মায়ের সঙ্গে যেমন সন্তানের সম্পর্ক গভীর, মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কও তেমনি গভীর। সন্তান জন্মের পর যখন কথা বলতে শেখে তখন সে তার মায়ের ভাষাতেই কথা বলে, এটা তার স্বভাবগত ও জন্মগত চাহিদা। ইসলাম মানুষের এ চাহিদার যথেষ্ট মূল্যায়ন করেছে। প্রত্যেক জাতির কাছে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছানোর জন্য এই জগতে ধারাবাহিকভাবে নবি ও রসুল এসেছেন।
মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি-এই তিনটি শব্দ সব মানুষের কাছে পরম আবেগের। মাতৃভাষা মানে মায়ের ভাষা। দুনিয়ার সব দেশের নিজ নিজ ভাষা রয়েছে। এ ভাষা তাদের মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা, স্বপ্নের ভাষা এবং জীবনযাপনের ভাষা। মায়ের কাছ থেকে এ ভাষা শেখে বিধায় এর নাম হয়েছে মাতৃভাষা।
মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার দীপ্ত শপথ নিয়ে বাংলার কিছু অকুতোভয় বীর সন্তান নিজেদের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রচনা করে এক সূর্যস্নাত রক্তিম ইতিহাস। যা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যকে আরো গভীরে নিয়ে গেছে। অথচ এখানে একটি প্রশ্ন প্রায়ই অনেকের মনে দোলা দেয়, ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে ইসলামের ভূমিকা কী? এ নিয়ে আলোচনার অবতারণা।
ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা : মানুষ জন্মের পর থেকে যে ভাষায় কথা বলে, বড় হয়ে ওঠে, সেটাই তার মাতৃভাষা। এই ভাষায় কথা বলার অধিকার তার জন্মগত অধিকার, এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এর সঙ্গে সে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত হয়ে যায়। তাই ইসলাম মানুষের ভাষাকে বিভিন্নভাবে মর্যাদা ও গুরুত্ব দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা মানুষের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তার প্রেরিত প্রত্যেক নবী-রাসুলকে স্বজাতির ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন এবং এ ভাষাতেই কিতাবাদি নাজিল করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকে তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’-সুরা ইবরাহিম : ৪
জগতের সবকিছুই আল্লাহর সৃষ্টি ও অকৃপণ দান। ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। ভাষা আল্লাহর দান, আল্লাহ তাআলার সেরা নেয়ামত; ভাষা মনুষ্য পরিচয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করতে শেখায়; কারণ, সব ভাষাই আল্লাহর দান ও তাঁর কুদরতের নিদর্শন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা-৩০ রুম, আয়াত: ২২, ২১; পারা: ২১)।
ইসলাম মাতৃভাষা নিয়ে গর্ব করাকে অন্যায়, অন্যায্য ও অবৈধ কিছু মনে করে না। বরং হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মায়ের ভাষা আরবিতে কথা বলতে গর্ববোধ করতেন। তার মাতৃভাষা ছিল আরবি। এ কারণেই শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর শেষ কিতাব কোরআনে কারিম নাজিল হয়েছে আরবি ভাষায়। তিনি বলতেন,‘আরবদের মধ্যে আমার ভাষা সর্বাধিক সুফলিত। তোমাদের চাইতেও আমার ভাষা অধিকতর মার্জিত ও সুফলিত।’-আল মুজাম :৫/৩৫৫। কারণ সব ভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহর সৃষ্টিকে তাচ্ছিল্য করার অধিকার কারো নেই।
ইসলাম ঘোষণা করেছে, মাতৃভাষা ব্যবহার করার অধিকার মানুষের সৃষ্টিগত তথা জন্মগত অধিকার। কারণ মহান আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং সাথে সাথে তাকে তার ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :‘‘দয়াময় আল্লাহ্। তিনিই শিক্ষা দিয়াছেন কুরআন। তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।’’-সুরা আর রাহমান: ১-৪ ১-৪
এর কারণ নবী করিম (সা.) নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ‘আরবের সবচেয়ে মার্জিত ভাষার অধিকারী সাদিয়া গোত্রে আমি মানুষ হয়েছি। তাদেরই কোলে আমার মুখ ফুটেছে। তাই আমি সর্বাধিক সুফলিত ভাষা ব্যক্ত করেছি। কাজেই মাতৃভাষা নিয়ে গর্ব করা যায়। আমরা জানি, কোরআনে কারিম মূলত ভাষা ও উচ্চারণ রীতিকে প্রাধান্য দিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু ইসলাম ভাষাগত আঞ্চলিকতা তথা মাতৃভাষার প্রতি এত গুরুত্ব দিয়েছে যে, কোরআন আরবের বিভিন্ন পঠনরীতিতে পাঠ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ জন্য কোরআন পাঠ সাত কিরাত (পঠনরীতি) প্রচলিত আছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘রাসুল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই কোরআন সাত হরফে বা উপভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব, এসব ভাষার মধ্যে যে ভাষাটি (তোমাদের কাছে) সহজ হয়, সে ভাষাতেই তোমরা তা পাঠ করো।’-সহিহ বোখারি: ৪৭৫৪
জগতের সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ, মাতৃভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। বস্তুত ভাষার ব্যবহার মুখে বলা বা কলমে লেখা দু’ভাবে হয়ে থাকে। মাতৃভাষা সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে এক অসাধারণ নিয়ামত। মানবজাতি দু’ভাবেই ভাষা প্রয়োগের ক্ষমতা পেয়েছে। তাই মাতৃভাষার গুরুত্ব ইসলামে অপরিসীম। আর এ ক্ষমতাই মানুষকে অন্যসব প্রাণী থেকে পৃথক ও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে। আল্লাহতায়ালার সব নিয়ামতের সঙ্গে মাতৃভাষার কদর করার কথা বলেছেন। পৃথিবীর বৈচিত্র আল্লাহতায়ালার অসীম কুদরতের নিদর্শন। পৃথিবীর মানুষ, প্রকৃতি ও অন্য সব সৃষ্টির বৈচিত্রের মতো মানুষের ভাষার বৈচিত্র অন্যতম নিদর্শন। ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে প্রায় ছয় হাজারের অধিক ভাষা রয়েছে।এ ছাড়া রয়েছে প্রচুর আঞ্চলিক কথ্য ভাষা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’-সুরা রুম: ২২
এ আয়াতের আলোকে বলা চলে, পৃথিবীর সব মানুষ যেমন আল্লাহর প্রিয় সৃষ্টি; তেমনি ভাষাও আল্লাহর সৃষ্টি। নবী করিম (সা.) ছিলেন আরবের সবচেয়ে সুন্দর ও শুদ্ধভাষী। তিনি কোনোদিন একটি অশুদ্ধ শব্দ ও বাক্য উচ্চারণ করেননি। নবী করিম (সা.) ভাষার বিকৃতি কিংবা কারও নামের বিকৃতি নিষেধ করেছেন। ইসলাম ভাষার বিকৃতিকে সমর্থন করে না। ইচ্ছাকৃতভাবে উচ্চারণ বিকৃতি বা ব্যঙ্গ মারাত্মক অন্যায়। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। তাই নবী করিম (সা.)-এর আদর্শ অনুসারে আমাদেরও উচিত মাতৃভাষা চর্চায় মনোযোগী হওয়া। আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে মানুষের হেদায়েতে যেসব নবী-রাসুল দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন, তাদের প্রত্যেককে স্ব-জাতির ভাষায় পাঠিয়েছেন। তাই ইসলাম মনে করে, ইসলামের মূলনীতির ভিত্তিতে বিশ্বের সবদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী তার মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা ও গুরত্ব দেবে। মাতৃভাষায় অন্যসব জ্ঞানের মতো ইসলামি জ্ঞানের চর্চা করবে এবং মাতৃভাষায় ইসলামি সাহিত্যকর্ম সমৃদ্ধ করবে। ভাষার স্বকীয়তা রক্ষার পাশাপাশি ভাষার উৎকর্ষ সাধনে আত্মনিয়োগ করবে। মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নিজ নিজ ভাষার ব্যবহার দ্বারা ইসলাম প্রচার ও ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষায় সচেতন হবে। মনে রাখতে হবে, মাতৃভাষা একটি দেশের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে অনেকাংশে জড়িত। এটা আল্লাহর দান বিশেষ। ইসলামে এর মর্যাদা তুলনাহীন। সেভাবেই ভাষা রক্ষা করতে হবে, নিজ নিজ ভাষা কীভাবে উন্নত ও সমৃদ্ধ হয় সেভাবে কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। পৃথিবীর প্রত্যেক জনপদে সব জাতির নিজস্ব ভাষা রয়েছে, যা তাদের মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা, স্বপ্নের ভাষা এবং প্রাত্যহিক মনের অব্যক্ত বিষয়গুলো প্রকাশের ভাষা। মমতাময়ী মায়ের কাছ থেকে প্রথম সে ভাষা শেখে বলে তার নামকরণ করা হয়েছে মাতৃভাষা। বর্তমানে বিশ্বে প্রচলিত ছয় সহস্রাধিক ভাষার মধ্যে এক এক জনপদের লোকেরা তাদের সেই প্রিয় মাতৃভাষায় কথা বলে থাকেন। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছে পৃথিবীর অনেক দেশ ও অঞ্চলকে। তুরস্ক, বুলগেরিয়া, মধ্য এশিয়ার অঞ্চলগুলো এবং ভারতের উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানব জাতির মধ্যে ভাষাগত যে বিভিন্নরূপ, তা মহান রবের অশেষ রহমতের অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত এক বাগানসদৃশ। আর আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা সেই রহমতেরই একটি ফুল।
তবে আমাদের মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় শুধু আন্দোলন-সংগ্রামই নয়, জীবনও দিতে হয়েছে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির ইতিহাসে রচিত হয়েছে অমর এক শোকগাথা; যেখানে শাহাদতের সুধা পান করতে হয়েছে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেককেই। বাংলার দামাল ছেলেরা সেদিন বুকের তাজা রক্ত ঢেলে মায়ের ভাষাকে মুক্ত করেছিলেন বলেই আজ একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের উচিত ভাষা শহীদদের জন্য দোয়া করা এবং বিশুদ্ধ মাতৃভাষা চর্চা করা, বাংলাকে সব বিকৃতি থেকে রক্ষা করা। আমাদের মাতৃভাষা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত ও সম্মানিত একটি ভাষা, যা ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকোর ঘোষণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ থেকে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
বাঙালীদেরকে রক্তের সিঁড়ি বেয়ে ভাষার অধিকার আদায় করতে হয়েছে। বাঙালীদের সে সংগ্রাম ছিল কুরআন-সুন্নাহ সম্মত। বীর বাঙালীদের সে আত্মত্যাগের ফসল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাবৎ বিশ্বের সব জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালী জাতির অবদান অনস্বীকার্য। এ জন্য আমরা গর্বিত।
শেষ কথা : আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, আল্লাহতাআলা ভাষাশহীদসহ সব শহীদানের শাহাদাত কবুল করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে তাঁদের উচ্চ-মর্যাদায় আসীন করুন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষাকে কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী রাখুন এবং কিয়ামত পর্যন্ত উত্তরোত্তর এর শ্রীবৃদ্ধি সাধন করুন। আমাদের বিশুদ্ধ মাতৃভাষার ব্যবহার ও এর মাধ্যমে সত্য ও ন্যায়ের প্রতি দাওয়াতের তৌফিক দান করুন।
লেখক : হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস, এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড










