ইসলাম প্রচারে চট্টগ্রামের সুফি-সাধক

গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন, গবেষক | বৃহস্পতিবার , ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৭:৪১ পূর্বাহ্ণ

সুফঅর্থ পশম আর তাসাউফের অর্থ পশমি বস্ত্রে পরিধানের অভ্যাস (লাবসুসসুফ)। মরমিতত্ত্বের সাধনায় কারও জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাওউফ। যিনি নিজেকে এরূপ সাধনায় সমর্পিত করেন, তাঁকে সুফি বলে।

পরম সত্তাকে জানার জন্য অনন্তকাল ধরে মানুষের মধ্যে রয়েছে এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা। তাই মানুষ যুগে যুগে আধ্যাত্মিক অভিযান চালিয়েছে। এ পরম সত্তাকে আবিষ্কার করে তাঁর সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে, পরম সত্তাকে জানার এ প্রয়াসকে ইসলামে বলা হয় সুফিবাদ। সুফিবাদ হচ্ছে ইসলামী এমন একটি পথ যে পথে কঠোর ধ্যান ও প্রার্থনার মাধ্যমে স্রষ্টার ভালোবাসা পাওয়া যায় এবং সাথে নিজের আত্মার উন্নয়ন। স্রষ্টার প্রতি তীব্র ভালোবাসার মাধ্যমে মানুষের আত্মোন্নয়নই হচ্ছে সুফিবাদের মূল কথা।

হযরত ইমাম গাজালি (রহ.) মতে, ‘মন্দ সবকিছু থেকে আত্মাকে পবিত্র করে সর্বদা আল্লাহর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহতে নিমগ্ন হওয়ার নামই সুফিবাদ।’

অধ্যাপক ম্যাসিগনোঁ বলেন, ‘সুফিবাদ বা মরমীবাদী আন্দোলন এসেছে আদিম মুসলমানদের অতিরিক্ত কঠোর সংযমের প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকার সুত্র। আবার আদিম আরবী এবং পার্সিয়ান উৎস হতে জানা যায় যে, সুফিবাদ হল জীবনের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য যা নবী মুহাম্মদ (সা.) এর পরপরেই এটি প্রসারিত বা বিস্তৃত না হয়ে খুবই ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করে। ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) এর খেলাফতের অবসানের পরে সুফিবাদ প্রকাশিত হয়। এ সময় শাসকদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ থাকায় কিছু উলেমা, নবী ও খলিফাদের আদর্শ নিয়ে এই পথ চলে আসে।’

বসরার রাবিয়া ছিলেন প্রথম মহিলা সুফি সাধক। যিনি ধার্মিক জীবন পালন করতেন এবং দাসের মত খুবই পরিশ্রমী ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘আল্লাহর প্রেম আমাকে এত বেশি নিমগ্ন করেছে যে, আর কারো কোনো প্রেম বা ঘৃণাই আমার অন্তরে নেই’।

বলা বাহুল্য, চট্টগ্রামকে বলা হয় সুফিসাধকের পুণ্যভূমি। ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য সুদূর আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে একাধিক সুফিসাধক, পীরআউলিয়া, ফকিরদরবেশ আসেন চট্টগ্রামে। কেউ কেউ কিছুকাল অবস্থান করে ফিরে যান নিজের জন্মভূমিতে। অনেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থেকে যান বন্দর নগরীতে।

গবেষক ও চট্টলবিদ আবদুল হক চৌধুরীর বন্দর শহর চট্টগ্রাম গ্রন্থে পীর বদর শাহ ও চাটিগাঁসংক্রান্ত লোকগাথাটি উপস্থাপিত হয়েছে নিম্নরূপে: ‘চট্টগ্রামে মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, প্রাচীনকালে চট্টগ্রাম ছিল জিনপরী অধ্যুষিত দেশ। পীর বদর শাহ এখানে আগমন করে অলৌকিক চাটির (মৃৎপ্রদীপ) আলোর সাহায্যে জিনপরী বিতাড়িত করার ফলে এ স্থানের নাম হয় চাটিগাঁ।

কথিত আছে, শাহ বদর (রহ.) ১১ জন দরবেশের সঙ্গে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর সমসাময়িক শাহ বদর (রহ.) ও তাঁর সঙ্গীরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে সমাহিত। বারোজনের মধ্যে বদর আউলিয়াকেই প্রধান হিসেবে চট্টগ্রামবাসী তাদের অভিভাবকের মর্যাদায় গভীর শ্রদ্ধা করেন। চট্টগ্রামবাসী তাঁকে বিভিন্ন নামে ডাকেন, যেমন বদর আলম, বদর আউলিয়া, বদর পীর বা পীর বদর ও বদর শাহ। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে তিনি ‘শাহ বদর আলম’ হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রামের বদরপট্টি বা বদরপটিতে বদর আউলিয়ার মাজার অবস্থিত। বদর শাহর নাম বাংলাদেশের মাঝিমাল্লার কণ্ঠে আজও সমস্বরে উচ্চারিত হয় ‘আমরা আছি পোলাপান,/আল্লাতালা নিগাবান/আল্লাহ, নবী, পাঁচ পীর; বদর; বদর।’ অথবা ‘বদর বদর বদর বদর হেঁইয়ো,/বদর বদর বদর বদর হেঁইয়ো/হেঁইয়োহেঁইয়ো।’

ঐতিহাসিকদের মতে, ইবনে বখতিয়ারের বাংলা বিজয়ের আগেই (ত্রয়োদশ শতকপূর্ব সময়ে) চট্টগ্রাম বন্দরে মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে। বণিকদের পাশাপাশি ধর্মপ্রচারকরাও এ বন্দর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন। ফলে আরব বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সঙ্গে স্থানীয় ধর্মান্তরিত মুসলিমদের সমন্বয়ে এ এলাকায় একটি মুসলিম বসতি গড়ে উঠেছিল দশমদ্বাদশ শতাব্দী কালপর্বে।

ইতিহাসবিদ ড.এনামুল হকের মতে, চট্টগ্রাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় দশম শতক থেকেই মুসলিম বসতি গড়ে ওঠার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। ড. এনামুল হক আরবীয় ও আরাকানি সূত্র বিশ্লেষণ করে দেখান যে অষ্টম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত আরব ব্যবসায়ীরা বাহরউলহরকন্দ (বঙ্গোপসাগর) উপকূলে অবস্থিত সমন্দর (চট্টগ্রাম বা সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত) বন্দরে বাণিজ্য ও বসতি স্থাপন করেছিল। এ সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে মেঘনার মোহনা থেকে পূর্ব দিকে নাফ নদী পর্যন্ত আরবদের রাজনৈতিক আধিপত্য ছিল।

উল্লেখ্য, উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফিসাধকের একজন হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.)। তাঁর জন্ম ইরানের বোস্তাম শহরে। ১৮৩১ সালে হজরত বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় একটি দেয়ালঘেরা আঙিনা আবিষ্কার করা হয়। এরপর থেকে তা বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার হিসেবে জিয়ারত করে আসছেন ভক্তঅনুসারীরা। মাজারের পাদদেশে রয়েছে একটি বিশাল পুকুর। যাতে রয়েছে বিরল প্রজাতির কাছিম। যাকে ভক্তঅনুসারীরা মাজারি ও গজারি নামেই ডাকেন। এখনো প্রতিদিন দেশবিদেশ থেকে প্রচুর মানুষ বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার দর্শনে আসেন।

আরব দেশ থেকে ইসলাম প্রচার করতে আসা বিখ্যাত সুফিসাধকের অন্যতম একজন হলেন হজরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ).। আধ্যাত্মিক জগতের এই খ্যাতিমান ব্যক্তির জন্ম ইয়েমেনের এক সম্‌ভ্রান্ত পরিবারে। ইসলামী মনীষীর কাছ থেকে পাণ্ডিত্ব লাভ করে মনোনিবেশ করেন ইসলাম প্রচারে। অল্প সময়ের মধ্যে হাজার হাজার ভক্তকুল তৈরি হয় হজরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.)-এর। ১৫৬৫ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তারপর তাকে আনোয়ারা উপজেলার ঝিউরী গ্রামে সমাধিস্থ করা হয়। কিন্তু শঙ্খ নদের ভাঙনের কবলে পড়লে সেই সমাধি পরে স্থানান্তর করা হয় আনোয়ারার বটতলীতে। বর্তমানে ওখানে রয়েছে হজরত শাহ মোহছেন আউলিয়ার মাজার। প্রতিদিনই হাজার হাজার ভক্তের আগমন ঘটে মাজারে।

হজরত শাহ আমানত (রহ.) ছিলেন ইরাকের অধিবাসী। ১৬৮০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন বলে ধারণা করা হয়। তাঁর পিতার নাম হজরত নিয়ামত শাহ (রহ.)। বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানীর বংশধর ছিলেন হজরত শাহ আমানত (রহ)। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন বংশ পরম্পরায় সুফি, পীরআউলিয়া। শিশুকাল থেকেই তিনি সৃষ্টিকর্তার সাধনায় মশগুল ছিলেন।ইসলামের এই মহান সাধক হজরত শাহ আমানত (রহ.) ১৮০৬ সালে ১২৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁকে লালদীঘির পূর্বপাড়ে বর্তমান খানকাহ শরিফে দাফন করা হয়। তাঁর খানকায় দেশবিদেশ থেকে প্রচুর মানুষ আসেন। তারা দোয়া পাঠ করেন। দান করেন মুক্তহস্তে। প্রতি বছর তাঁর খানকায় ওরস হয়।

চট্টগ্রামের প্রখ্যাত মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফের প্রতিষ্ঠাতা হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী। তিনি মাইজভাণ্ডার তরিকারও প্রতিষ্ঠাতা। ১৯০৬ সালে সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দেন হজরত সৈয়দ আহমদ মাইজভাণ্ডারী। প্রতি বছরের ১০ মাঘ হজরত সৈয়দ আহমদ মাইজভাণ্ডারীর ওরস অনুষ্ঠিত হয়। ওই ওরসে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার ভক্ত হাজির হন। এ ছাড়া প্রতিদিনই বহু ভক্তের পদচারণায় মুখরিত থাকে মাইজভান্ডার দরবার প্রাঙ্গণ।

ইসলাম প্রচার করতে আসা আরব ও অন্যান্য দেশ থেকে আসা সুফিসাধকরা হলেন, শেখ ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.),

হজরত গরিব উল্লাহ শাহ (রহ.), হজরত মোল্লা মিছকিন শাহ (রহ), হজরত বদনা শাহ (রহ.) প্রকাশ শফি শাহ (রহ), হজরত আনার উল্লাহ শাহজী (রহ), হজরত ইয়াসিন আউলিয়া (রহ.), হজরত শাহা চান্দ আউলিয়া (রহ.), জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (রহ.), হজরত শাহজাহান শাহ (রহ.), হজরত আজিজুল হক আল কাদেরী (রহ.), হজরত আমির শাহ (রহ.), আমিরুজ্জামান মাইজভাণ্ডারী (রহ.), হজরত টাক শাহ (রহ.), হজরত আকবর শাহ (রহ.), হজরত নজির শাহ (রহ.), হজরত জঙ্গি শাহ (রহ.), হজরত শাহ আবদুল বাসেত (রহ.), হজরত শাহচাঁন্দ আউলিয়া (রহ.) কাতাল পীর (রহ.), হজরত খলিলুর রহমান শাহ (রহ.), হজরত আবদুল আজিজ পাঠুনটুলি (রহ.)সহ অসংখ্য পীর আউলিয়া।

লেখক: গবেষক; ডেপুটি রেজিস্ট্রার,

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঐতিহ্যের চট্টগ্রামে ঐতিহ্যের খাবার
পরবর্তী নিবন্ধমাদকের টাকায় বহুতল ভবন, ক্রোকের নির্দেশ আদালতের