ইসলামে ভাষা শহীদদের মর্যাদা ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা

ফখরুল ইসলাম নোমানী | সোমবার , ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার মাস। এ মাস আমাদেরকে মাতৃভাষা ও ভাষার জন্য জীবনদানকারী বীর শহীদদের স্মরণ করিয়ে দেয়। যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি নিজেদের ভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা তাদের প্রতি রয়েছে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তারা কিয়ামত পর্যন্ত আমাদের নিকট অমর হয়ে থাকবে। প্রতিদান দিবসে তাঁরা আল্লাহর নিকট পাবেন উত্তম প্রতিদান।

মাতৃভাষার মর্যাদা ইসলামে স্বীকৃত। নিজের মায়ের মুখ থেকে শেখা ভাষার প্রতি মানুষের ভালোবাসা স্বভাবজাত। ইসলামে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার অনুপ্রেরণার কথা এসেছে। মহানবী (সা.)-এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। বায়হাকি শরিফের এক হাদিসে তাঁর আরবি প্রীতির বিরল নজির পাওয়া যায়। তিনি বলেন, তোমরা তিন কারণে আরবদের ভালোবাসবে। প্রথমত, আমি আরবীয়, দ্বিতীয়ত, পবিত্র কোরআনের ভাষা আরবি এবং তৃতীয়ত, জান্নাতবাসীদেরও ভাষা হবে আরবি। রাসুল (সা.)-এর উল্লিখিত বাণীর পরিপ্রেক্ষিতে মাতৃভাষার প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃ প্রকাশ ঘটেছে।

মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি এই তিনটি শব্দ সব মানুষের কাছে পরম আবেগের। মাতৃভাষা মানে মায়ের ভাষা। দুনিয়ার সব দেশের নিজ নিজ ভাষা রয়েছে। এ ভাষা তাদের মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা, স্বপ্নের ভাষা এবং জীবনযাপনের ভাষা। মায়ের কাছ থেকে এ ভাষা শেখে বিধায় এর নাম হয়েছে মাতৃভাষা।

মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার দীপ্ত শপথ নিয়ে বাংলার কিছু অকুতোভয় বীর সন্তান নিজেদের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রচনা করে এক সূর্যস্নাত রক্তিম ইতিহাস। যা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যকে আরো গভীরে নিয়ে গেছে। অথচ এখানে একটি প্রশ্ন প্রায়ই অনেকের মনে দোলা দেয় ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে ইসলামের ভূমিকা কী? এ নিয়ে আলোচনার অবতারণা।

মানুষ জন্মের পর থেকে যে ভাষায় কথা বলে বড় হয়ে ওঠে সেটাই তার মাতৃভাষা। এই ভাষায় কথা বলার অধিকার তার জন্মগত অধিকার এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এর সঙ্গে সে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত হয়ে যায়। তাই ইসলাম মানুষের ভাষাকে বিভিন্নভাবে মর্যাদা ও গুরুত্ব দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা মানুষের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তার প্রেরিত প্রত্যেক নবীরাসুলকে স্বজাতির ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন এবং এ ভাষাতেই কিতাবাদি নাজিল করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি প্রত্যেক রাসুলকে তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।

ইসলাম মাতৃভাষা নিয়ে গর্ব করাকে অন্যায়, অন্যায্য ও অবৈধ কিছু মনে করে না। বরং হাদিসে বর্ণিত আছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মায়ের ভাষা আরবিতে কথা বলতে গর্ববোধ করতেন। তার মাতৃভাষা ছিল আরবি। এ কারণেই শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর শেষ কিতাব কোরআনে কারিম নাজিল হয়েছে আরবি ভাষায়।

জগতের সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ, মাতৃভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। বস্তুত ভাষার ব্যবহার মুখে বলা বা কলমে লেখা দুভাবে হয়ে থাকে। মাতৃভাষা সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে এক অসাধারণ নিয়ামত। মানবজাতি দুভাবেই ভাষা প্রয়োগের ক্ষমতা পেয়েছে। তাই মাতৃভাষার গুরুত্ব ইসলামে অপরিসীম। আর এ ক্ষমতাই মানুষকে অন্যসব প্রাণী থেকে পৃথক ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। আল্লাহতায়ালার সব নিয়ামতের সঙ্গে মাতৃভাষার কদর করার কথা বলেছেন। পৃথিবীর বৈচিত্র্য আল্লাহতায়ালার অসীম কুদরতের নিদর্শন। পৃথিবীর মানুষ প্রকৃতি ও অন্য সব সৃষ্টির বৈচিত্র্যের মতো মানুষের ভাষার বৈচিত্র্য অন্যতম নিদর্শন। ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে প্রায় ছয় হাজারের অধিক ভাষা রয়েছে।

পৃথিবীর সব মানুষ যেমন আল্লাহর প্রিয় সৃষ্টি; তেমনি ভাষাও আল্লাহর সৃষ্টি। নবী করিম (সা.)-ভাষার বিকৃতি কিংবা কারও নামের বিকৃতি নিষেধ করেছেন। ইসলাম ভাষার বিকৃতিকে সমর্থন করে না। ইচ্ছাকৃতভাবে উচ্চারণ বিকৃতি বা ব্যঙ্গ মারাত্মক অন্যায়। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। তাই নবী করিম (সা.)-এর আদর্শ অনুসারে আমাদেরও উচিত মাতৃভাষা চর্চায় মনোযোগী হওয়া। আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে মানুষের হেদায়েতে যেসব নবীরাসুল দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন তাদের প্রত্যেককে স্বজাতির ভাষায় পাঠিয়েছেন। তাই ইসলাম মনে করে ইসলামের মূলনীতির ভিত্তিতে বিশ্বের সবদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী তার মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্ব দেবে। মাতৃভাষায় অন্যসব জ্ঞানের মতো ইসলামি জ্ঞানের চর্চা করবে এবং মাতৃভাষায় ইসলামি সাহিত্যকর্ম সমৃদ্ধ করবে। ভাষার স্বকীয়তা রক্ষার পাশাপাশি ভাষার উৎকর্ষ সাধনে আত্মনিয়োগ করবে। মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নিজ নিজ ভাষার ব্যবহার দ্বারা ইসলাম প্রচার ও ইতিহাসঐতিহ্য রক্ষায় সচেতন হবে। মনে রাখতে হবে মাতৃভাষা একটি দেশের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে অনেকাংশে জড়িত। এটা আল্লাহর দান বিশেষ। ইসলামে এর মর্যাদা তুলনাহীন। সেভাবেই ভাষা রক্ষা করতে হবে নিজ নিজ ভাষা কীভাবে উন্নত ও সমৃদ্ধ হয় সেভাবে কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে।

পৃথিবীর প্রত্যেক জনপদে সব জাতির নিজস্ব ভাষা রয়েছে যা তাদের মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা, স্বপ্নের ভাষা এবং প্রাত্যহিক মনের অব্যক্ত বিষয়গুলো প্রকাশের ভাষা। মমতাময়ী মায়ের কাছ থেকে প্রথম সে ভাষা শেখে বলে তার নামকরণ করা হয়েছে মাতৃভাষা। বর্তমানে বিশ্বে প্রচলিত ছয় সহস্রাধিক ভাষার মধ্যে এক এক জনপদের লোকেরা তাদের সেই প্রিয় মাতৃভাষায় কথা বলে থাকেন। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছে পৃথিবীর অনেক দেশ ও অঞ্চলকে। তুরস্ক, বুলগেরিয়া, মধ্য এশিয়ার অঞ্চলগুলো এবং ভারতের উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানব জাতির মধ্যে ভাষাগত যে বিভিন্নরূপ তা মহান রবের অশেষ রহমতের অপরূপ সৌন্দর্য মণ্ডিত এক বাগানসদৃশ। আর আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা সেই রহমতেরই একটি ফুল। তবে আমাদের মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় শুধু আন্দোলন সংগ্রামই নয় জীবনও দিতে হয়েছে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির ইতিহাসে রচিত হয়েছে অমর এক শোকগাথা ; যেখানে শাহাদতের সুধা পান করতে হয়েছে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেককেই। বাংলার দামাল ছেলেরা সেদিন বুকের তাজা রক্ত ঢেলে মায়ের ভাষাকে মুক্ত করেছিলেন বলেই আজ একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের উচিত ভাষা শহিদদের জন্য দোয়া করা এবং বিশুদ্ধ মাতৃভাষা চর্চা করা বাংলাকে সব বিকৃতি থেকে রক্ষা করা। আমাদের মাতৃভাষা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত ও সম্মানিত একটি ভাষা যা ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকোর ঘোষণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ থেকে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

বাঙালিদেরকে রক্তের সিঁড়ি বেয়ে ভাষার অধিকার আদায় করতে হয়েছে। বাঙালিদের সে সংগ্রাম ছিল কুরআনসুন্নাহ সম্মত। বীর বাঙালিদের সে আত্মত্যাগের ফসল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাবৎ বিশ্বের সব জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালি জাতির অবদান অনস্বীকার্য। এ জন্য আমরা গর্বিত। শহীদ, বরকত, জব্বারসহ অগণিত নাম না জানা শহীদ তোমাদের লাখো লাখো সালাম। আর যারা ভাষার সংগ্রামে আত্মাহুতি না দিয়ে গাজী হয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন তাদের প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা ও সালাম।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআন্তর্জাতিক খিঁচুনি দিবস : কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান
পরবর্তী নিবন্ধএকুশের গৌরবগাথা