলবেন না।
সিইসি হুদা বলেন, একজন নির্বাচন কমিশনার হিসেবে স্বাধীনভাবে মাহবুব তালুকদার কাজ করতেই পারেন। আর মেয়াদের শেষ বছরে এসেও মাহবুব তালুকদার নিজেকে বদলাবেন বলে তিনি মনে করেন না। ‘তিনি বলেছেন, বলবেন; আর একটা বছর আছে, তা তিনি বলতে থাকবেন, ধরে নিই।… নির্বাচন কমিশনের যেখানে যতটুকু ভুলত্রুটি, একটা পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটেঘুটে কোথাও থেকে, ডাস্টবিন থেকে একটা, ওখান থেকে একটা জোড়াতালি দিয়ে ভুলত্রুটি বের করে সম্ভব। ইসিতে তার কী দায়িত্ব, এটা কতটুকু, কী পরামর্শ দিয়েছেন, কাজ করেছেন, সেগুলো করেন কিনা। তা না করে ‘এটা করা যায়নি’, ‘এটা করলে ভালো হতো’, ‘কর্মকর্তারা কাজ কী করছেন’, ‘এগুলো করেন কিনা’, এসব প্রশ্ন করা যায়।’
সিইসি বলেন, উনি কথা বলার পরদিন গণমাধ্যমে কেমন কভারেজ পেল, কাটিং সংগ্রহ করবেন, ইসির পাঁচবছর হবে, ভালো লিখতে পারেন,… উনি বই লিখবেন, এজন্য তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেন। সিইসির অভিযোগ ও বিস্ফোরক মন্তব্যের বিষয়ে অনুষ্ঠানের পর নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
সবার জন্য সমান সুযোগ থাকছে না : ওদিকে নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ (লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড) থাকছে না বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেছেন, স্থানীয় নির্বাচনগুলোর গতিপ্রকৃতি দেখে আমার ধারণা হচ্ছে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনের যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও ভারসাম্য রক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা হচ্ছে না। এক কেন্দ্রীয় নির্বাচনে স্থানীয় নির্বাচনের তেমন গুরুত্ব নেই, নির্বাচনে মনোনয়ন লাভই এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্থানীয় নির্বাচনেও হানাহানি, মারামারি, কেন্দ্র দখল, ইভিএম ভাঙচুর ইত্যাদি মিলে এখন একটা অনিয়মের মডেল তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা হলেও অসংখ্য বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা দুর্ঘটনা মিলে এক ধরনের অবিছিন্নতা তৈরি হয়, যা নির্বাচনের অনুষঙ্গ হিসেবে রূপ লাভ করে।
জাতীয় ভোটার দিবস উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার মাহবুব তালুকদার লিখিত বক্তব্যে বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরেন। সম্প্রতি চট্টগ্রামের রাউজান পৌরসভার ভোটের উদাহরণ দিয়ে মাহবুব তালুকদার বলেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে চমক সৃষ্টিকারী পৌরসভা নির্বাচন হয়েছে চট্টগ্রামের রাউজানে। মেয়র ও ১২ জন কাউন্সিলর বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে রাউজান থেকে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও তখন তুলে নেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে উপজেলা নির্বাচনেও ঠিক এভাবে রাউজানে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে এটা নির্বাচন না বলে মনোনয়ন বলাই সম্ভবত অধিকতর সংগত। সারা দেশে যদি এই মডেলে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনপ্রতিনিধি হতে পারেন, তাহলে নির্বাচনে অনেক আর্থিক সাশ্রয় হয় এবং সহিংসতা ও হানাহানি থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এতে নির্বাচন কমিশনের দায়-দায়িত্ব তেমন থাকবে না। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের আর প্রয়োজন হবে কি না, সেটা এক বড় প্রশ্ন।
নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার না হলে সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয় উল্লেখ করে মাহবুব তালুকদার বলেন, সংস্কার না হলে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সংশ্লিষ্ট সব মহলের ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার না হলে এখন যে ধরনের নির্বাচন হচ্ছে, তার মান আরও নিম্নগামী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।